Image description
মরণবাঁধ ফারাক্কার ধ্বংসাত্মক প্রভাবে পদ্মা অববাহিকতার ১২টি জেলার ৩৮টি উপজেলা এলাকায় বছর বছর নদী ভাঙন তীব্র হচ্ছে। পদ্মা তীরবর্তী ও সংলগ্ন গ্রাম জনপদে বসবাসকারী এসব এলাকার প্রায় আড়াই কোটি মানুষ আকস্মিক বন্যা ও বাৎসরিক নদী ভাঙনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। 

১৯৭৫ সালের ২১ এপ্রিল গঙ্গা নদীর ওপর ভারতের ফারাক্কা বাঁধ চালুর পর ইতোমধ্যে প্রায় ৫০ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। এই সময়ে ফারাক্কার প্রভাবে ভাটিতে বাংলাদেশের প্রায় ২৫০ কিলোমিটার এলাকায় পদ্মার দুই তীর ও চরাঞ্চলে বসবাসকারী কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে নদী ভাঙন ও বন্যায়। ভাঙন থেকে বাঁচতে এসব মানুষ বারবার বসতভিটা সরিয়ে নিতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছেন। তারা পদ্মায় হারিয়েছে একমাত্র সহায়-সম্বল, বসতভিটা ও জমিজিরাত। 

 

এসব জমিজিরাত এখন নদীর বুকে বালুর আস্তরণে ঢাকা পড়ে আছে। নদী ভাঙনের শিকার মানুষ নিজের জন্মস্থান ত্যাগ করে চলে গেছে দূরপ্রান্তের কোনো অচেনা জনপদে। এক সময়ের সামর্থ্যবান গৃহস্থ ও কৃষক পরিণত হয়েছে দিনমজুরে। অন্যদিকে নদী ভাঙন ঠেকাতে গিয়ে বছর বছর রাষ্ট্রের ক্ষতি হচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা।

ভুক্তভোগীরা বলছেন, ফারাক্কা বাঁধ চালুর আগেও গঙ্গা-পদ্মা অববাহিকতায় নদী ভাঙনের প্রবণতা কম-বেশি ছিল। কিন্তু নদী ভাঙনের তীব্রতা ও ভয়াবহতা এতটা তীব্র ছিল না। ফারাক্কা বাঁধ চালুর পর থেকে পদ্মা অববাহিকায় নদী ভাঙনের তীব্রতা বেড়েছে ও পদ্মা নদী সর্বগ্রাসী হয়ে উঠেছে। নদী প্রবাহের স্বাভাবিক নিয়মে জমিজিরাত সহায় সম্বল নদীতে চলে গেলে কয়েক বছরের মধ্যে আবার পলিসমৃদ্ধ চর জেগে উঠে আবাদযোগ্য হয়ে যাওয়ার কথা। এসব চরে আবার জনবসতি গড়ে উঠার কথার ইতিহাস রয়েছে আদিকাল থেকে। কিন্তু গত ৫০ বছরে পদ্মা গর্ভে যে পরিমাণ গ্রাম জনপদ ও জমি বিলীন হয়েছে সেগুলো আর বাসযোগ্য জনপদ হয়ে ফিরে আসছে না সহজে। ফারাক্কার প্রভাবে পলি মাটির বদলে ভাটিতে স্রোতের টানে পদ্মার বুকজুড়ে শুধু আসছে কোটি কোটি টন বালু। বালুর আস্তরণে পদ্মার তলদেশ ভরাট হয়ে মরুভূমির রূপ ধারণ করেছে। মাঝখান দিয়ে সরু চ্যানেলে প্রবাহিত হচ্ছে এক সময়ের প্রমত্তা নদী পদ্মা।

ফারাক্কার ১৮ কিলোমিটার ভাটিতে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার পাঁকা ইউনিয়নের পাশাপাশি তিনটি গ্রাম বোগলাউড়ি, লক্ষ্মীপুর ও বাবপুর। পদ্মার উত্তর পাড়ের এসব গ্রামের মানুষ কয়েক বছর আগেও চার কিলোমিটার ভেতরে নদী গর্ভে বিলীন কয়েকটি গ্রামে বসবাস করতেন। বসতভিটা ও জমিজিরাত হারিয়ে এখন তারা সবাই সহায় সম্বলহীন নিঃস্ব।

