
দেশে জনসংখ্যার অনুপাতে বাড়ছে না খাদ্যশস্যের উৎপাদন। কৃষিজমি হ্রাস, উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণের অভাব, কৃষি উপকরণের মূল্যবৃদ্ধি এবং সে অনুপাতে কৃষক আয় করতে না পারাসহ নানা কারণ কৃষি উৎপাদনে প্রভাব ফেলছে। আর তাতে গত কয়েক বছর দেশের কৃষি খাত এক প্রকার অচলায়তনে রূপ নিয়েছে বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। এ পরিস্থিতি চলতে থাকলে বড় ধাক্কা লাগতে পারে দেশের খাদ্য ব্যবস্থাপনায়।
যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে দেশে ধানের আবাদ হয়েছিল ১ কোটি ১৭ লাখ ৯০ হাজার হেক্টর জমিতে। ২০২০-২১ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়ায় ১ কোটি ১৫ লাখ হেক্টরে। আর সর্বশেষ ২০২৪-২৫ অর্থবছরে আবাদকৃত জমি ১ কোটি ১৪ লাখ হেক্টরে নেমে আসে। অর্থাৎ সর্বশেষ পাঁচ বছরে আবাদকৃত জমির পরিমাণ কমেছে প্রায় ২ শতাংশ। এভাবে প্রতি বছরই কৃষিজমির পরিমাণ কমছে। এর বিপরীতে পাঁচ বছরে হেক্টরপ্রতি ফলন বেড়েছে কেবল ৪ শতাংশ। আর চাল উৎপাদন মাত্র ২ শতাংশ বেড়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের দুই-তিন ফসলি জমি নানাভাবে অকৃষিকাজে ব্যবহার হচ্ছে। অথচ আইনে কৃষিজমিকে অন্য কাজে ব্যবহারের সুযোগ নেই। কিন্তু সে আইনের কোনো বাস্তবায়ন দেখা যাচ্ছে না। আর কৃষকের ন্যায্যমূল্যও বাজারের ওপর ছেড়ে দিলে হবে না। সরকারকে উদ্যোগী হয়ে মূল্যসহায়তা দিতে হবে। কেননা সিন্ডিকেটের সঙ্গে কৃষক পেরে ওঠেন না। এতে পরের বছর একই পণ্য উৎপাদনের উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন তারা।
দেশের কৃষিজমির বিভিন্ন রূপান্তর ও জনপ্রতি এর পরিমাণ নিয়ে গবেষণা করেছিলেন কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম। তার গবেষণায় কৃষিশুমারির তথ্য বিশ্লেষণ করে বলা হয়েছে, ২০০৮ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত সময়ে প্রতি বছর গড়ে মোট জমির দশমিক ২১ শতাংশ হারে কৃষিজমি কমেছে। অন্যদিকে ১৯৯৬ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত জমি কমেছে দশমিক ৭৪ শতাংশ হারে। আর ১৯৮৪ থেকে ১৯৯৬ সালে প্রতি বছর দশমিক ৯৭ শতাংশ হারে কমেছে কৃষিজমি। অর্থাৎ উল্লেখিত ৩৫ বছর গড়ে কৃষিজমির পরিমাণ কমেছে প্রায় দশমিক ৩৫ শতাংশ হারে।
এ বিষয়ে জাহাঙ্গীর আলম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমাদের আইন রয়েছে কৃষিজমি অন্য কাজে ব্যবহার করা যাবে না। কিন্তু এ আইনের কোনো প্রয়োগ নেই। এটা বাস্তবায়ন করতে হবে। আমাদের দুই বা তিনফসলি জমি যেন কৃষির বাইরে না যায় সেটা নিশ্চিত করা জরুরি। আমাদের নদীভাঙন, ইটভাটা ও নতুন রাস্তাঘাটে অনেক কৃষিজমি হারিয়ে যাচ্ছে। তাই রাস্তার পাশের জমি এবং জেলা-উপজেলায় বিভিন্ন সরকারি বাংলোয় সবজি চাষের উদ্যোগ নিতে হবে।’
