Image description
জুলাই বিপ্লবের পর থেকে আন্ডারওয়ার্ল্ডের কৌশলেও পরিবর্তন এসেছে। আগে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু সদস্যকে হাত করে পরিকল্পিত জনরোষ সৃষ্টি করা হতো। তবে এখন শীর্ষ সন্ত্রাসীরা ভর করছে সাধারণ জনগণের ওপর।
কাউকে ‘শায়েস্তা’ করতে হলে তার বিরুদ্ধে গড়ে তোলা হচ্ছে জনরোষ। ওই জনরোষে পড়ে প্রাণ হারাচ্ছে মানুষ, যা অনেক সময় পূর্বপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড হিসেবেই সংঘটিত হচ্ছে। গণপিটুনির পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া অপরাধীদের লাপাত্তা হয়ে যাওয়ার ঘটনায় পুলিশের বিরুদ্ধে সহযোগিতার অভিযোগ রয়েছে। আবার কখনো কখনো রাজনৈতিক পরিচয়ে এসব ঘটনা ঘটানো হচ্ছে। সাম্প্রতি কয়েকটি ঘটনা অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের এমন কৌশলের বিষয়।
বিশ্লেষকদের মতে, এই ‘মব লিঞ্চিং’ কৌশলটি শীর্ষ সন্ত্রাসীদের পুরোনো ট্রেন্ডের আধুনিক রূপ। এক গ্রুপকে ঘায়েল করে আরেক গ্রুপের ফায়দা হাসিল এবং তৃতীয়পক্ষ ব্যবহার করে আক্রমণÑ এ যেন আন্ডারওয়ার্ল্ড সংস্কৃতিরই ধারাবাহিকতা।
সূত্র জানায়, অতীতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু সদস্য মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে এক গ্রুপকে ক্রসফায়ার, গুম বা আটক করে দিতেন। আবার কোনো কোনো সময় আটক রেখে অর্থ আদায়ের ঘটনাও ঘটেছে। কিন্তু সে জায়গায় এখন মব লিঞ্চিংয়ের নেতৃত্ব দিচ্ছে কারামুক্ত বা গোপনে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসী ও তাদের দলবল। মূলত প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে এমন কৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে তারা।
এ প্রসঙ্গে পুলিশের সাবেক উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) খান সাঈদ হাসান আমার দেশকে বলেন, ‘এটা আসলে ক্ষমতার বিষয় নয়, দায়িত্বের বিষয়। কোনো নাগরিক যদি ফৌজদারি সমস্যার সম্মুখীন হয়, তাহলে তার দায় রাষ্ট্রের এবং দায়িত্বে থাকা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর, পুলিশের, র‌্যাবের ও আদালতের।
এখানে ক্ষমতার কোনো বিষয় নয়। প্রত্যেকেরই রাজনৈতিক পরিচয় রয়েছে। সবাই কোনো না কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বা মতাদর্শের। কিন্তু রাষ্ট্রের কোনো আইনে কি বলা আছে যে বিএনপি পরিচয়দানকারী কাউকে গ্রেপ্তার করা যাবে না? তাহলে এই যে দেশকে যেসব অপরাধী অস্থিতিশীল করছে, তারা গ্রেপ্তার হচ্ছে না কেন? কোনো পুলিশ অফিসার যদি অপরাধীদের ধরতে না পারে তাহলে বুঝতে হবে তিনি (পুলিশ সদস্য) অপরাধীদের সহযোগিতা করছেন, নয়তো তিনি অযোগ্য।’
