Image description

পিরানহা মাছ দেশে নিষিদ্ধ। সমগোত্রের হওয়ায় পিরানহার মতো দেখতে পাকু মাছও দেশে নিষিদ্ধ করেছে সরকার।

তারপরও দেশের বিভিন্ন জায়গায় এই গোত্রের মাছের চাষ হচ্ছে। বাজারে বিক্রিও হচ্ছে। দামে তুলনামূলক সস্তা হওয়ায় বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষেরা এই মাছ কিনছেন।

গত শনিবার গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার গুমানিগঞ্জ ইউনিয়নের ফুলপুকুরিয়া এলাকার একটি পুকুর থেকে ২০ মণ নিষিদ্ধ পিরানহা জব্দ করা হয়। এই মাছ চাষের দায়ে পুকুরের মালিক আইয়ুব আলীকে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।

অভিযানের পর পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, স্থানীয় বাজারে প্রতি কেজি পিরানহা ১৫০ টাকায় বিক্রি হয়। সে হিসাবে ২০ মণের দাম দাঁড়ায় ১ লাখ ২০ হাজার টাকার মতো। জব্দ করা পিরানহা পরে উপজেলার বিভিন্ন এতিমখানা ও হাফিজিয়া মাদ্রাসায় বিতরণ করা হয়।

বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য ও গবেষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাংলাদেশে চাষ হওয়া পিরানহা গোত্রের মাছটি মূলত পাকু। রেড বেলিড পাকু নামেও মাছটি পরিচিত। পাকু আর পিরানহা একই গোত্রের মাছ। ২০০৮ সালে পাকু মাছকেও নিষিদ্ধ করে সরকার।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, দেশে পিরানহা গোত্রের যেসব মাছ চাষ ও বিক্রি হয়, তা জলজ বাস্তুতন্ত্রের জন্য কতটা ক্ষতিকর?

বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য ও গবেষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাংলাদেশে চাষ হওয়া পিরানহা গোত্রের মাছটি মূলত পাকু। রেড বেলিড পাকু নামেও মাছটি পরিচিত। পাকু আর পিরানহা একই গোত্রের মাছ। ২০০৮ সালে পাকু মাছকেও নিষিদ্ধ করে সরকার।

দেশের বাজারে একেক জায়গায় একেক নামে পাকু বিক্রি হয়। গায়ে লালচে রং থাকায় অনেক জায়গায় মাছটিকে ডাকা হয় ‘লাল চান্দা’ নামে। আবার রুপচাঁদার মতো আকৃতির জন্য মাছটিকে দেশের মধ্য ও উত্তরাঞ্চলে ডাকা হয় ‘রুপচাঁদা’ নামেও।

পিরানহা নিষিদ্ধ করার আগে দুই মাস গবেষণা করেছিল বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএফআরআই)। তবে পাকু নিয়ে কোনো গবেষণা হয়নি।

পিরানহা নিয়ে গবেষক দলের সদস্য ছিলেন বিএফআরআইয়ের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডুরিন আখতার জাহান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দেশের জলজ বাস্তুতন্ত্রের জন্য এই মাছ কতটা ক্ষতিকর, তা বুঝতে অ্যাকুয়ারিয়ামে থাকা পিরানহা নিয়ে গবেষণা করা হয়েছিল। রেড বেলিড পাকু নিয়ে কোনো গবেষণা হয়নি।

পিরানহা দলবদ্ধভাবে যেকোনো বড় প্রাণীকে নিমেষে সাবাড় করে দিতে পারে বলে জানান ডুরিন আখতার জাহান। তিনি বলেন, পিরানহা মাছটি সুস্বাদু। খেতে অসুবিধা হয় না। মাছটি বদ্ধ জায়গায় চাষ করলে নিরাপদ। কিন্তু সমস্যা হলো, দেশে বন্যা হয়, জলোচ্ছ্বাস হয়। তাই এই মাছ চাষ করা হলে যেকোনো সময় তা উন্মুক্ত জলাশয়ে, নদীতে চলে যেতে পারে। আর একবার যদি চলে যায়, তাহলে পুরো জলজ বাস্তুতন্ত্রের জন্য এই মাছ হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।

পিরানহা নিষিদ্ধ করার আগে দুই মাস গবেষণা করেছিল বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএফআরআই)। তবে পাকু নিয়ে কোনো গবেষণা হয়নি।

