
রুবেল চন্দ্র দাস। ৪০তম ক্যাডেট ব্যাচের অব্যাহতিপ্রাপ্ত সাব–ইন্সপেক্টর (এসআই)। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে যোগদান করেছিলেন বাংলাদেশ পুলিশের ৪০তম ক্যাডেট এসআই-২০২৩ ব্যাচের প্রশিক্ষণে। দীর্ঘ এক বছর প্রশিক্ষণ করার পর চাকরিতে যোগদানের কিছুদিন পূর্বে ‘নাস্তা না খেয়ে হইচই’ করার অভিযোগে তাকে অব্যাহতি দিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
রুবেল দাসের বাড়ি সুনামগঞ্জ জেলার শাল্লা উপজেলায়। কৃষক বাবা শ্রীবাস দাসের তিন ছেলের মধ্যে রুবেল সবার বড়। তিনি নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃষি বিভাগে স্নাতক এবং শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক্স এন্ড প্ল্যান্ট ব্রিডিং ডিপার্টমেন্ট থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। এরপর ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে প্রাইমারি সহকারী শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় সুপারিশপ্রাপ্ত হয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় যোগদান করেন তিনি। সেখানে ৯ মাস জব করার পর বাংলাদেশ পুলিশের ৪০তম ক্যাডেট এসআই-এর চূড়ান্ত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ২০২৩ সালের নভেম্বরের ৪ তারিখ রাজশাহীর সারদা পুলিশ একাডেমিতে ১ বছরের মৌলিক প্রশিক্ষণের জন্য যোগদান করেন তিনি।
পুলিশের ট্রেনিংয়ে যোগদান প্রসঙ্গে রুবেল বলেন, পুলিশের নীল পোশাকের প্রতি প্রবল টান ও ভালোবাসা ছিল ছোটবেলা থেকেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়ে একবার আমার ফোন চুরি হয়ে যায়। আমার কাছে যথাযথ প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করার পরও ফোনটি উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। টিউশনির কষ্টার্জিত টাকায় কেনা ফোনটি উদ্ধার না হওয়ায় সেদিন খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম—আমি যদি কখনো পুলিশ হতে পারি, তবে এমন পরিস্থিতিতে সাহায্যপ্রার্থী মানুষ যেন তাদের ন্যায্য সেবা থেকে বঞ্চিত না হন, তা নিশ্চিত করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করব।
তিনি বলেন, সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদ ও আমার অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে মাঠ পরীক্ষার ১১টি ধাপ (১৬০০ মিটার দৌড়, হাই জাম্প, লং জাম্প, পুশ-আপ, সিট-আপ, ড্রাগলিং, রোপ ক্লাইম্বিং ইত্যাদি), লিখিত পরীক্ষা, কম্পিউটার টেস্ট, ভাইভা, মেডিকেল পরীক্ষা এবং পুলিশ ভেরিফিকেশন—সবকিছু সফলতার সাথে উত্তীর্ণ হয়ে আমি ৪০তম ক্যাডেট ব্যাচে চূড়ান্তভাবে সুপারিশপ্রাপ্ত হই। এরপর সারদায় ১ বছরের মৌলিক প্রশিক্ষণের জন্য যোগদান করি।
প্রশিক্ষণের শেষ দিকে এসে অব্যাহতি পান রুবেল। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিনা বেতনে বাড়ি থেকে ধার দেনা করে ৩৫২দিন ট্রেনিং সম্পন্ন করার পর আমাকে শোকজ করা হয়। অভিযোগ আমি ‘ ৪০ তম এস পি (প্রবেশনার) ব্যাচের পাসিং আউট প্যারেড প্র্যাক্টিসের বিরতিতে নাস্তা গ্রহণ না করে হইচই করেছি, একইসঙ্গে অন্যদেরকেও নাস্তা না খাওয়ার জন্য উৎসাহিত করেছি’। আমি সেদিন নাস্তা গ্রহণ করি ও বিরতি শেষে যথারীতি পাসিং আউট অনুশীলন প্যারেডে অংশগ্রহণ করি।
