Image description

দেশের বিচার বিভাগে বর্তমানে সবচেয়ে সমালোচিত নাম এবিএম খায়রুল হক। সাবেক এই বিচারপতির বিরুদ্ধে অভিযোগের পাল্লাও বেশ ভারী। বিচারাধীন মামলার জট না কমিয়ে শেখ হাসিনাকে খুশি রাখাই ছিল তার অন্যতম কাজ। ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠায় নানান বিতর্কিত রায়ও দিয়েছেন কলমের খোঁচায়। বিনিময়ে পেয়েছেন বহু পুরস্কারও। খায়রুল হকের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি তার আসন কলঙ্কিত করলেও লাভের গুড় খেয়েছেন ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিধান বাতিল

২০১১ সালের ১০ মে। এদিন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধানসম্বলিত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের মৌখিক রায় দেন এবিএম খায়রুল। আপিল বিভাগের সংক্ষিপ্ত এ রায়ে আরও দুই মেয়াদে নির্বাচন করার পথ খোলা রাখা হয়। কিন্তু ভিন্নতা ছিল লিখিত রায়ে। মূলত শেখ হাসিনার মন জয় করতেই তিনি এ পথ বেছে নেন বলে অভিযোগ অনেকের। এ নিয়ে প্রশ্নও তুলেছিলেন দেশের ১১তম সাবেক প্রধান বিচারপতি মাহমুদুল আমিন চৌধুরী।

তথ্যমতে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিশেষ ব্যবস্থা বহাল রাখার পরামর্শ দেন তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমসহ শীর্ষ আইনজীবীরা। শুনানির সময় প্রয়াত জ্যেষ্ঠ আইনজীবী টিএইচ খানও বিরোধিতা করেন। কিন্তু এসবে মোটেও কান দেননি খায়রুল হক। বিভক্ত রায়েই বাতিল হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা। এমনকি পূর্ণাঙ্গ রায়ের আগেই ২০১১ সালের ৩০ জুন নবম সংসদে নির্দলীয় সরকারের বিধান বিলুপ্ত করে দেয় আওয়ামী লীগ সরকার।

সংবিধান থেকে বাদ দেওয়ার প্রায় ১৬ মাস পর প্রকাশিত হয় ৩৪২ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়। তখন খায়রুল হক আর প্রধান বিচারপতির আসনে ছিলেন না। কিন্তু সংক্ষিপ্ত রায়ে থাকা আরও দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে পারার কথাটি ছিল না। উল্টো সরকারের মেয়াদ শেষে সংসদ বহাল থাকার কথা যুক্ত করা হয় পূর্ণাঙ্গ রায়ে।

সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায়ে ছয়জনের মধ্যে তিনজনই খায়রুলের কথায় সায় দেন। এর মধ্যে বিচাপরতি এস কে সিনহা অন্যতম। আর রায়ের বিপক্ষে ছিলেন বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞা ও নাজমুন আরা সুলতানা। অবসরে যাওয়ার ১৬ মাস পর কোনো রায় পরিবর্তন করা দণ্ডনীয় অপরাধ বলে জানিয়েছেন আইন বিশেষজ্ঞরা।

যেভাবে ঘোরে ভাগ্যের চাকা

আইন পেশা শুরুর দীর্ঘ ২৫ বছর পর বদলাতে থাকে খায়রুলের ভাগ্য। ১৯৯৮ সালের এপ্রিলে হাইকোর্ট বিভাগের বিচারক হওয়ার মধ্য দিয়েই শুরু হয় তার যাত্রা। মূলত হাইকোর্ট বিভাগের চারটি বেঞ্চ পর পর শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা মামলার আপিল শুনানিতে বিব্রতবোধ করায় তাকে নিয়োগ দেন শেখ হাসিনা। সেদিনই এই হত্যা মামলার আপিল শুনানির জন্য উপস্থাপন করা হয়। এমনকি আপিলের রায়ে বিচারপতি রুহুল আমিনের সঙ্গে দ্বিমত জানিয়ে নিজের প্রভাব খাটিয়ে ঘুরিয়ে দেন পুরো রায়।