দেশি মাছ রক্ষার জন্য নিষিদ্ধ

মৎস্য অধিদপ্তরের উপপরিচালক (মৎস্যসম্পদ সংরক্ষণ শাখা) বরুণ চন্দ্র বিশ্বাস প্রথম আলোকে বলেন, পিরানহার যত প্রজাতি আছে, সব কটির বাজারজাত, চাষ ও পরিবহন মৎস্য সংরক্ষণ আইনে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

এখন এই প্রজাতির মাছের বেচাকেনা অনেক কমে এসেছে বলে দাবি করেন বরুণ চন্দ্র বিশ্বাস। তিনি বলেন, সস্তা হওয়ায় দেশে এই প্রজাতির মাছ চাষের একটা প্রবণতা তৈরি হয়েছিল। মৎস্য অধিদপ্তরের নিয়মিত অভিযানে তা কমে এসেছে। তবে এখনো কোথাও কোথাও চাষ হয়ে থাকতে পারে। দেশের খাল-বিল-নদীতে দেশীয় প্রজাতির মাছ রক্ষার জন্য এগুলো নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের ফুলপুকুরিয়া এলাকার একটি পুকুরে জাল ফেলে নিষিদ্ধ পিরানহা মাছ ধরে তা জব্দ করা হয়
গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের ফুলপুকুরিয়া এলাকার একটি পুকুরে জাল ফেলে নিষিদ্ধ পিরানহা মাছ ধরে তা জব্দ করা হয়ছবি: সংগৃহীত

রাজধানীর কারওয়ান বাজারের মাছ বিক্রেতা আকরাম উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই মাছ আগে বিক্রি করতাম। এহন করি না। পুলিশ আইসা ঝামেলা লাগায়। শুনছি এইটা নিষিদ্ধ। তাও সস্তা থাকায় লোকে কিনত।’

কারওয়ান বাজারে পাওয়া না গেলেও রাজধানীর শেওড়াপাড়ার অলি মিয়ার টেক বাজারসহ বিভিন্ন বাজারে পাকু মাছ বিক্রি হতে দেখা যায়। বাজারে চাষের রুই-কাতলা আকার ও মানভেদে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকায় বিক্রি হয়। অন্যদিকে প্রতি কেজি নিষিদ্ধ পিরানহা প্রজাতির মাছ বিক্রি হয় ১৫০ থেকে ২০০ টাকায়।

দেশের জলজ বাস্তুতন্ত্রের জন্য পিরানহা কতটা ক্ষতিকর মাছ, তা বুঝতে অ্যাকুয়ারিয়ামে থাকা পিরানহা নিয়ে গবেষণা করা হয়েছিল। রেড বেলিড পাকু নিয়ে কোনো গবেষণা হয়নি।
ডুরিন আখতার জাহান, বিএফআরআইয়ের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা

ভারতে পাকু মাছের চাষ বেড়েছে

যুক্তরাষ্ট্রের লুইজিয়ানা স্টেট ইউনিভার্সিটির অ্যাগ্রিকালচারাল সেন্টারের অধ্যাপক সি গ্রেগ লুটজ মৎস্য চাষবিষয়ক প্রসিদ্ধ ওয়েবসাইট ‘দ্য ফিশ সাইট’-এ একটি নিবন্ধ লিখেছেন। শিরোনাম ‘হোয়াই পাকু কুড বিকাম আ মেজর ফ্রেশওয়াটার অ্যাকুয়াকালচার কনটেইন্ডার’।

নিবন্ধে সি গ্রেগ লুটজ উল্লেখ করেন, ব্রাজিলে অন্যান্য মাছ, যেমন তেলাপিয়া, কার্পজাতীয় মাছ ও মাগুরের সঙ্গে পাকু চাষাবাদে (পলি কালচার) ভালো ফল পাওয়া গেছে। ভারতীয় মৎস্যচাষিরাও কার্পজাতীয় মাছের সঙ্গে পাকুর বেড়ে ওঠায় সমস্যা দেখেননি। এটা জানার পর ভারতে পাকু মাছের উৎপাদন বেড়ে গেছে।

সি গ্রেগ লুটজ আরও লিখেছেন, ১৯৮০ সাল থেকে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, তাইওয়ান, মেক্সিকো, চীন ও ফিলিপাইনে পাকু মাছের চাষ হয়ে আসছে। যদিও প্রাকৃতিক পরিবেশে অবমুক্ত করলে এই মাছের খাদ্যাভাসে বদল আসতে দেখা যায়। তখন ছোট জলজ উদ্ভিদের পরিবর্তে তারা কাঁকড়া ও অন্যান্য ছোট প্রজাতির মাছ খেয়ে ফেলে।

