
AbūSamīhah Sirājul-Islām (আবুসামিহা সিরাজুল ইসলাম)
আব্দুর রাজ্জাক সাহেব ইন্তিকাল করেছেন; আল্লাহর তাঁকে মাফ করুন, তাঁর ভাল কাজ কবূল করুন ও তাঁকে জান্নাত দান করুন।
ব্যরিস্টার আব্দুর রাজ্জাক সাহেব জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ছিলেন। পরে তিনি জামায়াত থেকে পদত্যাগ করেছিলেন ও আবা পার্টির অভিভাবক হয়েছিলেন। তাঁর সাথে একাধিকবার বিভিন্ন উপলক্ষে সাক্ষাৎ হয়েছে, তাঁর আলোচনাও আমি শুনেছি, আবার তাঁর সাথে একত্রে আমি ইয়ুথ অনুষ্ঠানে আলোচনাও করেছি।
তাঁর ব্যাপারে আমার প্রথম পাবলিক পারসেপশন যেটা হয়েছিল সেটা ছিল ১৯৯৬ এর জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। তখন এত এত ইন্টারনেটের প্রচলন ছিল না। আন্তর্জাতিক সংবাদের জন্য আমাদেরকে বিবিসি (BBC), ভয়েস অফ আমেরিকা (VoA), ইত্যাদি রেডিও চ্যানেলগুলোর উপর বেশি নির্ভর করতে হত। সে নির্বাচনে তিনি জামায়াতে ইসলামীর স্পোকস-পারসন ছিলেন। ভোয়ার সাথে তিনি একটা সাক্ষাৎকার দেন তখন। সে সাক্ষাৎকার শুনে আমার বেশ অসন্তোষ হয়। তখন আমার যা মনে হয়েছে তা হল তিনি একজন পলিটিলিকালী নাইভ (Naive) ব্যক্তিত্ব। (কেউ আবার এমন ভাববেন না যে আমি নিজেকে ঝানু পলিটিশিয়ান মনে করি; আমিও নিজেকে পলিটিক্যালী নাইভ মনে করি। সে জন্য কোন পার্টির স্পোক্সপার্সন হই না)। তাঁর জীবনের শেষ দিকের সিদ্ধান্তগুলো আমার সে পারসেপশনকে শুধূ সাবিতই করেছে মাত্র।
অন্যদিকে তিনি অবশ্যই আইনী বিষয়ে দক্ষতা রাখতেন। কিন্তু সেটাও কিছু লিমিটেড বিষয়ে। সমস্যা যেটা হয়েছে সেটা হল ওনার নাইভিটির সুযোগ নিয়ে বৃটিশ এবং আমেরিকানরা উনাকে পাম্প দিয়ে বুঝিয়েছে যে উনি হচ্ছেন বাংলাদেশের বেস্ট লিগ্যাল মাইন্ড। উনি নিজে আমাদের সাথে একটা অনুষ্ঠানে বলেছেন যে আমেরিকান সরকারী নেতাদের সাথে এক বৈঠকে তাঁরা নাকি তাঁকে বলেছে, "We've learned that you're the best legal mind in Bangladesh." । আমার মনে হয়েছে তাদের একথায় আস্থা রেখে তিনি হয়তো আসলেই বিশ্বাস করতেন যে তিনি হচ্ছেন বাংলাদেশের বেস্ট লিগাল মাইন্ড।
তাঁর একটা ভাল দিক ছিল যে তিনি বৃটিশ জীবন পরিত্যাগ করে বাংলাদেশে চলে এসেছিলেন। একটা ইসলামী আন্দোলনের কাজে নিজেকে ডেডিকেটেড করেছিলেন। তাঁর বেশ কিছু আলোচনায় আমার মনে হয়েছিল তিনি ইসলামী আন্দোলনের কন্সেপ্টকে ঔন করেন এবং জেনুইনলী চাইতেন আমাদের সমাজের ইসলামিক পরিবর্তন হোক। কুরআনকেও তিনি গভীরভাবে অধ্যয়ন করতেন এবং এর মোটামুটি ভাল সমঝ অর্জন করেছিলেন। সূরা ফাতহের (৪৯ নং সূরা) একটা অংশের দারস তিনি দিয়েছিলেন, যা আমার কাছে ঐ সূরার একটা অংশের নতুন দ্বারোন্মোচন করেছিল।