উত্তরের জেলা দিনাজপুরকে বলা হয় দেশের শস্যভাণ্ডার। জেলার অধিকাংশ জমি দুই ও তিনফসলি। রয়েছে চারফসলি জমিও। তবে গত কয়েক বছর কৃষিজমিগুলোকে গিলে খাচ্ছে আবাসন প্রকল্প। যত্রতত্র গড়ে উঠছে ইটভাটা ও কলকারখানা। এতে কমছে জমি ও ফসল উৎপাদন। এর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে কৃষকদের ওপর। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, জেলায় গত ছয় বছরে আবাদি জমি কমেছে ৩ হাজার ২৩২ হেক্টর।
কেবল দিনাজপুর নয়, পুরো দেশের চিত্রই এমন। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের আবাস ও ব্যবসাকেন্দ্রিক নতুন নতুন কার্যক্রমও চালু হচ্ছে। কোথাও আবার সরকারিভাবে রাস্তাঘাট হচ্ছে এবং বাস্তবায়ন হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের প্রকল্প। সরকারি প্রকল্পের ক্ষেত্রেও কৃষিজমি অধিগ্রহণ করা হয়। যদিও তিনফসলি জমিতে সরকারি প্রকল্প বাস্তবায়ন নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে খাতা-কলমে।
কৃষিজমি রক্ষায় যে আইন রয়েছে, সেটির বাস্তবায়ন নেই বলে সরকারি কর্মকর্তারা স্বীকারও করছেন। এ বিষয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (গবেষণা অনুবিভাগ) মো. আবু জুবাইর হোসেন বাবলু বণিক বার্তাকে বলেন, ‘কৃষিজমি সুরক্ষায় আমাদের আইন রয়েছে। কেউ যদি কৃষিজমির শ্রেণী পরিবর্তন করতে চায়, তাহলে জেলা প্রশাসকের অনুমোদন নিতে হয়। কিন্তু সে আইনের যথাযথ প্রয়োগ নেই। যার যখন খুশি কৃষিজমিতে বাড়ি বা শিল্প-কারখানা তুলে দিচ্ছে। এ চর্চা বন্ধ করার জন্য কী করণীয় সে বিষয়ে ভূমি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে ব্যবস্থা নেয়ার প্রক্রিয়া চলছে।’
দেশের ভূমির নির্দিষ্ট শ্রেণীবিন্যাস না থাকায় কৃষিজমির পরিমাণ কমছে বলে মনে করছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা। তাদের মতে, সারা দেশে একটি পূর্ণাঙ্গ ভূমি পরিকল্পনা থাকলে কৃষিজমি হ্রাসের পরিমাণ পর্যবেক্ষণে রাখা সম্ভব। এ বিষয়ে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মো. আশরাফুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বাংলাদেশের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও পৌরসভার নিয়ন্ত্রণে মাত্র ১০ শতাংশ ভূমির পরিকল্পনা রয়েছে। বাকি ৯০ শতাংশ ভূমি পরিকল্পনার বাইরে। যার যখন যেভাবে খুশি আবাসন বা শিল্প-কারখানা নির্মাণ করছে। এজন্য আমরা বারবার বলে আসছি, সারা দেশের ভূমি ব্যবহারের জন্য ন্যাশনাল ফিজিক্যাল প্ল্যান প্রয়োজন। আমাদের জনসংখ্যা বাড়ছে। কৃষিজমি কমছে, আরো কমবে। কিন্তু কতটুকু কমবে, কোথায় কমবে সে পরিকল্পনা প্রয়োজন। আমরা অবশ্যই তিনফসলি জমিতে আবাসন বা কারখানা করব না। আমরা একফসলি জমি প্রয়োজনে কনভার্ট করব।’
জলবায়ুর অভিঘাতের কারণেও কৃষিজমি কমছে বলে জানান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ফাহমিদা পারভীন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘দক্ষিণাঞ্চলের কৃষিজমিতে লবণাক্ততা নতুন সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। কমছে ফসলের উৎপাদন। এভাবে চলতে থাকলে অচিরেই বাংলাদেশের খাদ্যনিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে।’