পিরানহার যত প্রজাতি আছে, সব কটির বাজারজাত, চাষ ও পরিবহন মৎস্য সংরক্ষণ আইনে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
বরুন চন্দ্র বিশ্বাস, মৎস্য অধিদপ্তরের উপপরিচালক (মৎস্যসম্পদ সংরক্ষণ শাখা)

পাকু-পিরানহার মিল-অমিল

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক জলজ ও স্থল প্রাণীবিষয়ক ওয়েবসাইট ‘পেটস অন মম’-এর তথ্য বলছে, দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন অববাহিকায় প্রথম পাওয়া পিরানহা ও পাকু দেখতে প্রায় একই রকমের। তবে দুটির মধ্যে আকার, রং ও আচরণে বেশ কিছু তফাত রয়েছে।

পিরানহার বৈজ্ঞানিক নাম ‘অস্টারিওপিস’। পাকুর ‘কলোসোমা ব্রাখিয়াপোমাম’। পিরানহা গোত্রে প্রায় ১ হাজার প্রজাতির মাছ আছে। পাকু পুরোপুরি পিরানহা না হলেও পিরানহা পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। তবে এটিকে পিরানহা বলে অনেকে ভুল করেন।

পিরানহা রাক্ষুসে স্বভাবের মাছ। মাংসাশী পিরানহার একটি ঝাঁক মিনিটের মধ্যে বড় কোনো প্রাণীকে কঙ্কালে পরিণত করতে পারে। অন্যদিকে পাকু মাছ ছোট জলজ উদ্ভিদ ও পোকামাকড় খেয়ে বাঁচে।

পেটস অন মম ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, পাকু মাছ এককভাবে চলে, নিজের এলাকা নিজেই রক্ষা করে। আর পিরানহা চলে ঝাঁক বেঁধে। জন্মের পর পাকু আর তার পোনারা আলাদা হয়ে যায়। কিন্তু পিরানহা ঝাঁক বেঁধে ডিম রক্ষা করে। জন্মের পর পোনা পিরানহারা ঝাঁকের সঙ্গে যোগ দেয়।

একেকটি পাকু মাছ ৩০ ইঞ্চির মতো লম্বা হতে পারে। সর্বোচ্চ ওজন হতে পারে ৫০ পাউন্ডের বেশি। পিরানহা ১৭ ইঞ্চির মতো বাড়ে। ওজন হতে পারে সর্বোচ্চ সাড়ে সাত পাউন্ডের মতো।

কবে দেশে আসে

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শামস মুহা. গালিব জানান, পাকু মাছের দাঁত দেখতে চারকোনা ও চ্যাপটা। অন্যদিকে পিরানহার দাঁত তিনকোনা, বেশ তীক্ষ্ণ।

শামস মুহা. গালিব বলেন, দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন অববাহিকায় প্রথম এই মাছ (পিরানহা ও পাকু) দেখতে পাওয়া যায়। চীন ও থাইল্যান্ড থেকে ২০০৩ সালের দিকে এই প্রজাতির মাছ বাংলাদেশে আসে। মূলত অ্যাকুয়ারিয়ামের শোভাবর্ধনের জন্য এই মাছ দেশে আনা হয়। যদিও চাষের পর্যায়ে এটা কখন ও কীভাবে এসেছে, সেটা নিয়ে বিস্তারিত জানা যায় না।

আকারগত মিল থাকায় দেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলে ‘রুপচাঁদা’ নামে পাকু মাছ বিক্রির একটা প্রবণতা দেখা যায়। যদিও এটি ব্যাপক পরিসরে চাষ হয় না বলে উল্লেখ করেন শামস মুহা. গালিব।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বিভাগের এই শিক্ষক আরও বলেন, ‘আমাদের নদী-জলাশয়ে অবমুক্ত হয়ে দেশীয় প্রজাতির মাছের জন্য সম্ভাব্য হুমকি তৈরি করতে পারে—এ বিবেচনায় পাকুকে মৎস্য অধিদপ্তর নিষিদ্ধ করেছে। এ মাছ এখনো আমাদের নদী-জলাশয়ে পাওয়া যায়নি। এটা চাষাবাদ করা যাবে কি না, তা নিয়ে বিস্তারিত গবেষণার প্রয়োজন আছে।’

প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন প্রথম আলোর গাইবান্ধা প্রতিনিধি।