আব্দুর রাজ্জাক সাহেব পাশ্চাত্যে মুসলিম অভিজ্ঞতা তাঁর বৃটেনে থাকার অভিজ্ঞতার লেন্স দিয়ে দেখতেন। ফলে আমাদের ইয়ুথ মেয়েদের এক অনুষ্ঠানে তিনি যে আলোচনা করছিলেন তাঁকে আমার কাছে আমেরিকান কন্টেক্সটে খুব যুতসই মনে হয় নি। মুসলমান অথবা যে কোন অভিবাসীদের আম্রিকান এবং বৃটিশ এক্সপেরিয়েন্স এক না। এগুলোর কনটেক্সট ভিন্ন। তিনি সেটা সম্ভবত খুব ভালভাবে উপলব্ধি করতে পারেন নি।
তিনি জেনুইনলি চাইতেন বাংলাদেশের ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের জীবনে কষ্টের মাত্রা কমে গিয়ে সহজতা আসুক। তাই তিনি মনে করতেন জামায়াতের অনেক কিছুতে পরিবর্তন করা দরকার। তাঁর এই বোধকে এবং তাঁর নাইভিটির সুযোগ গ্রহণ করেছে মুজিব মঞ্জু গং। এরপর এরা জামায়াতের ভেতরে থেকেই জামায়াতকে ভাঙার ষড়যন্ত্র শুরু করে। তারা বিভিন্ন জায়গায় – দেশে এবং বিদেশে – জামাতের কর্মী ও শুভাকাংখীদের নিয়ে গোপন বৈঠক ও আলোচনা করে নতুন দল করার পাঁয়তারা করতে থাকে। তারা আব্দুর রাজ্জাক সাহেবকে এ ক্ষেত্রে ভালভাবেই কাজে লাগাতে সক্ষম হয়। মজার বিষয় হল এ নতুন দলের উদ্যোক্তারা আমার কাছে তাদের দলের এই উদ্যোগের কথা কখনো বলার সাহস করে নি।
আমি একবার নিউ ইয়র্ক শহর থেকে প্রায় দেড়শ মাইল দূরে ড্রাইভ করছিলাম। হাইওয়েতে থাকা অবস্থায় হঠাৎ আমার এক অস্ট্রেলিয়ান দোস্তের কাছ থেকে ফোন আসল। আমরা মালয়েশিয়াতে IIUM-এ একসাথে পড়তাম। তিনি অস্ট্রেলিয়ার জামায়াত ঘরানার সংগঠনের বেশ বড়সড় দায়িত্বশীল। গাড়ি চালানো অবস্থায়ই আমি ফোন রিসিভ করলাম হ্যাণ্ডস ফ্রী সিস্টেম থাকার কারণে। তাঁর কাছে যা শুনলাম তা হল সেই নতুন পলিটিক্যাল ইনিশিয়েটিভের কথা এবং আব্দুর রাজ্জাক সাহেব তাঁর সাথে এ বিষয়ে আলাপ করেছেন জানালেন। মনে হল তিনি বেশ কনভিন্সড। তিনি আমার অভিমত চাইলেন। আমি আমার অভিমত দিলাম এবং আব্দুর-রাজ্জাক সাহেবের কনসার্নের সাথে একমত পোষণ করলেও তাদের নতুন পলিটিকাল ইনিশিয়েটিভকে প্রত্যাখ্যান করলাম।