শেখ মুজিবকে ‘স্বাধীনতার ঘোষক’ করে রায়

খায়রুলের অপকর্ম এখানেই শেষ নয়, স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে জিয়াউর রহমানের নাম বাদ দিয়ে বানানো হয় শেখ মুজিবুর রহমানকে। ২০০৯ সালের ২১ জুন দেওয়া হয় বিতর্কিত এই রায়। সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি নিয়ে করা লিভ টু আপিলও না শুনে খারিজ করে দেন এই বিচারক।

ভাঙা হয় আইন অঙ্গনের প্রথা

২০১০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর প্রধান বিচারপতি হিসেবে শপথ নিয়েই আইন অঙ্গনের প্রথা ভাঙেন খায়রুল হক। তিনিই প্রথম সুপ্রিম কোর্টে প্রধান বিচারপতির দফতরে শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি টাঙান। অথচ এর আগে কোনো রাজনৈতিক নেতার ছবিই টাঙানো হয়নি।

ত্রাণ তহবিলের টাকার লোভ

বিচারকের আসনে থাকলেও সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলের টাকার লোভ সামলাতে পারেননি তিনি। চিকিৎসার কথা বলে এই তহবিল থেকে অর্থ নিয়েছেন একাধিকবার। খায়রুল হকের দফতরে ১০ লাখ টাকার চেক পৌঁছে দেন তৎকালীন এক তরুণ আইনজীবী। চেকটি পাওয়ার পর নিজের অ্যাকাউন্টে জমা দেওয়ার জন্য সুপ্রিম কোর্টের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে পাঠান তিনি। ২০০৯ সালের ২৭ জুলাই সোনালী ব্যাংকের সুপ্রিম কোর্ট শাখায় খায়রুল হকের ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে এ টাকা জমা হয়। ভবিষ্যতে প্রশ্ন ওঠার ভয়ে একই দিন তিনি ৯ লাখ টাকা তুলে ফেলেন।

আইনজীবী মনোয়ার হোসাইন সারাবাংলাকে বলেন, ‘দেশের বিচার বিভাগ ধ্বংসের অন্যতম কারিগর এবিএম খায়রুল হক। আইনবহির্ভূত বিভিন্ন রায় দিয়ে ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠায় তিনি শেখ হাসিনাকে সহযোগিতা করে গেছেন। মাঝে কলঙ্কিত হয়েছিল পুরো বিচার অঙ্গন। এছাড়া হাসিনার অনুগত থাকার কারণেই অবসরে যাওয়ার পরও পুরস্কার হিসেবে আইন কমিশনের চেয়ারম্যান দায়িত্ব পান তিনি।’

এই আইনজীবী বলেন, ‘শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকলে খায়রুলের পদও আমরণ থাকতো। তাকে সরানোর মতো অন্য কেউই ছিলেন না। শুধুমাত্র জুলাই-আগস্টের আন্দোলনের মুখে স্বৈরশাসকের পতনের পর তিনিও পদত্যাগে বাধ্য হন। এককথায় আওয়ামী লীগের আদেশ-নির্দেশে অন্যান্য বিচারকদেরও দাম দিতেন না এবিএম খায়রুল। দলীয় স্বার্থে সব অপকর্মই জায়েজ করতেন তিনি। তার কারণে বিচার বিভাগকে নিয়ে আঙুল তুলে কথা বলার সাহস করেন অনেকে।’

এ প্রসঙ্গে সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট ইমরুল কায়েস রানা সারাবাংলাকে বলেন, ‘শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট হওয়ার পথে অন্যতম সহযোগী কুশীলব হলেন খায়রুল হক। জুলাই-আগস্টে গণহত্যার দায়ে হাসিনা বাদে যদি অন্য কাউকে মূলহোতা হিসেবে বিচারের আওতায় আনতে হয়, তাহলে সাবেক এই প্রধান বিচারপতি হবেন এক নম্বর। তাকে অতি দ্রুত গ্রেফতার করা প্রয়োজন।’ কেননা নারকীয় হত্যাকাণ্ডের পেছনে তার সবচেয়ে বড় ভূমিকা রয়েছে বলেও মনে করেন তিনি।