কৃষিজমি কমার পাশাপাশি উৎপাদিত ফসলের ক্ষেত্রে কৃষকের লাভের পরিমাণও কমে আসছে। দেশে কৃষি উৎপাদনশীলতা ও প্রযুক্তিগত দক্ষতা নিয়ে সম্প্রতি এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)। তাতে উঠে আসে, কৃষি উপকরণের দাম বাড়ায় সাত বছরে দেশে কৃষির উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে প্রায় সাড়ে ৩ শতাংশ। একই সময়ে উৎপাদিত কৃষিপণ্যের দাম বেড়েছে ১ দশমিক ৩১ শতাংশ। ফলে কৃষি খাতে মুনাফা কমেছে। এছাড়া ২০১১-২০ সালের মধ্যে মাটির অবক্ষয় এবং অযাচিত কৃষি পদ্ধতির কারণে জমির উর্বরতা দশমিক ৪৪ শতাংশ কমেছে বলে বিআইডিএসের অন্য এক গবেষণায় উঠে এসেছে।
কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় বছর বছর কৃষির প্রতি উৎসাহ হারাচ্ছেন কৃষক। গতবার আলুর ভালো দাম পাওয়ায় এবার লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১২ শতাংশ বেশি জমিতে এ ফসল চাষ করা হয়। উৎপাদন ব্যয় পড়েছে প্রতি কেজিতে প্রায় ১৫ টাকা। কিন্তু উৎপাদন ও ফলন ভালো হওয়ায় মৌসুমের শুরুতেই আলুর দাম পড়ে যায়। তাই খেতেই ১৩-১৪ টাকা কেজি দরে আলু বিক্রি করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন চাষীরা।
একই পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে ফুলকপিসহ মৌসুমি সবজিচাষীদের। এবার রবি মৌসুমে ফুলকপির ফলন ভালো হয়েছিল। কিন্তু কৃষক প্রতি পিসের দাম পেয়েছেন মাত্র ২-৩ টাকা। অথচ খরচ হয়েছে ১০ টাকার বেশি। মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া উপজেলার আইরমারা গ্রামে কৃষক বশির আহমেদ জানান, প্রতি পিস ফুলকপির চারা আড়াই-তিন টাকা দরে কিনতে হয়েছে। জমিতে হালচাষ, কীটনাশক, সার, ভিটামিন ও দিনমজুরের পেছনেও খরচ করতে হয়েছে। সবকিছুর পর প্রতি পিস কপি বিক্রি করতে হয় ২-৩ টাকা। এজন্য অনেক কৃষক কপি কেটে খেতেই ফেলে দেন। কেউবা আবার গরুকে খাইয়েছেন।
দাম না পাওয়ায় পরের বছর সেই পণ্য কম আবাদ করেন কৃষক। তাই প্রথাগতভাবেই পরের বছর আবার দাম বেড়ে যায়। আর এতে ক্রেতাদের নাভিশ্বাস উঠে গেলেও সরকারের পক্ষ থেকে তেমন কিছু করা হয় না। অথচ কৃষি বিপণন আইন ২০১৮ ও জাতীয় কৃষি বিপণন নীতি অনুযায়ী কৃষকের ন্যায্য প্রাপ্য নিশ্চিত করা এবং বাজারে পণ্যের ন্যায্যমূল্য ঠিক রাখার আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু ভোক্তা কিংবা কৃষক কারো পাশেই পাওয়া যায় না কৃষি বিপণন অধিদপ্তরকে।
বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, কৃষি বিপণনের প্রথম দায়িত্ব কৃষিকের স্বার্থ রক্ষা, তারপর ক্রেতার—দুদিকেই দেখার কথা। কিন্তু দাম বাড়ার পর হইচই শুরু হলে মাঠে দেখা যায় তাদের। অথচ দাম কমে গেলেও কৃষকের জন্য ন্যায্যমূল্য ঘোষণা করা সংস্থাটির দায়িত্ব। কৃষকদের কিছুটা মূল্য সহায়তা না দিলে সার্বিক উৎপাদন কমে যাবে।
