Image description

গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে আরও একটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে যাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। নতুন ট্রাইব্যুনাল গঠনের বিষয়ে শিগগিরই প্রজ্ঞাপন জারি করবে আইন মন্ত্রণালয়। এই ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম চলবে বর্তমান ট্রাইব্যুনালের পাশের ভবনে। এ লক্ষ্যে পুরোনো হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে একটি ভবনের সংস্কারকাজ এখন পুরোদমে চলছে।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার হচ্ছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। এখন এই ট্রাইব্যুনালে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারও চলছে। পাশাপাশি বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে সংঘটিত গুম, খুনসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার এই ট্রাইব্যুনালে করা হচ্ছে। তবে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার এখন বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে ট্রাইব্যুনালে। এ বিচার কার্যক্রমকে আরও গতিশীল করতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ গঠন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২–এর চেয়ারম্যান হিসেবে উপযুক্ত ও আগ্রহী বিচারপতি খুঁজে পেতে একটু সময় লেগেছে। না হলে হয়তো আগেই ট্রাইব্যুনাল-২ গঠন হয়ে যেত।
অধ্যাপক আসিফ নজরুল, আইন উপদেষ্টা

আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন অনুযায়ী, সরকার চাইলে এক বা একাধিক ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে পারে। প্রতিটি ট্রাইব্যুনালে একজন চেয়ারম্যান থাকেন। তাঁর সঙ্গে সর্বনিম্ন দুজন থেকে সর্বোচ্চ চারজন সদস্য থাকতে পারেন। এখন ট্রাইব্যুনাল-২ গঠন করা হলে সেখানে চেয়ারম্যানসহ সর্বনিম্ন তিনজন বিচারপতি থাকবেন।

নতুন ট্রাইব্যুনালের বিষয়ে আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল গত ২৬ এপ্রিল প্রথম আলোকে বলেন, হয়তো সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ গঠন হয়ে যাবে। কারণ, পরীক্ষা–নিরীক্ষা করে দেখা যাচ্ছে, গ্রহণযোগ্য বা বস্তুনিষ্ঠ মামলার সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। মামলাগুলো একটু দ্রুততার সঙ্গে নিষ্পত্তি হোক, তা চায় সরকার।

উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল–২–এর চেয়ারম্যান হিসেবে উপযুক্ত ও আগ্রহী বিচারপতি খুঁজে পেতে একটু সময় লেগেছে। না হলে হয়তো আগেই ট্রাইব্যুনাল–২ গঠন হয়ে যেত। এখন সরকার উপযুক্ত বিচারপতি খুঁজে বের করেছে, যাঁরা আইনবিশেষজ্ঞ হিসেবেও পরিচিত ও অভিজ্ঞ।

ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম

আন্তর্জাতিক অপরাধ (আইন), ১৯৭৩–এর আওতায় বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০১০ সালের ২৫ মার্চ প্রথমে তিন সদস্যের একটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করে। এই ট্রাইব্যুনালে মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার গুরুত্ব পায়। তখন এ বিচার কার্যক্রমকে আরও গতিশীল করতে ২০১২ সালের ২২ মার্চ আরও একটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়।

ট্রাইব্যুনাল-১ থেকে ৪৪টি ও ট্রাইব্যুনাল-২ থেকে ১১টি মামলার রায় এসেছে। ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর সব আইনি প্রক্রিয়া শেষে মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে এখন পর্যন্ত শীর্ষ পর্যায়ের ছয় আসামির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে। ছয় আসামির মধ্যে পাঁচজনই জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন শীর্ষস্থানীয় নেতা। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন জামায়াতের তৎকালীন আমির মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লা ও মুহাম্মদ কামারুজ্জামান এবং দলটির কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের সদস্য মীর কাসেম আলী। এ ছাড়া মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ফাঁসি কার্যকর হয়েছে বিএনপির স্থায়ী কমিটির তৎকালীন সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর।

ট্রাইব্যুনাল-১ থেকে ৪৪টি ও ট্রাইব্যুনাল-২ থেকে ১১টি মামলার রায় এসেছে। ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর সব আইনি প্রক্রিয়া শেষে মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে এখন পর্যন্ত শীর্ষ পর্যায়ের ছয় আসামির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে।ছয় আসামির মধ্যে পাঁচজনই জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন শীর্ষস্থানীয় নেতা।

২০১৫ সালের শেষ দিকে ট্রাইব্যুনাল–২ অকার্যকর হয়ে যায়। তবে ট্রাইব্যুনাল–১–এর কার্যক্রম চলমান ছিল। গত ৫ আগস্ট গণ–অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ট্রাইব্যুনাল–১ পুনর্গঠন করা হয়। এই ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান করা হয় বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারকে। ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারপতি মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।

পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালে জুলাই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগ সরকারের শীর্ষ নেতাদের আসামি করা হয়েছে। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তাদের অনেকে রয়েছেন আসামি তালিকায়। এখন পর্যন্ত শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে তিনটি মামলা হয়েছে। একটি মামলায় জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত হত্যা-গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগ আনা হয়েছে। আরেকটি মামলায় আওয়ামী লীগ শাসনামলের সাড়ে ১৫ বছরে গুম ও খুনের ঘটনায় তাঁকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। অপর মামলাটি হয়েছে রাজধানীর মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায়।

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে করা তিনটি মামলার মধ্যে গণ-অভ্যুত্থানের সময় হত্যা-গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় করা মামলার তদন্ত বেশ এগিয়েছে বলে প্রসিকিউশন সূত্রে জানা গেছে। এ মামলায় আগামী ২৪ জুন তদন্ত প্রতিবেদনের জমা দেওয়ার সময় নির্ধারণ করেছেন ট্রাইব্যুনাল।

