Image description

জম্মু-কাশ্মীরে গত সপ্তাহের সন্ত্রাসী হামলার দুদিন পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বিহারে ভাষণ দেন। ভাষণ হিন্দিতেই দিচ্ছিলেন। তবে একপর্যায়ে ইংরেজি বলতে শুরু করেন। ইংরেজিতে বলা সেই অংশটুকুকে তিনি পুরো বিশ্বের জন্য একটি বার্তা বলে উল্লেখ করেন।

মোদি বলেন, ‘ভারত প্রতিটি সন্ত্রাসী ও তাদের মদদ দাতাদের শনাক্ত করবে এবং খুঁজে বের করে শাস্তি দেবে। আমরা পৃথিবীর শেষপ্রান্ত পর্যন্ত তাদের ধাওয়া করব।’ মোদি খুব কমই ইংরেজি বলেন, এমনকি বিদেশে বা বিদেশি গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলার সময়ও হিন্দিতে বলার আগ্রহ বেশি। যাই হোক, এখন মোদি কীভাবে তাঁর প্রতিজ্ঞা পূরণ করেন, সেটাই দেখার অপেক্ষা।

গত ২৭ এপ্রিল ভারতীয় নৌবাহিনী দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র মহড়া চালিয়েছে। দেশটি বলেছে, তারা টানা পঞ্চমরাতের রাতের মতো পাকিস্তান থেকে আসা হালকা অস্ত্রের গুলির জবাব দিয়েছে। ভারত এখনো স্পষ্টভাবে প্রমাণ করতে পারেনি যে, গত ২২ এপ্রিলের হামলায় কারা জড়িত। পেহেলগামে ওই হামলায় ২৬ জন নিহত হন। পেহেলগাম মূলত মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মীরের এক জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র।

তবে স্থানীয় পুলিশ দুই পাকিস্তানি ও এক ভারতীয় সন্দেহভাজনকে খুঁজছে। ভারতীয় কর্মকর্তাদের দাবি, এই হামলার পেছনে পাকিস্তানের মদদ রয়েছে। ভারত ও পাকিস্তান উভয়ই কাশ্মীরকে নিজেদের বলে দাবি করে, যদিও নিয়ন্ত্রণ করে ভিন্ন ভিন্ন অংশ। পাকিস্তান এই হামলায় ভূমিকার কথা অস্বীকার করেছে। তবে অবসরপ্রাপ্ত ভারতীয় সামরিক ও নিরাপত্তা কর্মকর্তারা পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনীকেই দায়ী করছেন। তাদের দাবি, কাশ্মীরের জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে পাকিস্তানের দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে।

 

এ ছাড়া হামলার কিছু সময় পর দায় স্বীকার করেছিল অখ্যাত সংগঠন দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট (টিআরএফ)। কিন্তু পর দিনই এক্সে হ্যান্ডলে পোস্ট দিয়ে তারা বলে, টিআরএফকে এ ঘটনার সঙ্গে জড়ানোর বিষয়টি মিথ্যা এবং কাশ্মীরি প্রতিরোধ আন্দোলনকে কলঙ্কিত করতে সাজানো ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার প্রচারণার অংশ।

ভারতীয় কর্মকর্তারা দাবি করেছেন, টিআরএফ নামে এই নতুন সংগঠনের সঙ্গে পাকিস্তানভিত্তিক চরমপন্থী সংগঠন লস্কর–ই–তৈয়বার সম্পর্ক রয়েছে।

ভারত ইতিমধ্যেই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক পদক্ষেপ নিয়েছে। কিছু পাকিস্তানি কূটনীতিককে ভারত থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। সব পাকিস্তানি নাগরিককে দ্রুততম সময়ের মধ্যে ভারত ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। দুই দেশের একমাত্র সীমান্ত পারাপার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক অভিন্ন নদীর পানি ভাগাভাগি চুক্তিও স্থগিত করা হয়েছে।

জবাবে বেশ কয়েকজন ভারতীয় কূটনীতিককে বহিষ্কার করেছে পাকিস্তান। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য স্থগিত করেছে। ভারতীয় বিমান পরিবহন সংস্থাগুলোর জন্য পাকিস্তানের আকাশসীমা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কাশ্মীর সীমান্তে বিরোধপূর্ণ ঐতিহাসিক সিমলা চুক্তি থেকেও সরে আসার হুমকি দিয়েছে পাকিস্তান।

অবশ্য ২০১৯ সালে ভারত জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিলের পর থেকেই কূটনৈতিক, বাণিজ্যিক এবং ভ্রমণ সংযোগ এমনিতেই সীমিত ছিল। ফলে এসব পদক্ষেপের অনেক কিছুই প্রতীকী।

