Image description

যশোরের মানুষের সেচ, গৃহস্থালি ও সুপেয় পানির সংকট নিরসনে বিরল প্রকল্প নিয়েছিল সরকার। প্রায় ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে খনন করা হয় পুকুর, খালসহ বেশ কয়েকটি জলাশয়। কাজ শেষে করেছে ঠিকাদার, কর্মসূচি বাস্তবায়ন দেখিয়েছে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো। কিন্তু এসব জলাধার থেকে মেলেনি ১০ ফোঁটা পানযোগ্য পানি। এমনকি এসব প্রকল্পের পানি যে খাওয়া যাবে-এ তথ্যই জানে না জনগণ।

ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দিন দিন নিচে নেমে যাচ্ছে। তা ছাড়া এসব পানিতে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর আর্সেনিক, ম্যাঙ্গানিজ, ক্লোরাইড, আয়রন ইত্যাদি উপাদান বেড়ে যাওয়ায় সরকার ভূউপরিস্থ পানির ব্যবহার বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়। এর অংশ হিসেবে সারা দেশে জেলা পরিষদের পুকুর, জলাশয় ও খাল পুনঃখনন-সংস্কারের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হয়। সরকারের অর্থায়নে ২০১৮ সালে পাঁচ বছর মেয়াদি পানি সংরক্ষণ ও নিরাপদ পানি সরবরাহের লক্ষ্যে জেলা পরিষদের পানির আধারগুলো ব্যবহার উপযোগী করার প্রকল্প শুরু হয়। শেষ হয় ২০২৩ সালের জুনে। প্রকল্পটি জেলা পরিষদের জমিতে বাস্তবায়ন হলেও কাজ চলেছে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে। আর প্রকল্প সার্ভে করে তৃতীয় পক্ষ।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, যশোরে মোট ২৬টি পুকুর-জলাশয় এ প্রকল্পের আওতায় আসে। এর মধ্যে জমিসংক্রান্ত জটিলতার কারণে তিনটি পুকুরে কাজ করা যায়নি। বাকি ২৩টির মধ্যে ১১টিতে পূর্ণাঙ্গ ও ১২টিতে আংশিক কাজ হয়। উন্নয়ন প্রকল্পটির আওতায় ছিল জলাশয় পুনঃখনন বা সংস্কার, পুকুরের পাড় বাঁধাই, ঘাস ও গাছ লাগানো, কাঁটাতারের বেড়া, গেট নির্মাণ এবং ওয়াকওয়ে নির্মাণ, সোলার সিস্টেম ও পাম্প স্থাপন। এ ছাড়া কিছু কারিগরি কাজও ছিল। চারটি প্যাকেজে যশোরে তিনটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান প্রায় ১০ কোটি টাকা খরচসাপেক্ষ কাজগুলো করে।

সরেজমিনে সংশ্লিষ্ট কয়েকটি পুকুরে দেখা যায়, স্থানীয় লোকজন এর কোনো সুফলই পাননি। কিছু পুকুরে সামান্য পানি আছে। কিন্তু সেই পানি ট্রিটমেন্ট প্লান্টে উত্তোলন করার কোনো ব্যবস্থা নেই। সোলার সিস্টেম স্থাপনের জন্য স্থাপনা ও অবকাঠামো নির্মাণ করা হলেও সেগুলো অযত্ন-অবহেলায় নষ্ট হচ্ছে। অস্তিত্ব নেই রোপণ করা গাছের।

সম্ভাব্য সুবিধাভোগীরা জানান, সরকার কী উদ্দেশে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে, তা তারা জানেন না। পুকুরের পানি তারা কখনো পান করেননি। এই পানি সেচকাজে ব্যবহার করা যাবে- এমন তথ্যও কেউ তাদের দেয়নি।

