
সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারি, শাহ আরেফিন টিলা ও বাংকার এলাকার পাথর লুটপাটের পর এবার ‘পাথরখেকো’দের নজর পড়েছে দেশের সুপরিচিত পর্যটনকেন্দ্র সাদা পাথর এলাকায়। গত ২৩ এপ্রিল থেকে চক্রটি সাদা পাথর এলাকায় পাথর লুট শুরু করেছে। ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারি ও শাহ আরেফিন টিলা এলাকা এরই মধ্যে প্রায় পাথরশূন্য করে ফেলা হয়েছে। তবে পার্শ্ববর্তী বাংকার এলাকায় দেদার পাথর উত্তোলন চলছে।
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তবর্তী ভোলাগঞ্জ সীমান্তের শূন্যরেখার কাছে সাদা পাথর পর্যটনকেন্দ্রের অবস্থান। প্রায় ১৫ একর এলাকাজুড়ে এ পর্যটনকেন্দ্র। ছোট-বড় অসংখ্য পাথরের ওপর দিয়ে প্রবাহিত জলের স্রোতোধারা এই পর্যটনকেন্দ্রের মূল আকর্ষণ। এই সৌন্দর্যের টানে প্রতিদিন দেশ-বিদেশের হাজারো পর্যটক ভিড় জমান।
বাংকার এলাকাটি দেশের সবচেয়ে বড় পাথর কোয়ারি ভোলাগঞ্জের পাশে অবস্থিত। বাংলাদেশ রেলওয়ের একমাত্র রজ্জুপথটি (রোপওয়ে) এখানে অবস্থিত। রোপওয়ে এলাকাটিই মূলত সংরক্ষিত বাংকার হিসেবে পরিচিত। ১৯৬৪ সালে ভোলাগঞ্জ থেকে সুনামগঞ্জের ছাতকে পাথর পরিবহনে স্থল কিংবা জলযানের বিকল্প হিসেবে ১১৯টি খুঁটির মাধ্যমে তৈরি হয় রোপলাইন। ভোলাগঞ্জের রোপওয়ে এলাকাটি ৫৯ একর জায়গাজুড়ে অবস্থিত। এখানে টিলার মতো সামান্য উঁচু ভূমি আর সমতল স্থানের নিচে আছে ছোট-বড় অসংখ্য পাথর।
পাথর উত্তোলন বন্ধে প্রশাসন নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছে। ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে দোষীদের কারাদণ্ডও দেওয়া হচ্ছে। পরিবেশ ও প্রতিবেশ রক্ষায় প্রয়োজনে তাঁরা আরও কঠোরতা দেখাবেন।সিলেটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ
এই দুই এলাকায় পাথর লুটের বিষয়ে জানতে চাইলে সিলেটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ বিষয়টি অবগত বলে স্বীকার করেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পাথর উত্তোলন বন্ধে প্রশাসন নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছে। ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে দোষীদের কারাদণ্ডও দেওয়া হচ্ছে। পরিবেশ ও প্রতিবেশ রক্ষায় প্রয়োজনে তাঁরা আরও কঠোরতা দেখাবেন।
প্রকৃতি ও পরিবেশের সুরক্ষায় দেশের ৫১টি পাথর কোয়ারির মধ্যে ১৭টি কোয়ারির ইজারা স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। গত ২৭ এপ্রিল বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে সারা দেশের গেজেটভুক্ত পাথর, সিলিকা, বালু, নুড়িপাথর, সাদা মাটির কোয়ারিগুলোর ব্যবস্থাপনা-সংক্রান্ত সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
ইজারা স্থগিত রাখা কোয়ারির অধিকাংশই সিলেটে অবস্থিত। এর মধ্যে ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারিও রয়েছে। কোয়ারিটির ঠিক পাশেই সংরক্ষিত বাংকার ও সাদা পাথর এলাকা অবস্থিত। তবে এ দুটি এলাকা কোয়ারিভুক্ত না হলেও এখানে প্রচুর পরিমাণে ছোট-বড় পাথর রয়েছে। মূলত এসব পাথরই অবৈধভাবে উত্তোলন করা হচ্ছে।
নৌকা যাঁর, পাথর তাঁর