তিনি বলেন, পাসিং আউট প্যারেড চলাকালীন গত বছরের ৮ অক্টোবর আমরা যথারীতি মাঠে উপস্থিত হয়ে এলাইনমেন্টে দাঁড়াই। কিছুক্ষণ পর মাঠের দায়িত্বে থাকা আরআই স্যার মাইকে আমাদের পি.এ নম্বর ডেকে ২৫২ জনকে আলাদা করেন, তখন আসলে আমরা বুঝতে পারিনি কেন আমাদের আলাদা করা হচ্ছে। আলাদা করার পর আমাদের পরিহিত পাসিং আউট প্র্যাকটিসের পোশাক খুলে নেওয়া হয় এবং রেগুলার প্যারেডে অংশগ্রহণ করতে বলা হয়। একইসঙ্গে আমাদের জায়গায় তৎকালীন প্রশিক্ষণরত কনস্টেবলদের মাঠে আনা হয়। কারণ জানতে চাইলে বলা হয়, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ অনুযায়ী, আমরা ৪০তম এসপি ব্যাচের সমাপনী কুচকাওয়াজে অংশ নিতে পারবো না এবং আমাদের পাসিং আউট প্যারেডে অংশগ্রহণ করতে হবে। আমরা এটি মেনে রেগুলার প্যারেডে অংশগ্রহণ করি।
তিনি আরও বলেন, পরের দিন ৯ অক্টোবর দুপুরের ক্লাসে আমাদের ২৫২ জনকে শোকজ লেটার দেওয়া হয় এবং ৩ দিনের মধ্যে জবাব চাওয়া হয়। সে জবাব কর্তৃপক্ষ তাড়াহুড়ো করে দুই দিনের মধ্যেই নিয়ে নেয়। অথচ শোকজের বিষয় ছিল ১ অক্টোবরের নাস্তা না করার অভিযোগ। প্রশ্ন হলো, আমরা যদি ১ অক্টোবর নাস্তা গ্রহণ না করে থাকি তাহলে মাঝের ১ সপ্তাহ শোকজ না দিয়ে ৮ অক্টোবর আলাদা করার পর কেন শোকজ দেওয়া হলো। এরপর ১৮ অক্টোবর ৪০তম এসপি ব্যাচের পাসিং আউট প্যারেডের নিরাপত্তাজনিত কারণে আমাদেরকে ৫ দিনের বাধ্যতামূলক পি.এল. (পারমিশন লিভ) ছুটিতে পাঠানো হয়। অ্যাকাডেমির ইতিহাসে এর আগে এমন হয়েছে বলে আমাদের জানা নাই। এরপর ২১ তারিখ আবার নোটিশ পাঠিয়ে যাদের শোকজ করা হয় নি তাদেরকে একাডেমিতে ফেরত নেওয়া হয় এবং যাদের শোকজ দেওয়া হয়েছিল তাদের হাতে অব্যবহিত পত্র ধরিয়ে দেওয়া হয়।
রুবেল বলেন, অ্যাকাডেমির নিয়ম অনুসারে শৃঙ্খলা ভঙ্গের জন্য কাউকে চাকরিচ্যুত করতে হলে কিছু সুনির্দিষ্ট আইনি নিয়ম কানুন মেনে চলতে হয় যেমন যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে তাদের শোকজের জবাবের ভিত্তিতে একটা তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়, যাচাই-বাছাই হয়, অভিযুক্তদের সাক্ষ্য নেওয়া হয়, তারপর প্রতিবেদন রিপোর্ট জমা দেওয়া হয়। প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে এমন কোন কিছুই ফলো করা হয় নি। এভাবে সুনির্দিষ্ট কোন কারণ ছাড়া, যাচাই-বাছাই ছাড়া চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়াটা কোন ভাবেই মেনে নিতে পারছি না।
তিনি আরও বলেন, এখন চাকরির জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরছি। ডিফেন্স থেকে অব্যাহতি পাওয়ায় সরকারি- বেসরকারি সব সেক্টরে চাকরি পাওয়াটা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় আমি ও আমার পরিবার মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েছি। আজ পুলিশের প্রশিক্ষণে যোগদান না করলে, আমার প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকতার চাকরিটা থাকতো। তাহলে এটলিস্ট ডাল ভাত খেয়ে সার্ভাইব করতে পারতাম। এখন আমি একূল-ওকূল দুই কূল হারিয়েছি। পরিবারের বড় সন্তান হিসেবে এখন আমার পরিবারের দায়িত্ব নেওয়া কথা, সেখানে আমি এখন পরিবারের বোঝা হয়ে আছি। বেকারত্ব, মাথায় ঋণের চাপ, ছোট ভাই গুলির অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ তথা আমার নিজের জীবনকে যে গভীর হতাশায় ডুবিয়ে দিয়েছেন এর চেয়ে মৃত্যু শ্রেয়। আমি ও আমার পরিবারের দায়ভার কে নিবে? কার কাছে চাইব বিচার?