Image description

মানিক আবদুল্লাহ নামে যুবদলের এক কর্মী প্রতিবেশীর বাড়িতে রাতের খাবার খেতে বসেছিলেন। পাশে ছিলেন তাঁর এক সঙ্গী। এমন সময় টিনের ছাউনির ঘরটিতে ঢুকে পড়েন চার–পাঁচজন যুবক। সবার হাতে আগ্নেয়াস্ত্র। ঘরে ঢুকেই তাঁরা মানিককে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে শুরু করেন। মানিকের মৃত্যু হয় ঘটনাস্থলেই। তাঁর সঙ্গী পালিয়ে যেতে সক্ষম হন।

ঘটনাটি ঘটে গত ১৯ এপ্রিল রাতে চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার বাগোয়ান ইউনিয়নের গরিব উল্লাহ পাড়ায়। লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে হত্যার এই ঘটনাকে ‘প্রতিশোধের খুন’ বলছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। পুলিশেরও ধারণা, প্রতিপক্ষের এক সন্ত্রাসীকে ধরিয়ে দিতে সহায়তা করায় মানিককে খুন করা হয়েছে।

মানিককে হত্যার দুই দিন পর (২২ এপ্রিল) দুপুরে আবারও রাউজানে খুনের ঘটনা ঘটে। উপজেলার সদর ইউনিয়নের শমসের নগরের গাজীপাড়ায় মুহাম্মদ ইব্রাহিম (৩০) নামের এক যুবককে গুলি করে হত্যা করা হয়।

ইব্রাহিম যুবদলের কর্মী। তিনি বাড়ির কাছেই রাস্তার পাশে চায়ের দোকানে বসে ছিলেন। এমন সময় তিনটি অটোরিকশায় ১০ থেকে ১২ যুবক এসে ইব্রাহিমের মাথার পেছন দিকে, কোমরে এবং ঊরুতে তিন-চারটি গুলি করেন। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় তাঁর। খুন করে নির্বিঘ্নে এলাকা ছাড়ে সন্ত্রাসীরা।

রাউজানে এই খুন, পাল্টা খুন নতুন নয়। রাউজানের বাসিন্দা, স্থানীয় রাজনীতিবিদ ও পুলিশ সূত্র বলছে, খুনোখুনি চলছে প্রায় চার দশক ধরে। এতে মোট কতজন নিহত হয়েছেন, তার পূর্ণাঙ্গ হিসাব পাওয়া যায় না। তবে সংখ্যাটি ১০০ থেকে ১১০ জন হতে পারে ধারণা তাঁদের।

চট্টগ্রামের রাউজানে এভাবে খুন, পাল্টা খুন চলছে। গত বছরের ৫ আগস্ট জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রাউজান উপজেলায় এখন পর্যন্ত খুন হয়েছেন ১২ জন। এর মধ্যে সাতজন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী। গুলিবিদ্ধ, জখম ও অন্যান্যভাবে আহত হয়েছেন অনেকে।

রাউজানে এই খুন, পাল্টা খুন নতুন নয়। রাউজানের বাসিন্দা, স্থানীয় রাজনীতিবিদ ও পুলিশ সূত্র বলছে, খুনোখুনি চলছে প্রায় চার দশক ধরে। এতে মোট কতজন নিহত হয়েছেন, তার পূর্ণাঙ্গ হিসাব পাওয়া যায় না। তবে সংখ্যাটি ১০০ থেকে ১১০ জন হতে পারে ধারণা তাঁদের। এর বাইরে অনেকেই পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন।

গুলি, হামলা, পাল্টা হামলা—এসব রাউজানের নিত্যদিনের ঘটনা। যখন কোনো একটি পক্ষের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন খুনোখুনি কমে। যখন নিয়ন্ত্রণ অন্য কোনো পক্ষ নেওয়ার চেষ্টায় থাকে, তখন খুনোখুনি বেড়ে যায়। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর রাউজানের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিএনপির দুই পক্ষের দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে। আট মাসে রাজনৈতিক খুনের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে যুবদলের তিনজন (কমর উদ্দিন, ইব্রাহিম ও মানিক আবদুল্লাহ) এবং আওয়ামী লীগের চারজন (আবদুল মান্নান, মুহাম্মদ ইউসুফ মিয়া, আবু তাহের ও মুহাম্মদ হাসান)। এর বাইরে একজন ব্যবসায়ীকে (জাহাঙ্গীর আলম) খুন করা হয়েছে। যাঁদের আসামি করা হয়েছে, তাঁরা স্থানীয় বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত।