২৭ এপ্রিল বেলা সাড়ে ৩টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সাদা পাথর ও বাংকার এলাকায় সরেজমিনে দেখা গেছে, শ্রমিকেরা বেলচা, কোদাল ও শাবল ব্যবহার করে পাথর উত্তোলন করে অন্তত শতাধিক বারকি নৌকায় বোঝাই করেছেন। পরে সেসব পাথর বিক্রির জন্য ধলাই নদ দিয়ে ভোলাগঞ্জ ১০ নম্বর সাইট এলাকায় নিয়ে যাচ্ছেন।
বিকেল পৌনে ৫টার দিকে সাদা পাথর এলাকার পৃথক দুটি অংশে ২১ ব্যক্তিকে পানি থেকে হাতড়ে পাথর তুলে ১৭টি নৌকায় বোঝাই করতে দেখা গেল। আবার দুজন ব্যক্তিকে সাদা পাথরমুখী রাস্তায় ধলাই নদের পাড় খুঁড়ে পাথর তুলতে দেখা গেল।
বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে পার্শ্ববর্তী বাংকার এলাকায় অন্তত শতাধিক শ্রমিককে বেলচা, কোদাল ও শাবল দিয়ে মাটি খুঁড়ে পাথর তুলতে দেখা যায়। সেখানে খোঁড়াখুঁড়ির কারণে শত শত গভীর গর্ত তৈরি হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ এসব গর্ত থেকে তোলা পাথর স্তূপাকারে পাড়ে জমা করছেন অনেকে। আবার কেউ কেউ এসব পাথর টুকরিতে ভরে মাথায় নিয়ে কিছু দূর পর্যন্ত হেঁটে নৌকায় রাখছেন।
পরদিন ২৮ এপ্রিল বেলা সাড়ে ১১টার দিকে সরেজমিনে দেখা যায়, প্রবল বৃষ্টির মধ্যেও বাংকার এলাকায় কিছু শ্রমিক পাথর উত্তোলন করে নৌকায় এনে রাখছিলেন। পাথরভর্তি চারটি নৌকাকে এ সময় বাংকার এলাকা থেকে ধলাই নদ দিয়ে ১০ নম্বর সাইট এলাকায় আসতে দেখা যায়।
কোয়ারিটির ঠিক পাশেই সংরক্ষিত বাংকার ও সাদা পাথর এলাকা অবস্থিত। তবে এ দুটি এলাকা কোয়ারিভুক্ত না হলেও এখানে প্রচুর পরিমাণে ছোট-বড় পাথর রয়েছে। মূলত এসব পাথরই অবৈধভাবে উত্তোলন করা হচ্ছে।
বাংকার এলাকায় কর্মরত দুজন শ্রমিক জানান, ২৬ এপ্রিল ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালিয়ে পাথর উত্তোলনে জড়িত ৯ ব্যক্তিকে ২ বছর করে কারাদণ্ড দিয়েছেন। এতে অনেকে ভয় পেয়েছেন। অন্য দিন হাজারো শ্রমিক বাংকার এলাকায় পাথর উত্তোলন করতে এলেও ২৭ এপ্রিল থেকে তুলনামূলকভাবে কম শ্রমিকই আসছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বারকি নৌকার এক মালিক বলেন, যেহেতু ধলাই নদ পেরিয়ে পাথর নিয়ে আসতে হয়, তাই পরিবহনে এখানে কয়েক হাজার বারকি নৌকা আছে। মূলত শ্রমিকেরা পাথর তুলে এসব নৌকার মালিকদের কাছে বিক্রি করেন। পরে নৌকার মালিকেরা এসব পাথর ১০ নম্বর সাইট এলাকায় ক্রাশার মেশিন (পাথর ভাঙার কল) মালিকদের কাছে বিক্রি করেন। আবার অনেক নৌকামালিকের সরাসরি তত্ত্বাবধানেও পাথর উত্তোলন করেন শ্রমিকেরা। মূলত যাঁর নৌকা আছে, তাঁরা পাথর পরিবহনে সুবিধা ও মুনাফা বেশি পান। এককথায় নৌকা যাঁর, পাথরও তাঁর।
বিকেল পৌনে ৫টার দিকে সাদা পাথর এলাকার পৃথক দুটি অংশে ২১ ব্যক্তিকে পানি থেকে হাতড়ে পাথর তুলে ১৭টি নৌকায় বোঝাই করতে দেখা গেল। আবার দুজন ব্যক্তিকে সাদা পাথরমুখী রাস্তায় ধলাই নদের পাড় খুঁড়ে পাথর তুলতে দেখা গেল।
শ্রমিকেরা জানান, দিনের চেয়ে রাতের বেলায় প্রশাসনের নজরদারির কোনো ভয় থাকে না। তাই ওই সময় পাথর উত্তোলন বেশি হয়। কয়েক হাজার শ্রমিক বাংকার এলাকায় প্রতিদিন পাথর উত্তোলন করেন। তবে অভিযানের কারণে পরিস্থিতির অনেকটা বদল হয়েছে। একেকজন শ্রমিক পাথর উত্তোলন করে তিন থেকে চার হাজার টাকা আয় করেন বলে জানান।
