Image description

আইএফসির প্রতিবেদন

 

বাংলাদেশে পরিচালিত প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসা করার ক্ষেত্রে শীর্ষ পাঁচটি প্রতিবন্ধকতার মধ্যে দুর্নীতি অন্যতম। দেশে ব্যবসা করা প্রতি চারটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একটি প্রতিষ্ঠান কমপক্ষে একবার ঘুসের সম্মুখীন হয়েছে। ২৩ শতাংশ প্রতিষ্ঠানকে ঘুস দিয়ে ব্যবসা করতে হচ্ছে বাংলাদেশে। বিশ্বব্যাংকের প্রতিষ্ঠান ইন্ট্যারন্যাশনাল ফাইন্যান্স প্রতিষ্ঠানের (আইএফসি) এপ্রিলে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ- দেশের বেসরকারি খাতের ডায়াগনস্টিক’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য ওঠে এসেছে।

আইএফসি প্রতিবেদনটিতে ঘুসকে ‘উপহার’ হিসেবে উল্লেখ করেছে। দেশের বেসরকারি খাতের ডায়াগনস্টিকের (সিপিএসডি) উদ্দেশ্য হলো বেসরকারি খাতের প্রবৃদ্ধি ও বিনিয়োগের সুযোগ শনাক্ত করা। বিশ্বব্যাংক গ্রুপের প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে যৌথভাবে তৈরি করা এই প্রতিবেদনে কোনো দেশের সামগ্রিক ব্যবসার পরিবেশ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে এবং যথাযথ নীতি ও নিয়ন্ত্রক সমস্যা মোকাবিলা করা হলে, বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করতে পারে এমন নির্দিষ্ট খাতের বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

আইএফসি দেশের ব্যবসা প্রতিবন্ধকতার ক্ষেত্রে দুর্নীতির এসব তথ্যের রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করেছে ওয়ার্ল্ডওয়াইড গভর্নেন্স ইন্ডিকেটর (ডব্লিউজিআই) প্রকাশিত ২০২২-এর প্রতিবেদন থেকে। ডব্লিউজিআই হলো একটি গবেষণা ডেটাসেট, এর মাধ্যমে শিল্প ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর উদ্যোগ, নাগরিক ও বিশেষজ্ঞ সমীক্ষার উত্তরদাতা প্রদত্ত শাসনের মান সম্পর্কে মতামতের সারসংক্ষেপ তুলে ধরে।

দেশের ব্যবসা পরিবেশের ক্ষেত্রে জটিলতা হিসেবে দুর্নীতি অন্যতম কারণ। বিশ্বব্যাপী পরিচালিত গভর্নেন্স ইন্ডিকেটর অনুসারে, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে ২১৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১৮২তম স্থানে রয়েছে।

আইএফসির প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশি চারটি সংস্থার মধ্যে একটি (২৩ শতাংশ) কমপক্ষে একবার ঘুসের অনুরোধের সম্মুখীন হয়েছে। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ৩৫ শতাংশ সংস্থাকে বৈদ্যুতিক সংযোগ বা অপারেটিং লাইসেন্স পাওয়ার জন্য উপহার দিতে হয়েছে। ৭২ শতাংশ সংস্থা আমদানি লাইসেন্স পাওয়ার জন্য ‘উপহার’ (ঘুস) দেওয়ার কথা ভাবে এবং ১৯ শতাংশ সংস্থাকে কর কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে উপহার দিতে হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে এমন ঘটনা দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক গড়ের তুলনায় প্রায় ৫০ শতাংশ বেশি। এতে বাংলাদেশে দুর্নীতি দমনে কাজ করা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে বলা হয়, বাংলাদেশে দুর্নীতিবিরোধী নীতি এবং বিধিবিধান রয়েছে, কিন্তু তাদের প্রয়োগের অভাব রয়েছে। এমন প্রতিবেদন রয়েছে যে, ঘুস ও দুর্নীতির তদন্তকারী প্রধান সরকারি সংস্থা দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে।

এ বিষয়ে মন্তব্য চাইলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান আমার দেশকে বলেন, এগুলো বাংলাদেশের চলমান সমস্যা। এর কারণে দেশে বিনিয়োগ আসছে না। স্থানীয় ও বিদেশি বিনিয়োগকারী সবাই এ কারণে নিরুৎসাহিত হচ্ছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এগুলো দিতে চায় না। কারণ তাদের দেশে করপোরেট কালচারে যে সুশাসনগুলো আছে, সে অনুযায়ী এখানে এভাবে বিনিয়োগ করলে তাদের জরিমানা হতে পারে, লাইসেন্স চলে যেতে পারে।

এই অর্থনীতিবিদ মনে করেন, আমাদের দায়বদ্ধতা বাড়িয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনকে শক্তিশালী করা, ফরেনসিক ইনভেস্টিগেশন করা, নজরদারি বাড়ানো, দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহিষ্ণুতা বাড়াতে হবে। এগুলো অনেক দিন ধরেই বলা হচ্ছে। আমাদের আশা ছিল অন্তর্বর্তী সরকার এগুলোতে বড় ধরনের পদক্ষেপ নেবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত আমরা দৃশ্যমান কাজগুলো দেখিনি।

বিশেষজ্ঞরা জানান, ঘুস অনানুষ্ঠানিক সংস্থাগুলোর প্রতিযোগিতা পরিচালনা খরচের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে। ফলে ব্যবসায়িক নিয়মকানুন লঙ্ঘন হতে পারে, প্রয়োজনীয় ব্যবসায়িক লাইসেন্স এবং প্রয়োজনীয়তা এড়াতে পারে এবং শ্রমিকদের মজুরি কমিয়ে দিতে পারে।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগের (এফডিআই) গন্তব্যস্থল হিসেবে দুর্বল অবস্থানে রয়েছে। ১৯৯০-এর দশকের শেষের দিক থেকে বিনিয়োগ প্রবাহের ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি, যা ২০১৩ সালে জিডিপির ১ দশমিক ৭ শতাংশে পৌঁছেছিল। এরপর ২০১৫ সালে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং নিয়ন্ত্রক অনিশ্চয়তার কারণে মন্দা শুরু হয়। ২০১৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত এফডিআই জিডিপির মাত্র শূন্য দশমিক ৫ শতাংশে নেমে আসে, যা সমকক্ষ প্রতিযোগী দেশগুলোরদের মধ্যে সর্বনিম্ন। গত দশকে বেশির ভাগ এফডিআই ছিল জ্বালানি খাতে। তবে এফডিআইয়ের বেশির ভাগই ছিল বাংলাদেশে কর্মরত বিদ্যমান বিদেশি সহযোগীদের পুনরায় বিনিয়োগের আকারে।

ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আমাদের দেশে ঘুসের মতো সংস্কৃতির কারণে প্রতিযোগী সক্ষমতা থাকে না, ব্যয় বেড়ে যায়। তখন বিনিয়োগকারী বিনিয়োগও করে না, বিনিয়োগে লাভবানও হতে পারে না। এগুলোর বিরুদ্ধে ‘শূন্য সহিষ্ণুতা’ দেখাতে হবে। এখানে যতটুকু সম্ভব হিউম্যান ইন্টারফেসটাকে যদি বিভিন্ন প্রযুক্তির মাধ্যমে বন্ধ করা যায়, তাহলে এটা কমানো সম্ভব।