আব্দুর রাজ্জাক সাহেব তাঁর পলিটিক্যাল নাইভিটির প্রমান আবার দেন তখন যখন তিনি জামায়াত থেকে পদত্যাগ করেন। তিনি পার্টি থেকে পদত্যাগ করতেই পারেন; কিন্তু যে কারণ তিনি এক মিডিয়া সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেন তা আবার তাঁর রাজনৈতিক নাইভিটিকে প্রকাশ করে। তিনি বলেন যে তিনি জামায়াতে ইসলামীতে এসেছিলেন জামায়াতকে পরিবর্তন করার জন্য; কিন্তু যেহেতু তিনি জামায়াতকে পরিবর্তন করতে পারেন নাই তাই পদত্যাগ করছেন। এটা খুবই নাইভ একটা কারণ। আপনি জামায়াতে যোগ দেন জামায়াতের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যকে গ্রহণ করে এগুলো বাস্তবায়ন করার জন্য এবং সে অনুযায়ী নিজেকে ঢেলে সাজানোর জন্য। দলকে পরিবর্তন করার জন্য না। তিনি হয়তো বুঝাতে চেয়েছিলেন ভাল কিছু, কিন্তু তাঁর পলিটিকাল নাইভিটি তাকে সে বিষয়টা ভালভাবে এক্সপ্রেস করতে দেয় নি।
তিনি শেষ দিকে মঞ্জুদের চালাকী সম্পর্কে হয়তো অবগত হয়েছিলেন এবং তাদের পার্টির প্রধান উপদেষ্টার পদ ছেড়ে দিয়েছিলেন। আমার বিশ্বাস এটা তাঁর ইসলামী আন্দোলনে কমিটমেন্টের কারণে। তিনি জামায়াতের নাম ও কিছু স্ট্র্যাটেজি বদলের পক্ষে ছিলেন, কিন্তু ইসলামী আন্দোলনের স্পিরিট পরিত্যাগের পক্ষের ছিলেন না। তিনি মনে করতেন আল্লাহ তাʿআলা দীনের ক্ষেত্রে কোন হারজ রাখেন নি (ওয়ামা জাʿআলা আলায়কুম ফি আদ্দীনি মিন হারজ)। সে জন্য তিনি নাম ও স্ট্র্যাটেজি পরিবর্তনে বিশ্বাস করতেন।
পরে তিনি হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন আবা পার্টি মূলত ইসলামী আন্দোলনের স্পিরিট পরিত্যাগকারী নয়া সেকুলার দল। সে জন্য তিনি তাদের সঙ্গ ত্যাগ করেছেন।
মুশকিল হল এ সমস্ত হাই-প্রোফাইল নেতাদের দলত্যাগের বিষয়টা খুবই ক্ষতিকর একটা বিষয়। এঁদের দলত্যাগ শুধুমাত্র একজন ব্যক্তির দলত্যাগই না। এঁদের কারণে ইসলামী আন্দোলনে কর্মীদের একটা বিরাট অংশের মাঝে হতাশা আসে। তাই তাঁরা এর জন্য রেস্পন্সিবল। আমার কথা হচ্ছে, আপনি আন্দোলনের আচ্ছামত ক্রিটিক করুন, এমন কি আপনাকে যদি আন্দোলনের ভেতর থেকে অপসন্দ করা হয় তারপরও। আর আন্দোলনকে ঔন করার কারণে আপনার সে আধিকার আছে। আমি নিজেও হয়তো সমালোচকদের দলভূক্ত। কিন্তু আপনি আন্দোলন ত্যাগ করে একটা রং মেসেজ দেবেন না।
এজন্য দলত্যাগকারীদের প্রতি আমি কখনোই সহানুভূতিশীল না, যদিও তাদের অনেকের জন্য কল্যাণের দুʿআ করা আমি ছেড়ে দেই না। এর আলোকে আমি শিবির ছেড়ে ইসলাম প্রতিষ্ঠার আন্দোলন বাদ দিয়ে নতুন নতুন দল প্রতিষ্ঠাকারীদেরকেও ভাল পাই না।
আল্লাহ আব্দুর রাজ্জাক সাহেবের সব ভাল কাজ কবূল করে তাঁকে মাফ করুন। তাঁকে জান্নাত দান করুন।