
দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মমাফিক ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীরা বরাবর দাবি জানিয়ে আসলেও ছাত্র সংগঠনগুলোর ইচ্ছা-অনিচ্ছার কারণে সেই দাবি পূরণ হয়নি। বিগত আওয়ামী লীগের সরকারের সাড়ে পনেরো বছরে ছাত্রলীগের একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল ক্যাম্পাসগুলোতে। সাধারণ শিক্ষার্থীরা ওই ছাত্র সংগঠনের কাছে ছিলেন জিম্মি। কেউ কোনো অন্যায়ের প্রতিবাদ বা অধিকারের কথা বললে তার ওপর নেমে আসত নানা ধরনের নির্যাতন। ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সাধারণ শিক্ষার্থীদের বুকের ওপর থেকে ছাত্রলীগের সেই পাথর সরে যায়। উন্মুক্ত পরিবেশে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হবে-তারা আশায় বুক বাঁধেন। নির্দ্বিধায় ভোট দিতে পারবেন এমন আশাও তৈরি হয়। সেই প্রত্যাশার জায়গা থেকে গত ৮ মাস ধরে ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে ভোটের দাবিতে সোচ্চার সাধারণ শিক্ষার্থীরা। তবে ছাত্র সংগঠনগুলো সাধারণ শিক্ষার্থীদের আগ্রহের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে নির্বাচন ইস্যুতে প্রশাসনকে কোনো সময়সীমা বেঁধে দিচ্ছে না। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও অনেকটা নির্বিকার। এ নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে শিক্ষার্থীদের মাঝে। সম্প্রতি ঢাবির এক জরিপে উঠে এসেছে, ৯৬ শতাংশ শিক্ষার্থী ডাকসু নির্বাচন চান।
২০১৯ সালের ১১ মার্চ সর্বশেষ ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এরপর দীর্ঘ ছয় বছরেরও বেশি সময় অতিবাহিত হলেও নতুন নির্বাচন করতে পারেনি ঢাবি প্রশাসন। জুলাই অভ্যুত্থানের পর এই নির্বাচনের দাবির প্রেক্ষিতে ১৫ এপ্রিল ডাকসু নির্বাচনের টাইমলাইন ঘোষণা করে ঢাবি প্রশাসন।
এদিকে, বিগত ৩৬ বছরেও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়নি। এছাড়া জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩৩ বছর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৫ বছর এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিগত ২৭ বছর ধরে ছাত্র সংসদ নির্বাচন বন্ধ। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন ভিসি নিয়োগ দেয় অন্তর্বর্তী সরকার। স্বাভাবিক হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রম। তখন থেকে ঢাবিসহ অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়ে জোরালো দাবি তুলছেন। তাদের দাবির প্রেক্ষিতে বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ছাত্র সংসদ নির্বাচনের কার্যক্রম শুরু করে। এমনকি নির্বাচনের রোডম্যাপও ঘোষণা করে। কিন্তু অদৃশ্য কারণে তারা আবার গড়িমসিও শুরু করেছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। ঢাবির রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী নয়ন বলেন, শিক্ষার্থীদের ন্যায্য দাবি-দাওয়া আদায়, প্রতিভাবান ও যোগ্য নেতৃত্ব তৈরি, মুক্তবুদ্ধিচর্চা, জাতির ক্রান্তিলগ্নে অগ্রণী ভূমিকা পালন ও জাতি গঠনমূলক কাজে ছাত্র সংসদের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রয়েছে। দীর্ঘদিন ডাকসুসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দীর্ঘদিন ধরে ছাত্র সংসদ নির্বাচন না থাকায় আমরা সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত। শিক্ষার গণতান্ত্রিক পরিবেশও ব্যাহত হচ্ছে। আমাদের দাবি, অবিলম্বে ডাকসুসহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংসদ নির্বাচন দিতে হবে।
এ বিষয়ে ছাত্র দলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন নাছির যুগান্তরকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়সহ উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নির্বাচনের আগে কিছু সংস্কার করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা আওয়ামীপন্থি শিক্ষক ও ছাত্রলীগের অপকর্মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। ইতোমধ্যে ডাকসু নির্বাচন নিয়ে আমরা একটা প্রস্তাবনা দিয়েছি। প্রশাসন এই সংস্কার করে দ্রুত নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করবে বলে আমরা আশাবাদী।
ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি জাহিদুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, শিক্ষার্থীরা দীর্ঘদিন তাদের স্বাধীন মতপ্রকাশ করতে পারেনি। এখন তারা মতপ্রকাশ করতে পারছে, এটি আরও জোরালো করার জন্য ছাত্র সংসদ নির্বাচন প্রয়োজন। আমরা দ্রুত সময়ের মধ্যে ছাত্র সংসদ নির্বাচন চাচ্ছি। নির্বাচনের জন্য নির্দিষ্ট সময় সীমা বেঁধে দেবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করার দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের।
বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের কেন্দ্রীয় কমিটির আহ্বায়ক আবু বাকের মজুমদার যুগান্তরকে বলেন, এপ্রিল মাসের মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্র সংসদ নির্বাচনের তফশিল ঘোষণা করা উচিত। আর আগামী মে মাসের মধ্যেই ডাকসুসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ছাত্র সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন করতে হবে।
সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের কেন্দ্রীয় সভাপতি সালমান সিদ্দিকী যুগান্তরকে বলেন, গণঅভ্যুত্থানের মূল আকাঙ্খা ছিলো গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ। আর গনতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হওয়া জরুরি।
গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি ও ডাকসুর ভিপি নুরুল হক নুর যুগান্তরকে বলেন, সব বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে শিক্ষার গুণগত মান ও পরিবেশ ধরে রাখতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন খুব দ্রুত হওয়া উচিত। বর্তমানে ছাত্র সংসদ নির্বাচন আয়োজনের জন্য সবচেয়ে ভালো সময়।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক এস এম এ ফায়েজ যুগান্তরকে বলেন, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর আমরা নতুন একটা দেশ পেয়েছি। গণতান্ত্রিক অধিকার চর্চার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীরা ছাত্র সংসদ নির্বাচনের প্রত্যাশা করবে, এটাই স্বাভাবিক। অবিলম্বে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হোক, আমরা সেটিই চাইব।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যায় : শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনের সময়রেখা ঘোষণা করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এ নিয়ে আগামী মে মাসের শুরুর দিকে নির্বাচন কমিশন গঠন করার কথা রয়েছে। সে অনুযায়ী মে মাসের শেষের দিকে বা জুনের মাঝামাঝি যে কোনো দিন নির্বাচনের সম্ভাব্য তারিখ সামনে রেখে কাজ করছেন বলে জানিয়েছেন ডাকসুর গঠনতন্ত্র সংশোধন কমিটির সদস্য ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সাইফুদ্দীন আহমদ। তিনি যুগান্তরকে বলেন, বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯৬ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী ডাকসু নির্বাচন চাচ্ছেন। ইতোমধ্যে ডাকসু নির্বাচনের টাইমলাইন ঘোষণা করা হয়েছে। আশা করছি, শিগগির নির্বাচন কমিশন নিয়োগ দেবে প্রশাসন। কবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে পারে এই বিষয়ে তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশনের এটি ঘোষণা করার এখতিয়ার আছে। এজন্য নির্দিষ্ট করে নির্বাচনের দিন-তারিখ বলা সম্ভব নয়।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় : চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) দীর্ঘ প্রায় ২৫ বছর কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) নির্বাচন হচ্ছে না। বিভিন্ন সময়ে উপাচার্যরা নির্বাচনের আশ্বাস দিলেও তা আলোর মুখ দেখেনি। ১৯৬৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রথম ২৪ বছরে ৬ বার চাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। তবে এর পরের ৩৫ বছরে একবারও এ নির্বাচনের কার্যকর উদ্যোগ দেখা যায়নি। তবে, বর্তমান প্রশাসন চাকসু নির্বাচন নিয়ে কিছু উদ্যোগ নিলেও এখনো পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা প্রদান করতে পারেনি। জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের পর চাকসু নির্বাচনের স্বপ্ন দেখছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। কিন্তু প্রশাসনের কার্যকর উদ্যোগ নেই।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় : তিন দশকের বেশি সময়ের পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) নির্বাচনের হাওয়া বইতে শুরু করেছে। যদিও ১ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনের তফশিল ঘোষণার কথা থাকলেও ছাত্রদলের পক্ষ থেকে জাকসুর গঠনতন্ত্র সংস্কারের দাবির প্রেক্ষিতে পিছিয়ে যায় তফশিল ঘোষণা। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলছে, শিক্ষার্থীদের দাবিকে সামনে রেখে মে মাসে নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সেই অনুযায়ী প্রস্তুতিও শুরু হয়েছে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় : ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন উপাচার্য দায়িত্ব গ্রহণ করে ৫ মাসের মধ্যে ছাত্র সংসদ নির্বাচন (রাকসু) দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। তবে ওই সময়ের মধ্যে রাকসু নির্বাচন নিয়ে প্রশাসনের তেমন কোনো অগ্রগতি লক্ষ্য যায়নি। পরে বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের দাবির মুখে প্রায় ৬ মাস পর ফেব্রুয়ারিতে রাকসুর রোডম্যাপ প্রকাশ করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃ পক্ষ। পথনকশা অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ে রাকসুর গঠনতন্ত্র সংশোধনীর পরামর্শ নেওয়া হলেও প্রকাশ করা হয়নি চূড়ান্ত বিধিমালা ও নির্বাচনের আচরণবিধি। এতে জুনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে কিনা তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন ছাত্রনেতারা।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় : দীর্ঘ ২৭ বছর ধরে অকার্যকর হয়ে আছে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (শাকসু)। ফলে শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবি আদায়ে নেই কোনো প্ল্যাটফর্ম। এতে অধিকার আদায়ে প্রতিনিয়ত ভোগান্তির সম্মুখীন হচ্ছেন বলে অভিযোগ শিক্ষার্থীদের। তারা দাবি করেছেন, দ্রুততম সময়ে যেন শাকসু গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে প্রশাসন। সর্বশেষ নির্বাচন হয়েছিল ১৯৯৭ সালের ২৫ আগস্ট। এরপর সারা দেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো শাবিতেও ছাত্র সংসদের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় : এদিকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জকসু) নির্বাচনের জন্যও জোর দাবি জানিয়ে আসছেন শিক্ষার্থীরা। সর্বশেষ সিন্ডিকেট সভায় জকসু নীতিমালা অনুমোদিত হওয়ার আড়াই মাস পার হলেও শুরু হয়নি নির্বাচনের কার্যক্রম। প্রতিষ্ঠাতার ২০ বছরে পার হয়ে গেলেও এখনো ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়নি।
(এই প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন জাবি প্রতিনিধি-মোসাদ্দেকুর রহমান, চবি প্রতিনিধি-রোকনুজ্জামান, রাবি প্রতিনিধি-ইরফান তামিম, শাবি প্রতিনিধি-জুবায়েদুল হক রবিন, জবি প্রতিনিধি-সাকেরুল ইসলাম)।