
গুণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধান শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত সহকারী জাহাঙ্গীর আলমের অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধানে ৪০০ কোটি টাকার বেশি লেনদেনের তথ্য পাওয়ার কথা জানিয়েছে পুলিশ । পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ ( সিআইডি ) বলছে, জাহাঙ্গীরের অর্থসম্পদের পরিমাণ প্রচলিত ধারণার চেয়ে অনেক বেশি । দেশের ৯ টি ব্যাংক ও অবৈধ হুন্ডির মাধ্যমে দেশ-বিদেশে বিপুল অর্থ লেনদেনের প্রমাণ পাওয়ার পর জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে সিআইডি ।
দুর্নীতির বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে শেখ হাসিনা নিজে তাঁর এই সাবেক ব্যক্তিগত সহকারী‘ ৪০০ কোটি টাকার মালিক ' বলে মন্তব্য করেছিলেন । সিআইডির ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিট সূত্রে জানা গেছে , পাঁচ মাসের তদন্ত শেষে জাহাঙ্গীর আলমের ৪০০ কোটি টাকার বেশি অবৈধ লেনদেনের প্রমাণ পাওয়া গেছে । ইস্টার্ন ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক, ইউসিবি, মার্কেন্টাইল ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকসহ ৯ টি ব্যাংকে লেনদেন করেছেন জাহাঙ্গীর । এসব ব্যাংকে থাকা তাঁর হিসাবগুলো ইতিমধ্যে অবরুদ্ধ করা হয়েছে ।
জাহাঙ্গীর আলম নোয়াখালীর চাটখিলে স্কাই রি অ্যারেঞ্জ লিমিটেড নামের একটি বিকাশ ডিস্ট্রিবিউশন হাউসের মালিক । ১৫ বছর ধরে এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিপুল অঙ্কের ই- মানি সংগ্রহ ও পাচার করা হয়েছে বলে সিআইডি সূত্র জানিয়েছে । পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের একটি ডেভেলপার কোম্পানিতে অর্থ পাঠানোর প্রমাণ মিলেছে । জানতে চাইলে সিআইডির প্রধান অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক গাজী জসীম উদ্দিন আজকের পত্রিকাকে বলেন, পানি জাহাঙ্গীরের মামলা নিয়ে আলোচনা হয়েছে । ইতিমধ্যে তদন্তে অনেক তথ্য উঠে এসেছে । এ ঘটনায় মানি লন্ডারিং মামলার প্রস্তুতি চলছে ।
গত বছরের ১৪ জুলাই গণভবনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পিয়ন থেকে কোটি টাকার মালিক বনে যাওয়া এক ব্যক্তির প্রসঙ্গ টেনে বলেন , ' আমার বাসায় কাজ করা পিয়ন , যে এখন ৪০০ কোটি টাকার মালিক । হেলিকপ্টার ছাড়া চলে না ।' এরপর দেশজুড়ে আলোচনার ঝড় উঠলে জাহাঙ্গীর যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান ।
পরে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট জাহাঙ্গীর, তাঁর স্ত্রী এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করার নির্দেশ দেয় । নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সিআইডির তদন্ত-সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন , জাহাঙ্গীরের নামে যে ৪০০ কোটি টাকার আলোচনা ছিল, তা আসলে ভুল । দেশ-বিদেশে এর দ্বিগুণ সম্পদ রয়েছে তাঁর । সিআইডির অনুসন্ধানে উঠে এসেছে , জাহাঙ্গীরের স্ত্রী কামরুন নাহারের নামে রয়েছে ৭ কোটি ৩০ লাখ টাকার সম্পদ ।
এর মধ্যে ধানমন্ডিতে ২৩৬০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট, একটি গাড়ি, ৭৩ লাখ টাকার ব্যবসায়িক বিনিয়োগ ও ১ কোটি ১৭ লাখ টাকার ব্যাংক স্থিতি রয়েছে । জাহাঙ্গীরের নামে রয়েছে কৃষি ও অকৃষিজমি , মিরপুরে সাততলা ভবন , দুটি ফ্ল্যাট , মোহাম্মদপুর ও নিউমার্কেটে দোকান এবং চাটখিলে চারতলা বাড়ি । মাইজদীতে তাঁর পরিবারের আটতলা ভবন রয়েছে । এ ছাড়া চট্টগ্রামের কর্ণফুলী টানেলের পাশে রয়েছে ১০০ বিঘা জমি । জাহাঙ্গীরের স্ত্রীর নামে ধানমন্ডিতে ৫৫০০ বর্গফুটের বিলাসবহুল আরেকটি ফ্ল্যাট রয়েছে ।
৪০০ কোটির সিআইডি বলছে , নগদ ও ব্যাংক মিলিয়ে জাহাঙ্গীরের নামে রয়েছে ২ কোটি ৫২ লাখ টাকা , ডিপিএস ২ লাখ ৭৫ হাজার টাকা , এফডিআর ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা । স্ত্রী কামরুন নাহারের নামে রয়েছে ২৭ লাখ টাকার ব্যাংক স্থিতি , ১৮ লাখ টাকার ডিপিএস ও ৬ কোটি টাকার অংশীদারি বিনিয়োগ । জাহাঙ্গীরের মালিকানাধীন এ কে রিয়েল এস্টেট লিমিটেড নামের একটি ডেভেলপার কোম্পানির মাধ্যমে বিপুল অর্থ বিদেশে পাচার করা হয়েছে । দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় দাখিলকৃত হলফনামায় জাহাঙ্গীর উল্লেখ করেন, তাঁর নিজের আড়াই কোটি ও স্ত্রীর নামে সোয়া কোটি টাকা, বিলাসবহুল গাড়ি এবং কয়েকটি কোম্পানিতে কোটি টাকার শেয়ার রয়েছে । এ ছাড়া বছরে ৫০ লাখ টাকা আয় রয়েছে ।
জানা গেছে, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে আত্মগোপনে রয়েছেন জাহাঙ্গীর আলম । তাঁর বিরুদ্ধে থাকা অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানার জন্য যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি । জাহাঙ্গীর আলমের গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর চাটখিল উপজেলার নাহারখিল গ্রামে । তাঁর বাবা ইউনিয়ন পরিষদের কেরানি ছিলেন । জাহাঙ্গীর ১৯৯০-এর দশকে ধানমন্ডির সুধা সদনে আসা আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের পানি পান করানোর দায়িত্বে ছিলেন । এ থেকেই পানি জাহাঙ্গীর ' নামে পরিচিতি পান । আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত সহকারী পদে কর্মরত থেকে তদবির, টেন্ডারবাজি, নিয়োগ- বাণিজ্য থেকে টাকা বানাতে থাকেন বলে অভিযোগ রয়েছে ।
একটি ইপিজেডের ঝুট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি । জাহাঙ্গীর একপর্যায়ে নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতির পদে আসীন হন । স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশের রদবদলে তাঁর নির্দেশই ছিল চূড়ান্ত । সংসদ সদস্য হওয়ার আশায় নির্বাচনের আগে হেলিকপ্টারসহ বহর নিয়ে এলাকায় সভা - সমাবেশ করতেন । যদিও শেষ পর্যন্ত মনোনয়ন না পেয়ে সরে দাঁড়ান । ২০২৩ সালের ৬ ডিসেম্বর এক বিজ্ঞপ্তিতে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পর্ক নেই বলে জানানো হয় ।