
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাত রাজ্যের সঙ্গে মূল ভূখণ্ডের যোগাযোগের জন্য বাংলাদেশকে করিডোর হিসেবে ব্যবহার করার সুযোগ করে দিয়েছে পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটির আড়ালে ভারত সামরিক সরঞ্জামও পরিবহন করতে পারে।
এমনকি পাহাড়ি ও ভারতীয় চরদের মাধ্যমে দেশকে অস্থিতিশীল করতেও অস্ত্র সরবরাহের আশঙ্কা রয়েছে। চীনের বিরুদ্ধেও এই পথ ব্যবহার করে ভারত আগ্রাসন চালাবে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী ট্রানজিট ফি যেখানে ১৭৫ টাকা, সেখানে ভারতের সঙ্গে হওয়া চুক্তিতে মাত্র দেড় টাকা করার পরিকল্পনা ছিল। দেশবিরোধী এই চুক্তি বাতিলের দাবি উঠেছে সর্বত্র।
নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে সম্প্রতি ভারত এই প্রকল্পের কাজ স্থগিত করলেও তা বাতিল করেনি। বিশেষজ্ঞদের মতে, নির্বাচিত সরকার এলে এই প্রকল্পের কাজ আবার এগিয়ে নিয়ে যাবে। তবে তারা সতর্ক করে বলেছেন, কোনো সরকার যেন হাসিনার পক্ষ থেকে করা এই দেশবিরোধী চুক্তি বাস্তবায়নে এগিয়ে না যায়। তারা পরামর্শ দিয়েছেন, এমন চুক্তি জনগণের স্বার্থের পরিপন্থী এবং জাতীয় নিরাপত্তার জন্য ক্ষতিকর হতে পারে, তাই ভবিষ্যতে কোনো সরকারকে এই প্রকল্পের কাজ চালু না করার জন্য সজাগ থাকতে হবে।
২০২৪ সালে ভারতে গিয়ে শেখ হাসিনা দশটি সমঝোতা স্মারকে সই করেন। সেগুলোর একটি হচ্ছে রেল ট্রানজিট। এটি বাস্তবায়ন হলে দেশের ভূ-খণ্ড ব্যবহার করে রেলযোগে দেশের এক অংশ থেকে আরেক অংশে সরাসরি নিজেদের পণ্য পরিবহনের সুবিধা পাবে ভারত। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলো থেকে পণ্য ও মালামাল আনা-নেওয়ার ক্ষেত্রে বেশ বেগ পেতে হয় ভারতকে। মাঝখানে বাংলাদেশ থাকায় দেশের অন্য অংশের সঙ্গে রাজ্যগুলোর পণ্য পরিবহন বেশ ব্যয়বহুল এবং সময়সাপেক্ষ ছিল ভারতের।
সেই কারণেই দেশের কাছে পণ্য ট্রানজিট সুবিধা চেয়ে আসছিল ভারত। কয়েক বছর আগে দুটি রুটে পণ্য পরিবহনের অনুমতি বা ট্রানজিট দেয় বাংলাদেশ। তবে ওই চুক্তির আওতায় ভারতের মালবাহী ট্রেন বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে সরাসরি যেতে পারত না, বরং বাংলাদেশ সেগুলো ভারতীয় সীমান্তের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে পৌঁছে দেয়। কিন্তু নতুন সমঝোতা চুক্তি বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে রেলযোগে ভারত সরাসরি নিজেদের পণ্য ও মালামাল পরিবহনের সুবিধা পাবে।
পাহাড়ি ও ভারতীয় চরদের অস্ত্র সরবরাহের আশঙ্কা
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্যÑ আসাম, নাগাল্যান্ড, মণিপুর, ত্রিপুরা, মিজোরাম, মেঘালয় ও অরুণাচল প্রদেশ। দীর্ঘদিন ধরেই বিচ্ছিন্নতাবাদ ও সশস্ত্র সংঘাতের জন্য পরিচিত। ভারতীয় সেনাবাহিনী সেখানে বারবার সামরিক অভিযান চালিয়ে আসছে। সমঝোতা চুক্তি হওয়ার পর বর্তমান পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বিবিসি বাংলাকে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছিলেন, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের যেসব রাজ্যে দীর্ঘদিন ধরে অস্থিরতা বিরাজ করছে, সেসব অভিযানে ভারত হয়তো এই রেলপথ ব্যবহার করতে চাইবে।
আরো আশঙ্কাজনক বিষয় হচ্ছে, এই ট্রানজিট ব্যবস্থার আড়ালে স্বয়ং বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করতে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী এবং ভারতের নিয়ন্ত্রিত চরেরা অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম পেতে পারে। দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশের পাহাড়ি অঞ্চলে এমন বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতা রয়েছে, যেখানে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার পৃষ্ঠপোষকতা থাকার অভিযোগও রয়েছে। ট্রানজিট ব্যবস্থায় নজরদারির দুর্বলতা থাকলে এই অস্ত্র ও রসদ দেশের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ার সম্ভাবনা অস্বীকার করা যায় না।
অন্যদিকে ভারত-চীন সীমান্তে উত্তেজনা বাড়লে ভারত এই রুটকে সামরিক লজিস্টিক করিডোর হিসেবে ব্যবহার করতে চাইবে। এতে কেবল বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহারের ঝুঁকি নয়, বরং কূটনৈতিক ভারসাম্যও নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হবে।