স্থানীয় পাথর ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, বারকি নৌকাভর্তি ‘বোল্ডার’ (বড় পাথর) ৫ হাজার টাকা, ‘ভুতু’ (মাঝারি) ৪ হাজার থেকে সাড়ে ৪ হাজার টাকা এবং ‘সিঙ্গেল’ (ছোট পাথর) ৩ হাজার থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকায় শ্রমিকেরা বিক্রি করেন।
অভিযানেও থেমে নেই লুট
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, আগে আড়ালে-আবডালে পাথর উত্তোলন চলত। গত ৫ আগস্টের পর প্রকাশ্যে হাজারো মানুষ অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন করছেন। স্থানীয় প্রশাসন অভিযান চালালে পাথর উত্তোলনকারীরা সটকে পড়েন। পরে অভিযানে আসা দলটি চলে গেলে আবার উত্তোলন শুরু করে। রাতের বেলা তো বটেই, দিনের বেলা প্রকাশ্যেই এখন বাংকার ও সাদা পাথর এলাকায় পাথর লুট চলছে।
এদিকে স্থানীয় প্রশাসন জানিয়েছে, সর্বশেষ ২৮ এপ্রিল বেলা ৩টা থেকে ৫টা পর্যন্ত ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারি এলাকায় অভিযান চালানো হয়েছে। তবে প্রবল বৃষ্টির কারণে এ সময় কমসংখ্যক পাথর উত্তোলনকারী ছিলেন। যাঁরা ছিলেন, তাঁরা স্থানীয় প্রশাসনের উপস্থিতি টের পেয়ে সটকে পড়েন।
ভোলাগঞ্জ এলাকার এক বাসিন্দা বলেন, অভিযানের প্রভাব দু-এক দিন থাকে। এরপর আবারও দেদার লুটপাট চলে। গত ৫ আগস্ট–পরবর্তী সময়ে প্রথমে ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারি এবং পরে বাংকার এলাকায় দেদার পাথর লুট শুরু হয়। এখনো বাংকার এলাকায় পাথর লুট চলছে।
ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারি ও শাহ আরেফিনের টিলার পাথর লুট করে প্রায় ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। বাংকার এলাকাও পাথরশূন্য হওয়ার পথে। দিনের বেলা প্রকাশ্যেই এসব করা হলেও প্রশাসনের কার্যকর ভূমিকা দেখা যায়নি। এখন সাদা পাথরেও নজর পড়েছে পাথরখেকোদের, তা ঠেকাতে প্রশাসনকে আরও কঠোর হতে হবে।বাপা সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আবদুল করিম চৌধুরী
৫ আগস্ট–পরবর্তী সময়ে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারি, শাহ আরেফিন টিলা, বাংকার ও সাদা পাথর থেকে কী পরিমাণ পাথর লুট হয়েছে, এর কোনো পরিসংখ্যান স্থানীয় প্রশাসনের কাছে নেই। যদিও স্থানীয় লোকজন মনে করছেন, কমপক্ষে ৫০০ থেকে ৬০০ কোটি টাকার পাথর এসব এলাকা থেকে লুট হয়েছে। এর মধ্যে বাংকার এলাকা থেকেই লুট হয়েছে অন্তত ২৫০ কোটি টাকার পাথর। তবে গত দশ দিনে সাদা পাথর এলাকা থেকে কত টাকার পাথর লুট হয়েছে, তা স্থানীয় লোকজনও অনুমান করতে পারছেন না।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আবদুল করিম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারি ও শাহ আরেফিনের টিলার পাথর লুট করে প্রায় ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। বাংকার এলাকাও পাথরশূন্য হওয়ার পথে। দিনের বেলা প্রকাশ্যেই এসব করা হলেও প্রশাসনের কার্যকর ভূমিকা দেখা যায়নি। এখন সাদা পাথরেও নজর পড়েছে পাথরখেকোদের, তা ঠেকাতে প্রশাসনকে আরও কঠোর হতে হবে।