এদিকে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায়ও অনেক সময় মব তৈরির ঘটনা ঘটছে। এর মধ্যে ২০২৪ সালের ১০ ডিসেম্বর মতিঝিল পপুলার লাইফ ইন্স্যুরেন্স অফিসে চাঁদা দাবিতে সন্ত্রাসী হামলা চালায় ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবদলের সদস্য সচিব রবিউল ইসলাম নয়নের নেতৃত্বে একটি দল। ঘটনাটি সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়ে। আমার দেশ-এর অনুসন্ধানে জানা যায়, যুবদল নেতা ফারুক এ হামলায় লোকবল সরবরাহ করেন। জড়িত ছিলেন যুবদলকর্মী সাজিদ, রাজ ও মমিন বেপারী।
গত রমজান মাসে তারাবির সময়ও অস্ত্রের মহড়া ও গণধোলাইয়ের একাধিক ঘটনা ঘটে। ওই সব ঘটনায় গণপিটুনিকে কেন্দ্র করে পাল্টা খুনের ঘটনাও ঘটে। গত ৫ মার্চ সন্ধ্যায় বাপ্পী ও বিপুকে গণধোলাইয়ের একটি ভিডিও দৈনিক আমার দেশ-এর হাতে এসেছে। ওই ভিডিওতে দেখা যায়, গণধোলাইয়ে আহত বিপুর গায়ের পোশাক ছিঁড়ে ফেলছে উত্তেজিত জনতা। তার পাশে পাহারায় রয়েছে কয়েকজন পুলিশ।
এ বিষয়ে ডিবি পুলিশের ওয়ারী জোনের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) আমার দেশকে ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, তাৎক্ষণিকভাবে খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে তাদের উদ্ধার করে পুলিশ। গণধোলাইয়ে গুরুতর আহত হওয়ায় উন্নত চিকিৎসার জন্য তাদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইনের সহযোগী মাহফুজুর রহমান বিপু ও ক্যাশিয়ার মন্টুর নেতৃত্বে এলাকায় আধিপত্য বিস্তার ও অস্ত্রের মহড়াকে কেন্দ্র করে ওই গণপিটুনির ঘটনা ঘটে। ঘটনার সময় বিপু নিজেকে স্বেচ্ছাসেবক দলের কর্মী পরিচয় দেন। রাত সাড়ে ১২টার দিকে সেনাসদস্যরা ঘটনাস্থলে বিপুর ফেলে যাওয়া অস্ত্র উদ্ধার করেন। ওই সময় হাতিরঝিল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) কাছে বিষয়টি জানতে চাইলে বিপুকে আটক করে থানায় নেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেন। এমনকি অসংলগ্ন কথাবার্তাও বলেছিলেন এই পুলিশ কর্মকর্তা। গ্রেপ্তার হওয়া বিপু দুয়েকদিনের মধ্যেই আবার এলাকায় ফিরে যান। পরে বিপুকে গণপিটুনি দেওয়ার সঙ্গে জড়িত যুবদল নেতা আরিফও গণপিটুনির শিকার হন।
গত ২০ এপ্রিল রাত ১২টা ৪০ মিনিটের দিকে হাতিরঝিল এলাকায় ৩৬ নম্বর ওয়ার্ড যুবদলের সদস্য মো. আরিফকে কুপিয়ে ফেলে রেখে যায় সন্ত্রাসীরা। শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদের নির্দেশে বিপু, শুটার বাপ্পী, সেন্টু, শুটার নয়ন ও শুটার জামালের নেতৃত্বে ওই হামলা চালানো হয়। আরিফের মাথা লক্ষ্য করে গুলি করে শুটার নয়ন ও শুটার জামাল। গুলি তার মুখে বিদ্ধ হয়। পরে বাপ্পী তার মাথা ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে কোপ দেয় এবং তাকে মৃত ভেবে রাস্তায় ফেলে রেখে মোটরসাইকেলে পালিয়ে যায়। গত সোমবার সকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান আরিফ।