বারবার খুন ও রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনায় রাউজানের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে গত আট মাসে রাউজান থানা–পুলিশের তিনজন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) বদলি করা হয়েছে। কিন্তু পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি।

রাউজানের এক প্রবীণ বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, রাউজানে উপজেলা প্রশাসন অথবা পুলিশ প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ নেই বললেই চলে। এখানে বহু বছর ধরে ব্যক্তির শাসন চলে। ব্যক্তি বদলান, নতুন আরেকজন আসেন, সন্ত্রাস কমে না।

আট মাসে রাজনৈতিক খুনের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে যুবদলের তিনজন (কমর উদ্দিন, ইব্রাহিম ও মানিক আবদুল্লাহ) এবং আওয়ামী লীগের চারজন (আবদুল মান্নান, মুহাম্মদ ইউসুফ মিয়া, আবু তাহের ও মুহাম্মদ হাসান)। এর বাইরে একজন ব্যবসায়ীকে (জাহাঙ্গীর আলম) খুন করা হয়েছে। যাঁদের আসামি করা হয়েছে, তাঁরা স্থানীয় বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত।

শুরু আশির দশকে

চট্টগ্রামের ১৫টি উপজেলার একটি রাউজান। উপজেলা প্রশাসনের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য বলছে, রাউজানের আয়তন ২৪৩ বর্গকিলোমিটার। সেখানে ৩ লাখ ২৫ হাজার মানুষের বাস। উপজেলার ১৪ ইউনিয়ন এবং পৌরসভায় নিয়মিত হামলা-পাল্টা হামলার ঘটনা ঘটছে। চট্টগ্রামে দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তাদের দাবি, জেলার রাউজানে রাজনৈতিক সহিংসতা ও সন্ত্রাসের ঘটনা বেশি। এর পরের অবস্থান ফটিকছড়ির।

রাউজানে সন্ত্রাসের কারণ ও ইতিহাস জানতে প্রবীণ চারজন রাজনীতিবিদ, স্থানীয় বাসিন্দা, রাউজানে দায়িত্ব পালন করা পুলিশ কর্মকর্তাসহ অনেকের সঙ্গে কথা বলেছেন এই প্রতিবেদক। তাঁরা কেউ নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি। তাঁদের কাছ থেকে জানা যায়, রাজনৈতিক সহিংসতা শুরু হয়েছে এরশাদ আমলে, আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে। ওই সময় রাউজানের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছিল বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পরিবার ও তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল্লাহ আল হারুনের অনুসারীদের মধ্যে। মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয় ২০১৫ সালে। আবদুল্লাহ আল হারুন মারা যান ২০০৪ সালে। তিনি বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমানের ভাই।

স্বাধীনতার আগে থেকে রাউজানে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ছিল সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পরিবার। তাঁর পিতা ফজলুল কাদের চৌধুরী ছিলেন পাকিস্তানের স্পিকার ও ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি। তবে বাঙালিদের স্বাধীনতার দাবির বিরোধিতা ও অপরাধের অভিযোগে তাঁকে মুক্তিযুদ্ধের পর আটক করা হয়। মৃত্যু হয় কারাগারে।

আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের কারণে বিভিন্ন এলাকায় সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর লোকেরা ঢুকতে পারতেন না। দুই পক্ষই আগ্নেয়াস্ত্র ও দেশীয় ধারালো অস্ত্র ব্যবহার করত। সেই যে খুনোখুনি শুরু হলো, তা আর বন্ধ হয়নি।

১৯৭৯ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রামের রাউজান, ফটিকছড়ি ও রাঙ্গুনিয়া থেকে মুসলিম লীগের প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করেছিলেন সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী। রাউজান থেকে নির্বাচিতও হয়েছিলেন তিনি। এরপর ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে জাতীয় পার্টি থেকে নির্বাচন করে তিনি আবার সংসদ সদস্য হন। একপর্যায়ে জাতীয় পার্টি ছেড়ে দিয়ে তিনি গঠন করেছিলেন ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এনডিপি)।

শুরু থেকে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠে আওয়ামী লীগ। ওই সময় রাউজানে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ নিয়ে একের পর এক খুনের ঘটনা ঘটে। বেশ কয়েকটি খুনের ঘটনা চট্টগ্রামসহ সারা দেশে আলোচিত হয়েছিল। সেগুলোর সঙ্গে এনডিপির ছায়ায় থাকা সন্ত্রাসীরা জড়িত ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে।

