
র্যাবের মতো সোয়াট বাহিনী ছিল এক বিভীষিকার নাম। শেখ হাসিনার আমলে বিচারবহির্ভূত হত্যায় সোয়াটের ছিল প্রত্যক্ষ ভূমিকা। চরমপন্থা মোকাবিলায় এ বাহিনী গঠিত হলেও হাসিনার সরকার একে ব্যবহার করেছে রাজনৈতিক স্বার্থে। সোয়াট বিরোধী রাজনৈতিক কর্মীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ঘেরাও করে রাতে অভিযান পরিচালনা করেছে।
সোয়াট হচ্ছে স্পেশাল উইপন্স অ্যান্ড ট্যাকটিকস টিম। সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানের নামে ঢাকার বিশেষ পুলিশ ইউনিট কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের (সিটিটিসি) একটি বিশেষ দল। এই সোয়াট শেখ হাসিনার আমলে হয়ে উঠেছিল রাষ্ট্রের ‘জল্লাদ বাহিনী’। গ্রেপ্তার বা আইনি প্রক্রিয়ায় কাউকে বিচারের জন্য উপস্থাপনের পরিবর্তে অনেক মানুষের জীবনে ভয়ংকর পরিণতি বয়ে এনেছিল সোয়াট। কখনো তা করা হতো প্রকাশ্য সংঘর্ষের নামে, কখনোবা অপারেশন ক্লিনআপের আড়ালে।
পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারা বাহিনীটিকে মূলত তথাকথিত জঙ্গিবিরোধী অভিযানে নিয়ে জল্লাদের ভূমিকায় ব্যবহার করতেন। ওই পুলিশ কর্মকর্তাদের বেশিরভাগই এখন পলাতক। পালিয়ে যাওয়ার আগে দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময়ে রাষ্ট্রীয় এই বাহিনীকে জনসেবার বদলে করে গেছেন চরম বিতর্কিত।
২০১৬ সালের জাহাজবাড়ী অভিযান সোয়াটের ইতিহাসে অন্যতম বিতর্কিত ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত। সাজানো ওই অভিযানে ৯ তরুণকে ডিবি থেকে বিশেষ পোশাক পরিয়ে কল্যাণপুরের তাজ মঞ্জিলে (জাহাজবাড়ী নামে পরিচিত) নিয়ে ‘বন্দুকযুদ্ধে নিহত’ দেখানো হয়। নিহতদের পরিবারগুলোকে লাশও দেওয়া হয়নি। পুরো অভিযানে সোয়াট সদস্যরা মূল ভূমিকা পালন করেন।
পুলিশের অন্যান্য ইউনিটের সঙ্গে মূল ভূমিকা পালন করা সোয়াটের ওই তথাকথিত অভিযানে নিহত ৯ তরুণের মধ্যে একজন ছিলেন গার্মেন্টকর্মী মতিউর রহমান। তার বাবা সাতক্ষীরার পাটকেলঘাটা থানার ধানদিয়ে ইউনিয়নের ওমরপুর গ্রামের নাসির উদ্দিন। পেশায় তিনি একজন কৃষক। নাসির উদ্দিন আমার দেশকে বলেন, “আমার ছেলে জঙ্গি ছিল না। তাকে মারার পর পুলিশ আমাকে ঢাকায় নিয়ে গিয়েছিল। সেখানে ১৩-১৪ দিন আমাকে রেখে ওরাই বলেছিল ‘তোমার ছেলে জঙ্গি না’।”
এরপর ২০১৭ সালের মার্চে ঢাকার পান্থপথের হোটেল ওলিও ইন্টারন্যাশনালে সোয়াটের অভিযানে সন্দেহভাজন ব্যক্তির ‘আত্মঘাতী’ হওয়ার দাবি করা হয়। গাজীপুরের পাতারটেক অভিযানেও একই কৌশল দেখা যায়। সেখানে সন্দেহভাজনদের আত্মসমর্পণের কোনো সুযোগ না দিয়ে সরাসরি গুলি চালানো হয়। পরিবারের অভিযোগ, নিহতরা আগে থেকেই গুম অবস্থায় ছিলেন। একই ভাবে সিলেটের আতিয়া মহলে চার দিনব্যাপী অভিযানে আত্মসমর্পণের সুযোগ না দিয়ে ভারী অস্ত্র ব্যবহারের সিদ্ধান্ত সোয়াটের কৌশলগত ব্যর্থতা হিসেবে চিহ্নিত হয়, যেখানে সোয়াট সদস্যসহ নিরাপত্তা বাহিনীর লোকজনও প্রাণ হারান।
চট্টগ্রামের আকবর শাহ এলাকার অভিযানে সরাসরি গুলি চালানো হয় এবং নিহতদের পরিচয় যাচাই না করার অভিযোগ ওঠে। মৌলভীবাজারের নাসিরপুরেও দিনের পর দিন চলা অভিযানে আত্মসমর্পণের সুযোগ দেওয়া হয়নি এবং বিস্ফোরণে নারী ও শিশুর প্রাণহানি ঘটে।