বোগলাউড়ি গ্রামের বাসিন্দা নজরুল ইসলাম বলেন, এক দশক আগেও আমাদের সব কিছুই ছিল। বড় বড় ধানের পালা হতো। দুইখানা হাল ছিল। জমিজমা ছিল। নদী ভাঙনে সব হারিয়ে আমরা এখন দিনমজুর।

সম্প্রতি ফারাক্কার নিকটবর্তী পাঁকার বিশরশিয়া, নামোজগন্নাথপুর, দোভাগী, ঘুঘুডাঙ্গা, মনোহরপুর, হাসেনপুর, কানছিড়া, উজিরপুরসহ আরও কয়েকটি গ্রাম সরেজমিন দেখা গেছে, গত দুই দশকে নদী ভাঙনের শিকার শত শত পরিবার সহায় সম্বল হারিয়ে বেড়িবাঁধের নিচে গাদাগাদি করে বসবাস করছেন। তারা আশায় প্রহর গুনছেন যদি পদ্মায় হারিয়ে যাওয়া তাদের জমিজমা আবার জেগে উঠে।

উজিরপুর বালুঘাট এলাকার বাসিন্দা হাসান আলী বলেন, পদ্মার দুই কিলোমিটার ভেতরে উজিরপুর ও রাধাকান্তপুর নামের দুটি বর্ধিষ্ণু গ্রাম ছিল। অধিকাংশ পরিবারই ছিল স্বচ্ছল গৃহস্থ। পদ্মায় বসতভিটা বিলীন হয়ে অন্যদের মতো তারাও নদীপাড় থেকে খানিকটা দূরে সরে এসে বাড়ি করেছেন। নিঃস্ব এসব পরিবার বসবাস করছেন অন্যের জমি ভাড়া নিয়ে। ফারাক্কার প্রভাবে এখন আবার পদ্মার উজানের বিভিন্ন এলাকায় নদী ভাঙছে। আবার যদি ভাঙন শুরু হয়, এবার আর সরে যাওয়ার কোনো জায়গা নেই।

ফারাক্কার প্রভাবে পদ্মার নদী ভাঙনে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত জেলার একটি চাঁপাইনবাগঞ্জ। বর্তমানে এই জেলার পদ্মার উত্তর পাড়ের দুর্লভপুর ও মনাকষা ইউনিয়ন, পশ্চিম পাড়ের জোহরপুর, নারায়ণপুর, দক্ষিণ পাঁকা, আলাতুলি, চরবাগডাঙ্গা, দেবিনগর ও শাজাহানপুর এলাকার ৩০ কিলোমিটারব্যাপী নদী ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। 

ভাঙনের শিকার এসব এলাকার লক্ষাধিক মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছে। বিশেষ করে যেসব পরিবার উত্তর পাড়ের ভাঙনে তাড়া খেয়ে দক্ষিণ প্রান্তের চরে বসতি করেছিলেন সেসব চর গত কয়েক বছর ধরে ব্যাপক মাত্রায় ভাঙছে। বলছিলেন ভাঙন কবলিত পদ্মার নারায়ণপুর চরের বাসিন্দা সাদ্দাম আলী।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা কেন এতটা ভাঙনের শিকার জানতে চাইলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী এসএম আহসান হাবীব বলেন, ফারাক্কার নিকটবর্তী ডাউন পয়েন্ট পদ্মা ৬৫ কিলোমিটার গেছে এই জেলার ওপর দিয়ে। ফারাক্কার ১১৯ লকগেটের মধ্যে দক্ষিণের গেটগুলো যখন খোলা হয় তখন সরাসরি পানির ধাক্কা এসে লাগে পদ্মার উত্তর পাড়ের গ্রামগুলেতে। ফারাক্কার উত্তরের গেটগুলে খোলা হলে পদ্মার দক্ষিণ পাড়ে পানির চাপ বাড়ে। এভাবেই ভয়াবহ ভাঙনের শিকার হচ্ছে এই জেলার পদ্মা কূলবর্তী ২৫টি গ্রামের মানুষ। 

এছাড়া ফারাক্কার পানি একতরফা প্রত্যাহারের কারণে পদ্মার বুক বালির আস্তরণে ভরাট হয়ে গেছে। বর্ষাকালে ফারাক্কার সবগুলো লকগেট খুলে দেওয়া হয়। তখন একসঙ্গে বিশাল জলরাশির চাপ পড়ে পদ্মায়। কিন্তু তলদেশ ভরাটের কারণে পদ্মার পানি ধারণ ও প্রবাহের সক্ষমতা ৮০ ভাগই কমে গেছে। ফলে পদ্মার দুই কূল উপচে নদীকূলবর্তী গ্রামগুলোতে আকস্মিক জলস্ফীতি দেখা দিচ্ছে। এ সময়ে দুই পাড়ের অধিকাংশ গ্রামই বন্যায় প্লাবিত হয়ে ভাঙনের কবলে পড়ছে। শত শত বসতভিটা ও হাজার হাজার হেক্টর ফসলি জমি পদ্মা গর্ভে বিলীন হচ্ছে। 