এ বিষয়ে মূল্য সহায়তা বা কেজিতে কৃষকপর্যায়ে নগদ অর্থ সহায়তা দেয়ার প্রস্তাব ড. জাহাঙ্গীর আলমের। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘দাম বেড়ে গেলে নানা তোড়জোড় শুরু হলেও দাম পড়ে যাওয়ার পর কোনো উদ্যোগ নেয়া হয় না। কিন্তু এক্ষেত্রে সরকার ন্যূনতম দাম ঘোষণা করে দিতে পারে। কিংবা নগদ সহায়তা দিতে পারে।’
এদিকে দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের নিচে নেমে এসেছে চালের উৎপাদন প্রবৃদ্ধির হার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিস্টিকসের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে দেশে বার্ষিক জনসংখ্যার স্বাভাবিক বৃদ্ধির হার (আরএনআই) ছিল ১ দশমিক ৩৩ শতাংশ। আগের বছর ১ দশমিক ৪ শতাংশ ছিল। এছাড়া আন্তঃশুমারি অনুযায়ী, গড় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১ দশমিক ১২ শতাংশ। অন্যদিকে কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য বিশ্লেষণে উঠে এসেছে, গত তিন অর্থবছরে দেশে চালের উৎপাদন প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১ শতাংশের নিচে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে চালের উৎপাদন হয়েছিল ৩ কোটি ৮৬ লাখ টন। আগের অর্থবছরেও একই পরিমাণ চাল উৎপাদন হয়। ২০২১-২২ অর্থবছরে খাদ্যশস্যটির মোট উৎপাদন দাঁড়ায় ৩ কোটি ৮৯ লাখ টনে। প্রবৃদ্ধির হার ছিল দশমিক ৭৮ শতাংশ। এরপর ২০২২-২৩ অর্থবছরে মাত্র দশমিক ২৬ শতাংশ বেড়ে চালের উৎপাদন দাঁড়ায় ৩ কোটি ৯০ লাখ টনে। প্রতিবারই দেশে চালের উৎপাদন হয়েছে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় কম।
চালের উৎপাদন প্রবৃদ্ধি এ মাত্রায় শ্লথ হয়ে আসার পেছনে বিশেষজ্ঞরা দায়ী করছেন উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি ও ধানের কাঙ্ক্ষিত মূল্য না পাওয়াকে। এ কারণে কৃষক অন্য ফসলে ঝুঁকছেন। অনেকে আবার কৃষিই ছেড়ে দিচ্ছেন।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে কৃষি সচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমরা হয়তো নগদ টাকা দিয়ে এটা সমাধান করতে পারব না। তবে কৃষকের স্বার্থ দেখার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নিচ্ছি। এখানে চাহিদা ও সরবরাহের ভারসাম্য ঠিক রাখাটা গুরুত্বপূর্ণ। কৃষকের পণ্য সংরক্ষণের জন্য আমরা সারা দেশে ১০০ মিনি কোল্ড স্টোরেজ তৈরি করছি। পেঁয়াজ সংরক্ষণে ছোট সংরক্ষণাগার করা হচ্ছে। মাত্র ৩৫-৪০ হাজার টাকায় বাড়িতেই কৃষক এটা তৈরি করতে পারবেন। আমরা এখানে সহায়তা দেব। এটার মাধ্যমে ছয়-সাত মাস পেঁয়াজ সংরক্ষণ করা যাবে। এবার আলুর উৎপাদন অনেক হয়েছে। তাই আমরা আলু রফতানির জন্য রফতানিকারকদের সঙ্গে বসেছি। তাদের সমস্যা দূর করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। তাছাড়া শাকসবজির জন্য কৃষক পর্যায়ে হিমাগার নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।’