এ ঘটনায় বিপু, সুব্রত বাইনের ক্যাশিয়ার আরেক যুবদল নেতা জাফর ইমাম তরফদার মন্টুসহ প্রায় ১০ জনের বিরুদ্ধে হাতিরঝিল থানায় মামলা (নম্বর-১৮) দায়ের করেন আরিফের বোন রিমা। মামলার এজাহারে তিনি উল্লেখ করেন, শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত গ্যাংয়ের সদস্যরা আরিফকে পরিকল্পিতভাবে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি করে। মূলত এলাকায় আধিপত্য বিস্তার এবং মাদক ও চাঁদাবাজিতে বাধা দেওয়াকে কেন্দ্র করে তাদের মধ্যে বিরোধের সৃষ্টি হয়। পরে তাকে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে গ্যাংয়ের সদস্যরা গুলি করে।
ওই ঘটনায় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগের নতুন উপকমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান দৈনিক আমার দেশকে বলেন, ‘অপরাধী যেই হোক, অপরাধমূলক কাজ যেন করতে না পারে, সেজন্য আমাদের কঠোর নজরদারি রয়েছে। শীর্ষ সন্ত্রাসী, গডফাদার বা যেকোনো পরিচয়েই হোক, অপরাধ করলে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।’
সুব্রত বাইনের সহযোগী বিপুকে গ্রেপ্তার প্রসেঙ্গে তিনি বলেন, বিষয়টি তার জানা নেই। তবে বিষয়টি দেখবেন বলেও জানান ডিএমপির এই মুখপাত্র ।
গত ১৭ মার্চ রমজানের মধ্যে রাজধানীর শান্তিনগর এলাকায় চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগে যুবদল-ছাত্রদলের চার নেতাকে গণপিটুনি দিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেয় জনতা। গত ২০ এপ্রিল রাতে চাঁদাবাজির সময় কংয়েকজনকে হাতেনাতে আটক করেন স্থানীয় বাসিন্দারা। আটক ব্যক্তিরা হলেন- আল মাহমুদ রাজ, মাহিদুর জামান ওরফে মোহন হোসেন, নুর আলম ও মো. মাসুদ। ওই ঘটনায় রাজধানীর পল্টন থানায় একটি মামলা হয়েছে।
পুলিশ জানায়, যুবদল নেতা রবিউল ইসলাম নয়নের ঘনিষ্ঠ অনেকের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ পাওয়া গেছে। তারা হলেনÑ তপন, সজল, রনি শিকদার, মাসুদ রানা প্রমুখ। এই চার নেতা গ্রেপ্তার হওয়ার পর যুবদলের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘দলীয় পরিচয় ব্যবহারকারী এ ধরনের অপরাধীর প্রকৃত পরিচয় নিশ্চিত হয়ে সংবাদ প্রকাশের জন্য গণমাধ্যমে কর্মরত সাংবাদিক ও এ-জাতীয় অপরাধীর বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনি পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি আহ্বান জানাচ্ছে যুবদল।’
গত ৯ এপ্রিল কামরাঙ্গীরচরের সিলেটি বাজারে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে গণধোলাইয়ে নিহত হন মাসুদ ও নাদিম নামে দুই চাঁদাবাজ। আহত হন আরো দুজন।
মহানগর দক্ষিণের বিএনপি নেতা মনির হোসেন (সাবেক চেয়ারম্যান) জানান, এই চাঁদাবাজরা এখানে প্রায়ই চাঁদাবাজি করতে আসে। তিনি আরো জানান, গণপিটুনিতে দুজন নিহত হয়েছে আর একজন আহত হয়েছে। এই চাঁদাবাজরা লালবাগের শহীদবাগ এলাকার কুখ্যাত সন্ত্রাসী সোনাইয়ের অনুসারী।
অভিযোগ রয়েছে, ইন্টারপোলের রেড কর্নার নোটিসপ্রাপ্ত ও সরকারের পুরস্কার ঘোষিত শীর্ষ সন্ত্রাসীরা দেশে ফিরে রাজনৈতিক নেতাদের নাম ভাঙিয়ে ঢাকা মহানগর এলাকায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। তারা বিভিন্ন মাধ্যমে মব সৃষ্টিসহ টার্গেট করা ব্যক্তিকে হত্যায় নেতৃত্ব দিচ্ছে।