পাউবোর এই কর্মকর্তা আরও বলেন, গত দুই দশকে পাউবো শত শত কোটি টাকা খরচ করে নদীতীর রক্ষায় বিভিন্ন প্রকল্প নিয়েছে। এক এলাকা রক্ষা করা হলে পরের বছর আরেক এলাকায় ভাঙন ছড়িয়ে পড়ছে। 

তিনি বলেন, আমি খবর নিয়ে জেনেছি শুধুমাত্র নদী ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শত শত পরিবার জন্মভিটা হারিয়ে পার্শ্ববর্তী রাজশাহীর বিভিন্ন এলাকা ছাড়াও নওগাঁ দিনাজপুর ঠাকুরগাঁওসহ উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় চলে গেছে। ওই এলাকায় গিয়ে তারা দিনমজুর কিংবা ফেরিওয়ালার মতো প্রান্তিক জীবন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন। একই দুর্বিষহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছে ভাটি অঞ্চলের বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার মানুষ।

ফারাক্কার প্রভাবে পদ্মা তীরবর্তী রাজশাহী, নাটোর ছাড়াও ভাটিতে কুষ্টিয়া, পাবনা, ফরিদপুর, শরীয়তপুর, রাজবাড়ী, মাদারীপুর, মানিকগঞ্জ ও আরও ভাটিতে মুন্সীগঞ্জের মাওয়া পর্যন্ত এলাকায় গত চার দশকে নদী ভাঙনের শিকার হয়েছেন লাখ লাখ মানুষ। বর্তমানে রাজশাহীর গোদাগাড়ী, পবা, চারঘাট ও বাঘা এলাকা ছাড়াও কুষ্টিয়ার দৌলতপুর, ভেড়ামারা, পাবনার ইশ্বরদী ও মানিকগঞ্জ এবং ফরিদপুর এলাকায় নদী ভাঙনের শিকার হচ্ছেন বহু মানুষ।

পাউবোর সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, গবেষণায় দেখা গেছে-নদী ভাঙনে শুধুমাত্র মানুষ সহায় সম্বল হারাচ্ছেন তা নয়, অর্থনৈতিক সক্ষমতা হারিয়ে দিনে দিনে দরিদ্র হচ্ছে। গবেষণা প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, এককালে পদ্মা উর্বর পলি বয়ে এনে নদীকূল তীরবর্তী অঞ্চলকে সমৃদ্ধ করতো। কিন্তু ফারাক্কার বাঁধের কারণে জলরাশির সঙ্গে এখন আসে শুধু বালু আর বালু। পানি প্রবাহ অবাধ না হওয়ায় পলি আটকে যায় ফারাক্কার উজানে। বালুর চেয়ে পলিমাটি ভারী হওয়ায় নিয়ন্ত্রিত জলরাশিতে ভাসতে পারে না। ফলে পদ্মার বুকে চরাঞ্চলগুলোতে এখন আর প্রচলিত কোনো ফসল ফলে না। এ কারণে চরাঞ্চলের মানুষকে বছরের বেশিরভাগ সময় খাদ্য সংকটে পড়তে হচ্ছে। তারা জীবিকার সন্ধানে চলে যাচ্ছে অজানা কোনো শহরে।

বিশিষ্ট নদী গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী বলেন, ফারাক্কা বাঁধ চালুর পর ১৯৭৫ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় সোয়া লাখ কোটি টাকা। বর্তমানে ফারাক্কার প্রভাবে বছরে বাংলাদেশের ১২ জেলার আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে ৫ হাজার কোটি টাকা করে। ক্ষতির মধ্যে নদী ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ ও জনপদ রয়েছে। ফারাক্কার কারণে বছর বছর পদ্মা গর্ভে বিলীন হচ্ছে-ঘরবাড়ি, ফসলি জমি, আমবাগান, স্কুল-কলেজ ও সড়কপথ। এতে নদী অঞ্চলের মানুষেরা অর্থনৈতিক সক্ষমতা হারিয়ে দরিদ্র হচ্ছেন।