১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাউজান থেকে এনডিপির হয়ে নির্বাচন করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী। পরে তিনি বিএনপির রাজনীতিতে যোগ দেন।

সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আবদুল্লাহ আল হারুনের বাড়ি রাউজানের গহিরা এলাকায়। স্থানীয় লোকজন বলছেন, দুজনের রাজনৈতিক প্রভাব বাড়ানোর দ্বন্দ্ব থেকে রাউজানে খুনোখুনি শুরু হয়। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের কারণে বিভিন্ন এলাকায় সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর লোকেরা ঢুকতে পারতেন না। দুই পক্ষই আগ্নেয়াস্ত্র ও দেশীয় ধারালো অস্ত্র ব্যবহার করত। সেই যে খুনোখুনি শুরু হলো, তা আর বন্ধ হয়নি।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর ধীরে ধীরে রাউজানের একক নিয়ন্ত্রণ চলে যায় সেখানকার সংসদ সদস্য এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরীর কাছে। তিনি সালাউদ্দিন কাদেরের চাচাতো ভাই। ছিলেন এনডিপির নেতা।

অনেক সময় অস্ত্র পাচারের রুট হিসেবে ব্যবহৃত হয় রাউজান। এসবের নিয়ন্ত্রণ নিতেই স্থানীয় পর্যায়ে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়।

রাউজানের একজন রাজনীতিবিদ নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, রাউজানে যাঁর নিয়ন্ত্রণ বেশি, তিনিই ভোটে জিততেন। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর সঙ্গে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা পারছিলেন না। এ জন্য দলের কেন্দ্রীয় একজন নেতার সহায়তায় এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরীকে দলে ভেড়ায় আওয়ামী লীগ। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে তাঁকে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। যদিও তিনি জিততে পারেননি। অবশ্য নিজের প্রভাব বাড়িয়ে ২০০১ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংসদ সদস্য হন তিনি। এরপর ফজলে করিম চৌধুরী চট্টগ্রাম-৬ (রাউজান) আসন থেকে ২০০৮ এবং পরের তিনটি বিতর্কিত নির্বাচনে (২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪) আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংসদ সদস্য হন।

২০০৮ সাল থেকে গত আগস্ট পর্যন্ত রাউজান চলেছে মূলত ফজলে করিম চৌধুরীর কথায়। তাঁর বিরুদ্ধে কথা বলার মতো কেউ ছিল না। অভিযোগ রয়েছে, শুধু বিরোধী দল নয়, নিজের দলের বিরুদ্ধ মতের নেতা-কর্মীদেরও এলাকাছাড়া করেছেন তিনি। তাঁর ৭০ থেকে ৮০ জনের একটি বাহিনী ছিল। তাঁর পছন্দের লোক ছাড়া কেউ স্থানীয় সরকার নির্বাচনে জনপ্রতিনিধি হতে পারতেন না। দুর্নীতি, অনিয়মের অভিযোগ ব্যাপক।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর কিছুদিন আত্মগোপনে ছিলেন ফজলে করিম। পরে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। বর্তমানে তিনি কারাগারে।

এখন দ্বন্দ্ব বিএনপির দুই নেতার

রাউজানের দক্ষিণ পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে দেশের অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ কর্ণফুলী নদী। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, যাঁর ক্ষমতা বেশি, তিনিই নদীকেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্য, বালুমহাল ও ইটভাটা, ইট-বালু সরবরাহের ব্যবসা, বিল ভরাটের কাজে মাটি-বালু সরবরাহের ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ করেন। পাহাড়ি সীমান্ত এলাকা হওয়ায় সেখান থেকে কাঠ ও মদ চোরাচালান হয়। অনেক সময় অস্ত্র পাচারের রুট হিসেবে ব্যবহৃত হয় রাউজান। এসবের নিয়ন্ত্রণ নিতেই স্থানীয় পর্যায়ে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়।

ফজলে করিম চৌধুরী আত্মগোপনে চলে যাওয়ার পরই তাঁর অনুসারীদের কাছ থেকে ব্যবসা-বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ চলে যায়। অন্যদিকে তাঁর (ফজলে করিম চৌধুরী) কারণে বিএনপির যেসব নেতা-কর্মী এলাকা ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন, তাঁরা ফেরা শুরু করেন।