বিষয়টি সম্পর্কে খোঁজ রাখে, এমন সূত্রগুলো বলছে, প্রকল্পটির গোড়ায় গলদ ছিল। পুকুরের পানি যে পান করা যায়- যশোর অঞ্চলের মানুষ এমন কথা চিন্তাও করে না। এই পানি পান করানোর জন্য যে সচেতনতা কর্মসূচি দরকার ছিল, তা করা হয়নি। মূলত জেলা পরিষদের সদস্যসহ পতিত ফ্যাসিবাদী সরকারের গ্রামপর্যায়ের সুবিধাভোগীরা কখনো চাননি প্রকল্পটি সফল হোক। তাদের অধিকাংশই চেয়েছিলেন, জলাশয়গুলোতে মাছ চাষ করে আর্থিকভাবে লাভবান হতে। প্রকল্পটি ব্যর্থ হওয়ার পেছনে এই দুষ্ট চক্রের বড় ভূমিকা ছিল।

 

এসব কাজ করেছে মেসার্স নূর হোসেন জেভি, মেসার্স শামীম চাকলাদার এবং মেসার্স ফিরোজ এন্টারপ্রাইজ। এর মধ্যে মেসার্স ফিরোজ এন্টারপ্রাইজের কাজ নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। প্রতিষ্ঠানটির পক্ষে যে ব্যক্তি প্রকল্প তদারকির দায়িত্বে ছিলেন তিনি তখনকার শাসক দল ও নিজের সন্ত্রাসী বাহিনীর প্রভাবে সরকারি দপ্তর নিয়ন্ত্রণ করতেন বলে অভিযোগ রয়েছে। হাসিনা সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ওই ব্যক্তি পালিয়ে যান।

 

পুকুর খনন-সংস্কার কাজ করা মেসার্স নূর হোসেনের স্বত্বাধিকারী নূর হোসেন আমার দেশকে বলেন, ‘শিডিউল অনুযায়ী যথাযথ প্রক্রিয়ায় কাজ সম্পন্ন করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। সাইট হ্যান্ডওভারের কপিও আমাদের কার্যালয়ে সংরক্ষিত আছে। দ্বিতীয় পর্যায়ের পানি শোধনের কাজ মেসার্স ফিরোজ এন্টারপ্রাইজ কীভাবে করেছে তা আমাদের জানার বিষয় নয়।’

 

প্রকল্প সফল হয়নি বলে স্বীকার করেছেন জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আছাদুজ্জামান এবং জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর যশোরের নির্বাহী প্রকৌশলী জাহিদ পারভেজ। তারা জানান, সব পুকুর দেখভালের জন্য জেলা পরিষদের সদস্য, স্থানীয় ইউপি সদস্য, শিক্ষক, ইমাম, নারী প্রতিনিধিদের নিয়ে কমিটি গঠনের কথা ছিল। কিন্তু জেলা পরিষদের সদস্যদের বিরোধিতার কারণে সেটা করা যায়নি। এতে প্রকল্পের আওতাধীন ঝিকরগাছার কায়েমকোলা পুকুর থেকে কিছু মূল্যবান যন্ত্র চুরি হয়ে যায়। এরপর জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর সব যন্ত্র জেলা পরিষদের কাছে হস্তান্তর করে। তখন থেকে আজ পর্যন্ত সেগুলো গুদামেই রয়ে গেছে।

 

প্রকৌশলী জাহিদ আরো বলেন, সোলার পন্ড স্যান্ড ফিল্টারের মাধ্যমে পরিশোধন করা পুকুরের পানি পুরোপুরি নিরাপদ। কিন্তু মানুষকে বিষয়টি না বোঝালে তারা কেন পুকুরের পানি পান করবে? কিন্তু কমিটি গঠন করতে না পারায় সম্ভাব্য উপকারভোগীরা অন্ধকারেই আছে।

 

আছাদুজ্জামান জানান, হাসিনা সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও তার পরিষদ বিলুপ্ত করা হয়েছে। ফলে এখন কাজ করার অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়েছে। ইতোমধ্যে দুটি পুকুরে কমিটি গড়ে দেওয়া হয়েছে। শিগগির অন্য পুকুরগুলোতেও কমিটি গঠন করা হবে। চুরি হবে না- এমন নিশ্চয়তা পেলে সোলার প্যানেলসহ মূল্যবান যন্ত্রগুলোও স্থাপন করা হবে। মানুষজনকে পুকুরের পানি পানে উদ্বুদ্ধ করবে কমিটিগুলো।