রাজশাহী ও বগুড়ায় তথাকথিত জঙ্গি দমন অভিযানে ছোট ঘর বা ফ্ল্যাট ঘিরে বিস্ফোরণ ও গুলি চালানো হয়, যেখানে নিহতদের পরিচয় নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়। অনেক ক্ষেত্রে নিহতরা নিরীহ ছাত্র বা ভুলভাবে অভিযুক্ত ব্যক্তি ছিলেন বলে পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়।
গুম থেকে ফিরে আসা তরুণ প্রকৌশলী মাসরুর আনোয়ার চৌধুরী আমার দেশকে বলেন, “বাংলাদেশে ‘জঙ্গি দমনের’ নামে গত দেড় দশকে যে ভয়াবহ দমন-পীড়ন চলেছে, তার কেন্দ্রে ছিল পুলিশ সদর দপ্তরের অধীন সিটিটিসি ও তাদের স্পেশাল অপারেশন বাহিনী সোয়াট। এদের হাতেই নির্বিচারে প্রাণ গেছে বহু নারী-পুরুষ ও শিশুর। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিহতদের পরিচয় অজানা থেকেছে। বিচার তো দূরের কথা, তদন্তও হয়নি। এই রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলো, বিশেষ করে সোয়াটকে এক ধরনের জল্লাদের ভূমিকায় অবতীর্ণ করেছিল তারা।”
সোয়াটের আইনি কাঠামো ও প্রশ্ন
সোয়াট মূলত সিটিটিসির একটি বিশেষায়িত ট্যাকটিক্যাল ইউনিট এবং এটি মূলত উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ অভিযান পরিচালনার জন্য গঠিত হয়েছিল। কিন্তু গ্রেপ্তার বা রিমান্ডে নেওয়ার ক্ষমতা তাদের নেই। তারপরও শেখ হাসিনার আমলে বিভিন্ন সাজানো অভিযানের সময় তারা বিচারবহির্ভূত হত্যায় প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করে।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শেখ ওমর বলেন, ‘ফ্যাসিস্ট হাসিনা বাংলাদেশের জনগণের প্রতি তার তীব্র ঘৃণার কারণে পুরো রাষ্ট্র কাঠামোকে ধ্বংস এবং রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলোকে কিলিং মেশিনারিতে পরিণত করেছিলেন। র্যাব আন্তর্জাতিকভাবে নিন্দিত ও কালো তালিকাভুক্ত হয়েছিল। সোয়াটকেও জল্লাদের ভূমিকায় নামানো হয়েছিল। সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের আত্মপক্ষ সমর্থনের ন্যূনতম সুযোগ না দিয়ে তাদের জীবন কেড়ে নেওয়া হতো। বিচারিক প্রক্রিয়াকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীগুলোকে এভাবে খুনোখুনিতে লিপ্ত করায় সাধারণ জনগণের মধ্যে বাহিনীগুলোর প্রতি চরম ভীতি ও অবিশ্বাস তৈরি হয়েছিল।’
সুপ্রিম কোর্টের আরেক আইনজীবী শাহরিয়ার মাহমুদ বলেন, ‘আওয়ামী লীগ আমলে এটি (সোয়াট) এক ধরনের রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন মেশিন হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল, যেখানে বিচার বা তদন্তের জায়গায় হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমেই সমাধান করা হতো।’
সোয়াটের রাজনৈতিক ব্যবহার : আন্দোলন ও বিরোধী মত দমন অভিযান নিয়ে বিতর্ক
আওয়ামী লীগ আমলে সোয়াট বাহিনীর অতিরিক্ত ও ভারী অস্ত্রের প্রদর্শন এবং রাজনৈতিক কর্মসূচিতে সক্রিয় উপস্থিতিÑ এই ইউনিটকে ঘিরে বিতর্ক আরো ঘনীভূত হয়েছিল। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে নয়াপল্টনে বিএনপি-পুলিশ সংঘর্ষে সোয়াটের উপস্থিতি ও হস্তক্ষেপ ওই প্রশ্নের আরো একটি উদাহরণ হয়ে ওঠে।
২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে-পরে বিরোধী দলের সভা-সমাবেশ ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড দমনে সোয়াট সদস্যদের ‘সাদা পোশাকে’ অভিযান পরিচালনার অভিযোগ উঠেছিল। অভিযোগ রয়েছে, কিছু ‘সন্ত্রাসবাদী পরিকল্পনা নস্যাৎ’ অভিযানে আটক ব্যক্তিদের পরবর্তী সময়ে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। বিরোধী রাজনৈতিক কর্মীদের বাড়ি ঘেরাও করে রাতের বেলায় অভিযান, তল্লাশি ও গ্রেপ্তার অভিযানে সোয়াটের অংশগ্রহণ সাধারণ মানুষের মধ্যে ভয়-ভীতি সৃষ্টি করে। নির্বাচনপূর্ব সময়ে সোয়াটকে এমনভাবে ব্যবহারকে অনেকে ‘রাজনৈতিক দমন-নীতির অংশ’ বলেই মনে করেন।