স্থানীয় নেতা-কর্মীরা মূলত বিএনপির দুই নেতার অনুসারী। দুই নেতার একজন হলেন দলের ভাইস চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী, যিনি সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ছোট ভাই। অন্যজন উত্তর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক গোলাম আকবর খন্দকার। যুবদলের যে তিনজন খুন হয়েছেন, তাঁরা গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরীর অনুসারী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। এঁদের দুজন রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দেশে ফেরেন।

দেশে ফিরেছেন আরও কয়েকজন, যাঁরা একসময় এনডিপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং তাঁদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসে জড়িত থাকার বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। যেমন ১৮ বছর পর দেশে ফেরেন রাউজানের ডাবুয়া ইউনিয়নের মুহাম্মদ আজিজুল হক, যার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের ব্যাপক অভিযোগ ছিল। দেশে ফেরার পর আবার তাঁর বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ ওঠে। এক প্রবাসীর বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়ার মামলায় তাঁকে গত বছরের ২৪ নভেম্বর গ্রেপ্তার করে র‍্যাব।

আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীদের আশ্রয় দিচ্ছেন গোলাম আকবর খন্দকার। তাঁরাই আমার অনুসারী বিএনপি নেতা-কর্মীদের গুলি করে মারছে।
বিএনপি নেতা গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী

পুরোনোদের পাশাপাশি নতুন কয়েকজনের নাম রাউজানে আলোচিত হচ্ছে। তাঁদের একজন মো. রায়হান। সম্প্রতি রাউজানের শমসেরনগরের গাজীপাড়ায় মো. ইব্রাহিম নামে যুবদলের এক কর্মীকে খুনের ঘটনায় রায়হান সরাসরি জড়িত বলে অভিযোগ করেছে নিহতের পরিবার।

রাউজান থানার ওসি মনিরুল ইসলাম ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, পুরোনোদের মধ্যে কারা সক্রিয় হচ্ছেন, নতুন করে কারা অপরাধে জড়াচ্ছেন, তা নজর রাখা হচ্ছে। তালিকা করে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তাঁর ধারণা, ভৌগোলিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কারণে রাউজানে এমন পরিস্থিতি বিরাজ করে।

গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী ও গোলাম আকবর খন্দকার—দুজনই রাউজান থেকে বিএনপির মনোনয়নে আগামী নির্বাচনে প্রার্থী হতে চান। এর আগে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে জয়ী হয়েছিলেন গোলাম আকবর খন্দকার। তবে ওই বছরের জুনের নির্বাচনে মনোনয়ন পাননি তিনি। মনোনয়ন পেয়েছিলেন গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী। তিনি চাচাতো ভাই এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরীকে পরাজিত করেন সংসদ সদস্য হয়েছিলেন।

বিএনপি নেতা গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীদের আশ্রয় দিচ্ছেন গোলাম আকবর খন্দকার। তাঁরাই আমার অনুসারী বিএনপি নেতা-কর্মীদের গুলি করে মারছে।’ তিনি বলেন, ‘মারা যাচ্ছে সব আমার অনুসারী। এই বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাসহ প্রশাসনকে লিখিতভাবে জানিয়েছি।’

রাউজানের সার্বিক বিষয়ে আমরা তদন্ত করছি। যে তথ্য রয়েছে সব ভাসা ভাসা। সার্বিক তদন্ত শেষে জড়িত সে যেই হোক, দলীয়ভাবে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
চট্টগ্রাম বিভাগীয় সহসাংগঠনিক সম্পাদক মীর মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন

অন্যদিকে গোলাম আকবর খন্দকার বলেন, গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরীই পতিত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সন্ত্রাসীদের আশ্রয় দিচ্ছেন। আর রাউজানে যে খুনগুলো হচ্ছে, এগুলো অন্তর্দলীয় খুন। এখানে রাজনৈতিক কোনো গ্রুপিং (দলাদলি) নেই। তিনি বলেন, ‘আমার অনুসারী হিসেবে যে কথা বলা হচ্ছে, তা ঠিক নয়। আর রাউজানে এখন যা হচ্ছে, তা চাঁদাবাজির কারণে হচ্ছে। কে জায়গা দখল করবেন, চাঁদা নেবেন, তা নিয়ে চলছে এসব দ্বন্দ্ব। শুধু সাধারণ মানুষ নন, আমরাও যাঁরা রাজনীতি করি, তাঁরা সবাই আতঙ্কিত গ্রুপিং রাজনীতি নিয়ে।’