২০১৫ সালের শেষ দিকে ট্রাইব্যুনাল–২ অকার্যকর হয়ে যায়। তবে ট্রাইব্যুনাল–১–এর কার্যক্রম চলমান ছিল।

নতুন ট্রাইব্যুনাল ভবন সংস্কার হচ্ছে

ট্রাইব্যুনাল ১–এর পাশেই ট্রাইব্যুনাল ২–এর জন্য ভবন সংস্কার করা হচ্ছে। ভবনটি অনেকটা পরিত্যক্ত অবস্থায় ছিল। ২৭ এপ্রিল সেখানে গিয়ে দেখা যায়, পুরোনো ভবন সংস্কারের কাজ পুরোদমে চলছে। ইট, বোর্ড ও তারের মতো নানা নির্মাণসামগ্রী এনে রাখা হয়েছে। ভবনটির বাইরের অংশ রং করার কাজ প্রায় শেষ। এখন ভবনের ভেতরে রং করা হচ্ছে। মেঝে, দেয়াল ও সিঁড়ি মেরামতের কাজ চলছে। এ ছাড়া ভবনের বিভিন্ন কক্ষে এসি (শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র) স্থাপনের কাজ করতে দেখা গেছে।

ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর (প্রশাসন) গাজী মোনাওয়ার হুসাইন তামীম প্রথম আলোকে বলেন, দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনাল ভবনের সংস্কারকাজ শেষের দিকে। সংস্কারকাজ পুরোপুরি শেষ হওয়ার আগেই যদি নতুন ট্রাইব্যুনাল গঠন হয়ে যায়, তাহলে সরকার চাইলে বর্তমান ট্রাইব্যুনাল প্রথমে যেখানে বসতেন, সেখানে (পুরোনো হাইকোর্ট ভবন প্রাঙ্গণে ইটের দেয়ালের ওপর টিনের ছাউনি) এর কার্যক্রম শুরু করতে পারে।

২৭ এপ্রিল সেখানে গিয়ে দেখা যায়, পুরোনো ভবন সংস্কারের কাজ পুরোদমে চলছে। ইট, বোর্ড ও তারের মতো নানা নির্মাণসামগ্রী এনে রাখা হয়েছে। ভবনটির বাইরের অংশ রং করার কাজ প্রায় শেষ। এখন ভবনের ভেতরে রং করা হচ্ছে।

ইতিবাচকভাবে দেখছে শহীদ পরিবার

ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশনে এখন ১৭ জন প্রসিকিউটর রয়েছেন। অন্যদিকে তদন্ত সংস্থায় কর্মকর্তা আছেন ২৬ জন। তদন্ত সংস্থার সমন্বয়কের (প্রধান) পদটি এক মাসের বেশি সময় ধরে ফাঁকা ছিল। ৩০ এপ্রিল তদন্ত সংস্থার প্রধানের পদে (সমন্বয়ক) অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা আনসার উদ্দিন খান পাঠানকে নিয়োগ দেওয়া হয়।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, পুনর্গঠনের পর ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম এখনো প্রাক্‌–বিচার পর্যায়ে রয়েছে। এ সময় তদন্ত সংস্থারকাজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, কোনো অভিযোগের ক্ষেত্রে তদন্ত করে প্রসিকিউশনে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কাজটি তাঁদের। তদন্ত সংস্থার কাছ থেকে পাওয়া প্রতিবেদন পর্যালোচনার পর আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) আকারে তা ট্রাইব্যুনালে দাখিল করে প্রসিকিউশন। এ অভিযোগ ট্রাইব্যুনাল গ্রহণ করার পরই মূলত আনুষ্ঠানিক বিচারকাজ শুরু হয়।

ট্রাইব্যুনালের বিচার কার্যক্রমের অগ্রগতি সম্পর্কে ১০ এপ্রিল সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করে চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়। সভায় জানানো হয়, পুনর্গঠনের পর ট্রাইব্যুনালে ২২টি মিস কেস (বিবিধ মামলা) হয়েছে। এসব মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আসামি করা হয়েছে ১৪১ জনকে। আসামিদের মধ্যে ৫৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পলাতক আছেন ৮৭ জন।

জুলাই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় করা বিভিন্ন মামলার বিচারের জন্য আরেকটি ট্রাইব্যুনাল গঠনের সরকারি সিদ্ধান্তকে ইতিবাচকভাবে দেখছে শহীদ পরিবারের সদস্য সংগঠন ‘জুলাই ২৪ শহীদ পরিবার সোসাইটি’।

ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠনের পর ১০ এপ্রিল পর্যন্ত প্রসিকিউশন ও তদন্ত সংস্থার কাছে অভিযোগ এসেছে ৩৩৯টি। তখন পর্যন্ত তদন্ত কার্যক্রম চলমান ছিল ৩৯টি। তদন্তের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়ায় মামলা (বিবিধ মামলা) হয়েছে ২২টি।

জুলাই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় করা বিভিন্ন মামলার বিচারের জন্য আরেকটি ট্রাইব্যুনাল গঠনের সরকারি সিদ্ধান্তকে ইতিবাচকভাবে দেখছে শহীদ পরিবারের সদস্য সংগঠন ‘জুলাই ২৪ শহীদ পরিবার সোসাইটি’।

এই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক রবিউল আউয়াল প্রথম আলোকে বলেন, আরেকটি ট্রাইব্যুনাল গঠন জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার কার্যক্রমকে গতিশীল করবে। তবে বিচার দ্রুত করার জন্য তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশনের আরও আন্তরিকতা দরকার। পাশাপাশি এই দুই জায়গায় দক্ষ জনবল আরও বাড়াতে হবে।