এ বিষয়ে নরওয়ের এমএফ নরওয়েজিয়ান স্কুল অব থিওলজি, রিলিজিয়ন অ্যান্ড সোসাইটির জ্যেষ্ঠ গবেষক (সহযোগী অধ্যাপক) ড. সাইমুম পারভেজ আমার দেশকে বলেন, ‘সন্ত্রাসবাদ দমনকে রাজনীতিমুক্ত করতে হলে সব গণতন্ত্রপন্থি দলের মধ্যে রাজনৈতিক ঐকমত্য দরকার। দমনমূলক আইন ও ব্যবস্থা পাল্টে পরিশোধনমূলক সন্ত্রাসবাদ দমন পলিসি নিতে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।’
২০২৩ সালের ডিসেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের বার্ষিক সন্ত্রাসবিষয়ক প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়, মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য শুধু র্যাব নয়, সিটিটিসিও (যার অধীনে সোয়াট পরিচালিত) মার্কিন সহায়তার যোগ্য নয়। যুক্তরাষ্ট্রের আইন অনুসারে, মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে সব ধরনের সহযোগিতা নিষিদ্ধ।
আন্তর্জাতিক প্রশিক্ষণ ও প্রয়োগে দুর্বলতা
আমেরিকা বা জাতিসংঘের (ইউএন) সহযোগিতায় সোয়াট সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। কিন্তু এসব প্রশিক্ষণের বাস্তব প্রয়োগ, মানবাধিকার সচেতনতা বা জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে তেমন অগ্রগতি দেখা যায়নি। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে, সোয়াট বাহিনীর সদস্যদের পর্যাপ্ত মানসিক প্রস্তুতি ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ড অনুযায়ী প্রশিক্ষণের অভাব রয়েছে। অনেক সময় তাদের অভিযানের পেছনে রাজনৈতিক নির্দেশনাও কাজ করে বলে অভিযোগ উঠেছে।
যুক্তরাষ্ট্র, চীনসহ কিছু ইউরোপীয় দেশ থেকে সোয়াট বাহিনী মাঝেমধ্যেই প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তি সহায়তা পায়। তবে এ ধরনের সহায়তা কাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার হচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সেই সঙ্গে কীভাবে এই বাহিনী মানবাধিকার লঙ্ঘনে ব্যবহার হচ্ছে, তা নিয়ে বিদেশি পার্টনারদেরও সমালোচনা করা হয়েছে।
সোয়াট বাহিনী গঠনের মূল উদ্দেশ্য ছিল চরমপন্থা মোকাবিলা। কিন্তু বাস্তব চিত্র বলছে, বহু সময় এই বাহিনী রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহৃত হয়েছে। বিচারবহির্ভূত হত্যা, অপারেশন পরিচালনায় স্বচ্ছতার অভাব এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তাদের গ্রহণযোগ্যতা ক্ষুণ্ণ করেছে। জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিতের পাশাপাশি জবাবদিহি, নিরপেক্ষতা ও মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকাই হতে পারে একটি কার্যকর ও বিশ্বাসযোগ্য নিরাপত্তা বাহিনীর বৈশিষ্ট্য।
শেখ হাসিনার আমলে সিটিটিসি ও এর বিশেষায়িত ইউনিট সোয়াটের নেতৃত্বে থাকা বেশিরভাগই পলাতক। এখন সিটিটিসির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন মাসুদ করিম। সোয়াটের বিষয়ে তাকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা দিলেও তার জবাব মেলেনি।