রাউজানে বিএনপির এই দুই নেতার দ্বন্দ্ব নিয়ে আলোচনা চলছে দলের ভেতরেও। গত ৩০ এপ্রিল গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী ও গোলাম আকবর খন্দকারকে দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে কারণ দর্শানোর (শোকজ) নোটিশ দিয়েছে বিএনপির কেন্দ্রীয় দপ্তর।

দলের চট্টগ্রাম বিভাগীয় সহসাংগঠনিক সম্পাদক মীর মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাউজানের সার্বিক বিষয়ে আমরা তদন্ত করছি। যে তথ্য রয়েছে সব ভাসা ভাসা। সার্বিক তদন্ত শেষে জড়িত সে যেই হোক, দলীয়ভাবে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

খুন হয়, সাজা হয় না

রাউজানে অনেক আলোচিত খুনের ঘটনা ঘটেছে, যেগুলোতে কারও সাজা হয়নি। মামলায় আসামিরা সবাই খালাস পেয়েছেন।

যেমন ১৯৮৯ সালের ৫ এপ্রিল রাউজানের আমির হাটে তৎকালীন চট্টগ্রাম উত্তর জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ফখরুদ্দিন মো. বাবর ও রাউজান কলেজ ছাত্র সংসদের সহসভাপতি (ভিপি) মুজিবুর রহমানকে গুলি করে ও কুপিয়ে খুন করা হয়। এর পেছনে এনডিপির কর্মীরা জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ ওঠে। তবে আলোচিত এই জোড়া খুনের ঘটনায় সব আসামি খালাস পেয়েছিলেন বলে নিহতের পরিবার সূত্রে জানা যায়।

১৯৯৩ সালে টিটু বিশ্বাস ও বিটু বিশ্বাস নামের দুই ভাই, ১৯৯৪ সালে ইকবাল হোসেন খোকন ও গিয়াস উদ্দিন জামিল দুজনকে, ১৯৯৯ সালে তৎকালীন উপজেলা ছাত্রলীগের (এখন নিষিদ্ধ ঘোষিত) সভাপতি দিদারুল আলমকে গুলি করে হত্যার ঘটনায়ও কারও শাস্তি হয়নি। মামলা হলেও রায়ে খালাস পেয়েছিলেন আসামিরা।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের সভাপতি মো. সাখাওয়াত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে অপরাধীরা পার পেয়ে যায়। এগুলো খুবই উদ্বেগজনক। রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে যেন কোনো অপরাধী ছাড়া না পায়, সেটি নিশ্চিত করলেই কেবল অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।

বিচারের আশা করেন না তাঁরা

রাউজানে রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে খুন হওয়া কয়েকজনের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা হয়েছে এই প্রতিবেদকের। সবাই বলছেন, হত্যাকাণ্ডের বিচার ও অপরাধীদের সাজা হবে, তা তাঁরা আশা করেন না।

রাউজানে গত ১৫ মার্চ কুপিয়ে খুন করা হয়েছিল যুবদলের কর্মী কমর উদ্দিনকে। তাঁর বাবা মো. আলী মিয়া ক্ষোভ প্রকাশ করে প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ছেলেকে যারা খুন করেছে, তাদের কয়েকজন আমিরহাট বাজারে এসে ঘোরাঘুরি করে। পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারল না।

রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে অপরাধীরা পার পেয়ে যায়। এগুলো খুবই উদ্বেগজনক। রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে যেন কোনো অপরাধী ছাড়া না পায়, সেটি নিশ্চিত করলেই কেবল অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের সভাপতি মো. সাখাওয়াত হোসেন

প্রতিবেশীর বাড়িতে ভাত খাওয়ার সময় গুলিতে খুন হওয়া যুবদলের কর্মী মানিকের বাড়িতে গত ২২ এপ্রিল গিয়ে দেখা যায়, পুরো এলাকায় থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। সবার মধ্যে আতঙ্ক। তাঁর বড় বোন নাছিমা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা মামলা করবেন না।

নাছিমা বলছিলেন, ‘আমাদের ভাইকে আর পাব না। আমরা কোনো মামলা–মোকদ্দমায় নেই। কারা মারছে, তা আল্লাহ জানে। আল্লাহের হাতে বিচার ছেড়ে দিলাম। আইন–আদালতে ছোটাছুটি করার সামর্থ্য, শক্তি, অর্থ—কোনো কিছুই নেই আমাদের।’