
তেলের বাজারমূল্যসহ বেশ কিছু বিষয়ে মধ্যপ্রাচ্যের ধনী অথচ ছোট দেশ কুয়েতের ওপর নাখোশ ছিলেন ইরাকের প্রয়াত প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন। ১৯৯০ সালের ২ আগস্ট রাত ২টার সময়ে প্রায় ২ লাখ ইরাকি সৈন্য ৩০০টি ট্যাংক নিয়ে কুয়েত দখল করে। কুয়েতের ১৬ হাজার সেনার পক্ষে প্রায় কোনো প্রতিরোধই গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। খুব সহজেই একটি স্বাধীন দেশ দখল করে নেওয়ার এই ঘটনা রাতারাতি সারা বিশ্বে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছিল। সে সময় কুয়েতের আমির শেখ জাবির আল-আহমাদ আল-জাবির আল-সাবা, তাঁর মন্ত্রিপরিষদের সব সদস্য এবং লাখখানেক কুয়েতি দেশ ছেড়ে পালিয়েছিলেন। অধিকাংশই গিয়েছিলেন সৌদি আরবে।
জাতিসংঘে এ নিয়ে প্রস্তাব পাসের পর যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ১৯৯১ সালের ১৭ জানুয়ারি ইরাকে বিমান হামলা শুরু করে। অপারেশন ডেজার্ট স্টর্ম নামের অতি সংক্ষিপ্ত ওই যুদ্ধ শেষ হয় ২৮ ফেব্রুয়ারি। ১ মাস ১১ দিনের ওই যুদ্ধে ইরাকের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। বিশ্বের চতুর্থ বৃহৎ সামরিক বাহিনী থাকা সত্ত্বেও এমন পরাজয়ের বিষয়টি কল্পনাও করেননি সাদ্দাম হোসেন। ইরাকের পরাজয় ও কুয়েত দখলমুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে অভিযানের ইতি টানে মার্কিন সামরিক বাহিনী। কিন্তু কে জানত, অপারেশন ডেজার্ট স্টর্মে অংশ নেওয়া মার্কিন মেরিনদেরই ভিন্ন এক অভিযানে নামতে হবে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই। অভিযান শেষে সবাই তখন দেশে ফেরার দিন গুনছিলেন।
প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধ বিশ্ববাজারে তেলের বাজারকে অস্থির করে তুলেছিল। যুদ্ধের প্রতিক্রিয়ায় বিপাকে পড়েছিল অনেক ছোট অর্থনীতির দেশ। তবে এই যুদ্ধ বাংলাদেশের লাখো মানুষের জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছিল। অনেকের মনে প্রশ্ন উঠতে পারে, প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক কী? কেন মার্কিন সামরিক বাহিনীর ইতিহাসের সঙ্গে এখনো বাংলাদেশের নাম জড়িয়ে আছে? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে ফিরে যেতে হবে ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল।
মৃত্যু উপত্যকা বাংলাদেশ
১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল। সেদিন মধ্যরাতে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের উপকূলে ক্যাটাগরি ফোর বা ৪ মাত্রার সাইক্লোন। এখন পর্যন্ত পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি ধ্বংসের ছাপ রেখে যাওয়া এই ঝড়ের গতিবেগ ছিল অকল্পনীয়, ঘণ্টায় আড়াই শ কিলোমিটার। এমন গতির কাছে যেকোনো কাঠামোই তুচ্ছ। প্রবল বাতাসের সঙ্গে ছয় মিটার; অর্থাৎ প্রায় ২০ ফুটের মতো জলোচ্ছ্বাস আছড়ে পড়েছিল চট্টগ্রাম কক্সবাজার উপকূলে। এক রাতেই মৃত্যুবরণ করেছিল ১ লাখ ৩৮ হাজার মানুষ। ঘরহারা হয়েছিল এক কোটির বেশি। সদ্য স্বৈরাচারমুক্ত হওয়া বাংলাদেশে তখন বিএনপির নেতৃত্বাধীন নতুন সরকার। দেশের একটা অংশের অবকাঠামো, রেল, বিদ্যুৎ, টেলিকমিউনিকেশন একেবারেই ভেঙে পড়েছিল। এ অবস্থায় মৃত্যুর আশঙ্কা ছিল আরও লাখো মানুষের। যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ ঝড়ের ক্ষয়ক্ষতির জন্য দুঃখ প্রকাশ করে টেলিফোন করেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে। ৩ মে টেলিফোনে কথোপকথনের পরদিনই ক্ষয়ক্ষতি প্রত্যক্ষ করতে চট্টগ্রামে হাজির হয় মার্কিন সাহায্য সংস্থা ও সামরিক বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে গঠিত একটি দল। তাদের পাঠানো প্রতিবেদনের ভিত্তিতে উপসাগরে অবস্থান করা মার্কিন রণতরিগুলোকে বাংলাদেশের দিকে যাত্রার নির্দেশ দেন প্রেসিডেন্ট বুশ। শুরু হয় বিশ্বের সবচেয়ে বড় ত্রাণ তৎপরতা। এর নাম দেওয়া হয় অপারেশন সি অ্যাঞ্জেল।
ভিন্ন ভূমিকায় মরুঝড়ের সৈনিকেরা