বড় প্রশ্ন হলো, ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কোনো সামরিক পদক্ষেপ নেবে কি না? ২০১৯ সালে কাশ্মীরের পুলওয়ামায় এক আত্মঘাতী বোমা হামলায় ৪০ ভারতীয় পুলিশ নিহত হয়। এরপর পেহেলগামের হামলাই ছিল কাশ্মীরে সবচেয়ে প্রাণঘাতী। এমনকি এটি ১৯৮৯ সালে কাশ্মীরে ভারতীয় নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু হওয়ার পর থেকে সেখানকার পর্যটকদের ওপর সবচেয়ে ভয়াবহ আঘাত।

পাকিস্তানকে সামরিক জবাব দেওয়ার ক্ষেত্রে নরেন্দ্র মোদির সরকার এরই মধ্যে দুটি নজির তৈরি করেছে। ২০১৬ সালে উরির ভারতীয় সামরিক ঘাঁটিতে হামলার ১১ দিন পর ভারত পাকিস্তান-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে আঘাত হানতে স্থলবাহিনী পাঠিয়েছিল। ২০১৯ সালে পুলওয়ামা হামলার ঠিক ১২ দিন পর পাকিস্তানের ভেতরে সন্দেহজনক অবস্থানে বিমান হামলা চালিয়েছিল ভারত। সেই হামলায় অবশ্য ভারতীয় বিমানবাহিনীর একটি যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয় এবং এক পাইলট পাকিস্তানিদের হাতে ধরা পড়েন। পরে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়।

কাশ্মীরে হামলার ঘটনার পর নরেন্দ্র মোদির ওপর এখন জনগণের, বিশেষ করে তাঁর কট্টর হিন্দুত্ববাদী সমর্থক গোষ্ঠী ও সামরিক ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার একাংশের চাপ বাড়ছে। দ্রুত সামরিক পদক্ষেপ, সম্ভাব্য ক্ষেপণাস্ত্র বা ড্রোন হামলার মতো কঠোর পদক্ষেপে যেতে তাঁকে চাপ দেওয়া হচ্ছে। গত ২৬ এপ্রিল মোদির দল বিজেপির আদর্শিক সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) প্রধান মোহন ভাগবত এক বক্তৃতায় রামায়ণের দৃষ্টান্ত টেনে বলেন, ‘এমন পরিস্থিতিতে রাজাকে অবশ্যই প্রজাদের রক্ষা করতে হবে।’

কিন্তু ভারতের কাছে আগ্রাসী সামরিক পদক্ষেপ নেওয়ার মতো উপায় খুবই সীমিত। কারণ এতে বড় সংঘাতের ঝুঁকি রয়েছে। এই দুই পারমাণবিক শক্তিধর প্রতিবেশী কাশ্মীর ইস্যুতে এর আগে দুটি যুদ্ধ এবং একটি সীমিত সংঘাতে জড়িয়েছে। পাকিস্তান স্পষ্টভাবে জানিয়েছে, ভারতের যেকোনো সামরিক পদক্ষেপের পাল্টা জবাব দেবে তারা। একে অপরের ওপর ক্ষেপণাস্ত্র হামলা বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। কারণ, সেই ক্ষেপণাস্ত্র বা ড্রোন পারমাণবিক নাকি প্রচলিত ওয়্যারহেড বহন করছে, তা নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যেই অনিশ্চয়তা থাকবে।

এর আগে, ২০১৬ ও ২০১৯ সালে পাকিস্তানে ভারতের সামরিক অভিযানগুলো দেশের অভ্যন্তরে জনপ্রিয়তা পেলেও সেগুলোর কৌশলগত ফলাফল প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। বিশেষ করে ২০১৯ সালের ঘটনা থেকে বোঝা যায়, এ ধরনের অভিযান কতটা অপ্রত্যাশিত হতে পারে। পাকিস্তান ভারতের একটি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করে এবং পাইলটকে আটক করে, যদিও কয়েক দিন পর তাঁকে অক্ষত অবস্থায় ফেরত দেওয়া হয়।

ভারতের কিছু অবসরপ্রাপ্ত সামরিক ও নিরাপত্তা কর্মকর্তা তাই আরও কৌশলী পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। ভারতের নতুন সক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে এটা করা যেতে পারে। এর মধ্যে সীমিত সামরিক পদক্ষেপও থাকতে পারে—সম্ভবত পাকিস্তান-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে জঙ্গি আস্তানায় স্থল ও বিমান হামলার সমন্বিত রূপ। ২০১৬ সালে ভারতীয় অভিযানের নেতৃত্ব দেওয়া অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল দীপেন্দ্র সিং হুদা একটি ভারতীয় টেলিভিশনকে বলেছেন, ‘সামরিক বিকল্প এখনো মজুত আছে। তবে ভারতের উচিত সময় নিয়ে এমন লক্ষ্যবস্তু বেছে নেওয়া যেখানে সাফল্যের সম্ভাবনা শতভাগ।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রতিশোধ ঠান্ডা মাথায় নেওয়াই ভালো।’ তাঁর মতে, ‘জনগণের ভাবাবেগে ভেসে গিয়ে আমাদের এখনই কিছু একটা করতে হবে—এমনটা ভাবা ঠিক নয়।’