আন্তর্জাতিক মান ১৭৫ টাকা, হাসিনার চুক্তি মাত্র দেড় টাকা
ভারতের পণ্য পরিবহনের জন্য বাংলাদেশ যে ট্রানজিট ফি নির্ধারণ করেছে, তা আন্তর্জাতিক মানের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কম। ২০২৩ সালের এপ্রিল মাসে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড একটি গেজেট প্রকাশ করে, যেখানে ভারতের পণ্যবাহী ট্রেন বা যানবাহনের জন্য নির্ধারিত হয় প্রতি কিলোমিটার প্রতি টনে ১.৮৫ টাকা।
অথচ আন্তর্জাতিক মান বিবেচনায় ইউরোপীয় দেশগুলো সাধারণত প্রতি টন প্রতি কিলোমিটারে ৮ থেকে ১৫ ইউরো সেন্ট ফি আদায় করে, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় আনুমানিক ৯৪ থেকে ১৭৬ টাকার সমান। অন্যদিকে মধ্য এশিয়ার দেশগুলোতে এই হার গড়ে ১২ থেকে ৩০ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। এই তুলনামূলক বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায়, বাংলাদেশের প্রস্তাবিত হার আন্তর্জাতিক গড়ের তুলনায় ৮ থেকে ১০ গুণ কম।
একটি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি আরো পরিষ্কার করা যায়। ধরা যাক, একটি ভারতীয় ট্রেন ১,০০০ টন পণ্য নিয়ে দেশের মধ্য দিয়ে ২০০ কিমি দূরত্ব অতিক্রম করছে। বাংলাদেশ বর্তমানে এই ট্রিপ থেকে আয় করবে প্রায় ৩ লাখ টাকা (১,০০০×২০০×১.৫)। অথচ যদি আন্তর্জাতিক গড় হার (১৫ টাকা/টন/কিমি) অনুযায়ী ফি নির্ধারিত হতো, তাহলে সেই একই ট্রিপ থেকে বাংলাদেশ আয় করত প্রায় ৩০ লাখ টাকা।
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ড. মইনুল ইসলাম বলেন, ভারতের প্রতি শেখ হাসিনার দৃষ্টিভঙ্গি আমার কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না। এই দৃষ্টিভঙ্গির কারণে সস্তায় মাশুলগুলো নির্ধারিত ছিল।
যাতায়াতে ২৫০ কিলোমিটার পথ কম
ভারতের সেভেন সিস্টার্স রাজ্যগুলোর সঙ্গে মূল ভূখণ্ডের সংযোগের জন্য বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান অত্যন্ত সুবিধাজনক। পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা থেকে অসমের গৌহাটি পর্যন্ত সড়কপথ সাধারণত প্রায় ১,০০০ কিলোমিটার হলেও, বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে শিলচর হয়ে গেলে সেই দূরত্ব কমে প্রায় ৭৫০ কিলোমিটারে দাঁড়ায়। ফলে প্রায় ২৫০ কিলোমিটার পথ কমে যায়।
গৌহাটি থেকে ত্রিপুরার আগরতলা যেতে স্বাভাবিক রুটে ৬০০ কিলোমিটার লাগে, যেখানে বাংলাদেশ হয়ে গেলে দূরত্ব কমে ৪০০ কিলোমিটারে, অর্থাৎ ২০০ কিলোমিটার কম। একইভাবে, মেঘালয়ের শিলং থেকে কলকাতা যাওয়ার স্বাভাবিক পথ প্রায় ১,২০০ কিলোমিটার, কিন্তু বাংলাদেশের গেদে বা শ্রীপুর হয়ে গেলে তা কমে দাঁড়ায় ৯৫০ কিলোমিটার, এতে করে প্রায় ২৫০ কিলোমিটার কমে যায়।
মিজোরাম থেকে বাংলাদেশের সিলেট হয়ে যোগাযোগ করলে পাহাড়ি জটিল পথ এড়িয়ে ৬০০ কিলোমিটারের জায়গায় ৫০০ কিলোমিটারে পৌঁছানো সম্ভব হয়, অর্থাৎ ১০০ কিলোমিটার কম। সার্বিকভাবে, বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করলে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে যাতায়াতে ২০০ থেকে ২৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত দূরত্ব কমানো যায়, যা সময় ও খরচ উভয় দিক থেকেই ভারতকে বিপুল সুবিধা দিচ্ছে।
দেশবিরোধী এই চুক্তি বাতিলের দাবি
ইতোমধ্যে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে তাদের সব ট্রানজিট সুবিধা বাতিলের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারাও দাবি তুলেছেন ভারতের সঙ্গে হওয়া সব চুক্তি বাতিলের।
আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. এম শাহিদুজ্জামান আমার দেশকে বলেন, ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পালানোর পর আপাতত এসব চুক্তি বাস্তবায়ন হচ্ছে না, এই চুক্তি দেশবিরোধী। পরবর্তী সরকারকেও এই বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে।
রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. আফজাল হোসেন বলেন, গত বছরের জুলাইয়ে পরীক্ষামূলক চালুর পরিকল্পনা ছিল। তবে ৫ আগস্টের পর এই কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছে। শুধু এটি নয়, ভারত-বাংলাদেশের কোনো ট্রেনই এখন চলছে না। ভবিষ্যতে চালুর কোনো পরিকল্পনা এই অন্তর্বর্তী সরকারের আছে কি-না? এমন প্রশ্নের কোনো উত্তর দেননি তিনি।