১০ মে, ১৯৯১। যুক্তরাষ্ট্রের নৌসেনাদের এম্ফিবিয়াস টাস্কফোর্স (এটিএফ) তখন ইরাকযুদ্ধে অংশ নেওয়ার পর বঙ্গোপসাগর হয়ে দেশে ফিরে যাচ্ছিল। তাৎক্ষণিকভাবে সেই বহরকে বাংলাদেশে যেতে নির্দেশ দেন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ। মার্কিন মেরিন, নৌ, সেনাবাহিনী ও ইঞ্জিনিয়ারদের সমন্বয়ে প্রায় ৮ হাজার সদস্য ছিলেন সেই বহরে। বহরের নেতৃত্বের ভার দেওয়া হয় জাপানের ওকিনাওয়ায় অবস্থিত মার্কিন ঘাঁটির থ্রি মেরিন এক্সপেডিশনারি ব্রিগেডের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল হেনরি সি. স্টাকপোলকে। শুরু হয় বিশ্বের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ত্রাণ তৎপরতা। আর এই কাজে যুক্ত হয়েছিলেন চীন, জাপান, ভারত, পাকিস্তান, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশের ত্রাণকর্মীরা।
ইউএস মেরিন ক্রপসের হিস্টরি অ্যান্ড মিউজিয়াম ডিভিশন থেকে প্রকাশিত চার্লস আর স্মিথের লেখা অ্যাঞ্জেলস ফ্রম দ্য সি: রিলিফ অপারেশন ইন বাংলাদেশ নামের বইতে এই অভিযানের বিশদ বিবরণ পাওয়া যায়।
সেই বইতে উল্লেখ করা হয়, উপদ্রুত এলাকা ঘুরে আসার পর সমন্বিত ত্রাণব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য জেনারেল স্ট্যাকপোল ঢাকায় যান। এরপর বৈঠক করেন সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল নুরুদ্দিন খান, যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম বি মাইলামসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রধানের সঙ্গে। ত্রাণ তৎপরতাও শুরু হয় দ্রুত। মেরিন হেলিকপ্টার ও উভচর যানগুলো যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া সন্দ্বীপ, ভোলা, হাতিয়া, বাঁশখালী প্রভৃতি প্রত্যন্ত অঞ্চলে ত্রাণ নিয়ে যেতে শুরু করে।
সে সময়কার স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে এক সাক্ষাৎকারে স্ট্যাকপোল বলেছিলেন, ‘আমাদের প্রথম লক্ষ্য ছিল দুর্গত মানুষদের মৃত্যু প্রতিরোধ করা; দ্বিতীয় লক্ষ্য ছিল খাদ্য, পানি, ওষুধ, আশ্রয়কেন্দ্র তৈরির মাধ্যমে স্বাভাবিকতা ফিরে আনা; অর্থাৎ যত বেশি পারা যায় মানুষের জীবন বাঁচানো।’
কাছ থেকে দেখা
সে সময় সাপ্তাহিক সন্দ্বীপের হয়ে দুর্গত এলাকায় সংবাদ সংগ্রহের কাজ করছিলেন মোহাম্মদ শহীদুল ইসলাম। ২০১৯ সালে ‘কাছ থেকে দেখা, অপারেশন সি অ্যাঞ্জেল’ শিরোনামে দৈনিক প্রতিদিন–এর সংবাদে প্রকাশিত এক নিবন্ধে সেই সময়কার ত্রাণ তৎপরতার স্মৃতিচারণা করেন শহীদুল ইসলাম।
সেই নিবন্ধে শহীদুল উল্লেখ করেন, ‘মেরিন সেনাদের হেলিকপ্টারে চড়ে সরেজমিনে দেখলাম উপদ্রুত এলাকা। প্রথমে গেলাম সন্দ্বীপের কলেজ মাঠে। পরে অন্য স্থানগুলোতে। হেলিকপ্টারে লাইফ স্যুট পরতে এ সময় সহযোগিতা পেলাম মেরিন কর্নেল রেন্ডি এল ওয়েস্টের কাছ থেকে। দেশের প্রত্যন্ত দ্বীপগুলোতে মেরিনদের সঙ্গে আনা দ্রুতগামী উভচর যান এলসিএসির (ল্যান্ডিং ক্র্যাফট এয়ার কুশন) সাহায্যে ত্রাণসামগ্রী পৌঁছানোর কাজও কীভাবে করা হচ্ছে, তা–ও দেখলাম। দেখলাম, দূষিত পানিকে ওয়াটার পিউরিফিকেশন মেশিনের সাহায্যে মুহূর্তে বিশুদ্ধ করে পানের উপযোগী করা হচ্ছে।’
চার্লস আর স্মিথের লেখা বইয়ে উল্লেখ আছে, অপারেশন সি অ্যাঞ্জেলের মাধ্যমে প্রায় ২০ লাখ মানুষের কাছে খাদ্য পৌঁছানো হয়েছিল। এই খাদ্যের পরিমাণ ছিল চার হাজার টন। ২৬৬ হাজার গ্যালন বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা হয়েছিল। পাশাপাশি ১৫ হাজার গুরুতর অসুস্থ মানুষকে অস্থায়ী ফিল্ড হাসপাতালে রেখে দেওয়া হয়েছিল চিকিৎসা। সব মিলিয়ে সেই অভিযান না হলে আরও অন্তত ২ লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটত বলে মার্কিন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
‘অপারেশন সি অ্যাঞ্জেলের’ সার্বিক তদারকি করেছিলেন সে সময়কার মার্কিন রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম বি মাইলাম। এই অভিযান নিয়ে এক স্মৃতিকথা তিনি উল্লেখ করেন, ‘আজ পেছনে ফিরে তাকালে মনে হয়, বিপর্যয় (ট্র্যাজেডি) যখন আসে, তখন মানুষই পারে তাকে বিজয়ে পরিণত করতে।’
অপারেশন সি অ্যাঞ্জেল থেকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র বড় অভিজ্ঞতা অর্জন করে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৭ সালে ঘূর্ণিঝড় সিডরের সময় আবারও মার্কিন সহায়তা এসে পৌঁছায় বাংলাদেশে। আর ওই ত্রাণ কার্যক্রমের নাম রাখা হয় অপারেশন সি অ্যাঞ্জেল–২।