আরও সুচিন্তিত প্রতিক্রিয়ার অংশ হিসেবে ভারত গোপন অভিযান বাড়াতে পারে এমন সম্ভাবনা রয়েছে। এর মধ্যে পাকিস্তানি ‘জঙ্গি’ নেতাদের হত্যার বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। ভারত যাদের বিরুদ্ধে ভারতীয় লক্ষ্যবস্তুতে হামলার অভিযোগ করে, তারাও এর লক্ষ্য হতে পারে। যদিও ভারত এমন কোনো কর্মকাণ্ড চালানোর কথা অস্বীকার করে এবং করবে।

তবে পাকিস্তানি কর্মকর্তাদের অভিযোগ ভিন্ন। তাদের অভিযোগ, ২০২১ সাল থেকে পাকিস্তানের ভেতরে এ ধরনের হামলা বেড়েছে। এর পেছনে ভারতের হাত রয়েছে। ২০২৩ সালে কানাডায় একজন শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদীকে হত্যার ঘটনা ঘটে। একই বছর আমেরিকায় আরেক শিখ নেতাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। আমেরিকান ও কানাডীয় কর্মকর্তারা এই ঘটনাগুলোতে ভারতীয় কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার অভিযোগ এনেছেন।

একই সময়ে, পাকিস্তানকে কূটনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন করতে ও দেশটির ওপর অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি করতে ভারত আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করতে পারে। এর মধ্যে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ৭০০ কোটি ডলারের আর্থিক সহায়তার পরবর্তী কিস্তি পেতে বাধা দেওয়ার প্রচেষ্টা অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। ভারত বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্ককে কাজে লাগানোর চেষ্টা করবে। ট্রাম্প প্রশাসন হামলার পর থেকে ভারতের প্রতি দৃঢ় সমর্থন ব্যক্ত করেছে। একই সময়ে ট্রাম্প প্রশাসনের কাছে প্রথম মেয়াদের তুলনায় এই মেয়াদে পাকিস্তানের গুরুত্ব কম।

ভারতীয় বিশেষজ্ঞদের মতে, এ ধরনের পদক্ষেপ পাকিস্তানকে শাস্তি দিতে বেশি সহায়ক হবে। এতে অপ্রত্যাশিত সামরিক সংঘাতের ঝুঁকিও কমবে। তাঁদের আশঙ্কা, পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল অসীম মুনির এই সংঘাতকে কাশ্মীরের দিকে আন্তর্জাতিক মনোযোগ আকর্ষণের সুযোগ হিসেবে দেখতে পারেন। এটি পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনীর প্রতি সমর্থন জোগাতে এবং কারাবন্দী বিরোধী নেতা ইমরান খানের জনপ্রিয়তা কমাতে সহায়ক হতে পারে। যেখানে পাকিস্তানের সামরিক নেতৃত্ব বেলুচিস্তানের পশ্চিমাঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতা বৃদ্ধির কারণে অভ্যন্তরীণ চাপের মুখে রয়েছে। তারা এই অস্থিরতার জন্য ভারতকে দায়ী করছে।

এরপরও, ভারত যতই কৌশলী পদক্ষেপ নিক না কেন, তা বড় ঝুঁকির জন্ম দেবে। পাকিস্তান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে অনেক বেশি নাজুক অবস্থায় রয়েছে এবং ২০১৯ সালের শেষ উত্তেজনার সময়ের চেয়ে এখন দেশটির ওপর পশ্চিমা চাপের প্রভাব তুলনামূলক কমই প্রতিভাত হবে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের বেসামরিক পদক্ষেপেরও অপ্রত্যাশিত পরিণতি হতে পারে। গত সপ্তাহে ভারত সিন্ধু পানিবণ্টন চুক্তি স্থগিত করার পর পাকিস্তান বলেছে, যেকোনো নদীর পানি আটকানো বা ঘুরিয়ে দেওয়ার যেকোনো ভারতীয় চেষ্টা যুদ্ধ ঘোষণা হিসেবে গণ্য হবে। পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এখনো বিদ্যমান, যা ভারত ও চীনের মধ্যে সীমান্তে চার বছরের অচলাবস্থা অক্টোবরে নিরসনের পর শুরু হওয়া সমঝোতা প্রক্রিয়াকে ধীর বা উল্টেও দিতে পারে। আগামী দিনে মোদি যে সিদ্ধান্তই নিন না কেন, এটি সবার জন্য একটি বিপজ্জনক মুহূর্ত হবে।