
মঙ্গলবারের ঘটনাটিতে এখন পর্যন্ত ২৬ জন নিহত হয়েছেন। হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নেতা ভারতের পাশে থাকার আশ্বাস দেন এবং হামলার নিন্দা জানান। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসও এই ঘটনায় নিন্দা জানিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর প্রতি বার্তা দিয়েছেন।
ভারতের সংবাদমাধ্যমগুলো সেদেশের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার বরাতে বলছে, হামলার জন্য পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়বার একটি শাখা সংগঠন ‘দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট’ (আরটিএফ) দায় স্বীকার করেছে। যদিও অন্য গণমাধ্যমে এ খবর এখনো সেভাবে দেখা যায়নি।
ভারতের অনেক রাজনীতিবিদ ও নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের কর্মকর্তার বক্তব্যে আকারে-ইঙ্গিতে হামলাটির জন্য পাকিস্তানের দিকেই দোষারোপের আঙুল ওঠে। এমনকি সৌদি আরব সফর সংক্ষিপ্ত করে দেশে ফেরার সময় পাকিস্তানের আকাশপথও নরেন্দ্র মোদী এড়িয়ে আসেন বলে খবরে এসেছে।
তবে হামলার ঘটনার নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দেয় পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। বিবৃতিতে বলা হয়, ভারতের অবৈধ দখলে থাকা জম্মু ও কাশ্মীরের অনন্তনাগ জেলায় হামলায় পর্যটকদের মৃত্যুর ঘটনায় আমরা গভীরভাবে শোকাহত। নিহতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাই এবং আহতদের দ্রুত সুস্থতা কামনা করি।
গত মার্চে বেলুচিস্তানের জাফর এক্সপ্রেস ট্রেনে সন্ত্রাসী হামলার জন্য পাকিস্তানের তরফ থেকে ভারতের গোয়েন্দাদের দোষারোপ করা, ভারতে বিজেপি সরকারের বিতর্কিত ওয়াকফ (সংশোধিত) আইন ও এ নিয়ে বিক্ষোভ-বির্তকসহ নানা আলোচনার মধ্যে সম্প্রতি পাকিস্তানের সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল সৈয়দ আসিম মুনীর কাশ্মীর নিয়ে কথা বলেন।
সেখানে তিনি বলেন, বিশ্বের কোনো শক্তিই কাশ্মীরকে পাকিস্তান থেকে আলাদা করতে পারবে না। কাশ্মীর পাকিস্তানের ‘জাগুলার ভেইন’ (জাগুলার ভেইন হলো মানব শরীরের একটি গুরুত্বপূর্ণ শিরা, যা মস্তিষ্ক, ঘাড় ও মুখ থেকে রক্ত নিয়ে হৃৎপিণ্ডে পৌঁছায়)। তিনি ‘দ্বিজাতি তত্ত্ব’ টেনে আরও বলেন, আমরা কাশ্মীরি ভাইদের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামকে ভুলব না।
জেনারেল সৈয়দ আসিম মুনীরের ওই বক্তব্যে ভারতজুড়ে তোলপাড় হয়। পহেলগাঁওয়ের ঘটনাটির পর তার ওই বক্তব্যকেই সামনে নিয়ে আসছেন ভারতের নীতি-নির্ধারকরা।
এর প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ বলছেন, এই হামলার সঙ্গে তার দেশের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। তিনি হামলার ঘটনাটিকে ‘ভারতের অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহেরই অংশ’ হিসেবে উল্লেখ করেন।
আসিফ আরও বলেন, কেবল কাশ্মীর নয়—নাগাল্যান্ড, ছত্তিশগড়, মণিপুরসহ বহু রাজ্যে ভারতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ চলছে। পাকিস্তান সব ধরনের সন্ত্রাসবাদের বিরোধী— এমন কথাও জোর গলায় বলেন তিনি।
ভারতে পাকিস্তানের সাবেক হাই কমিশনার আব্দুল বাসিত এক্সে পোস্ট দিয়ে বলেন, আমি নিশ্চিত ভারতের যেকোনো দুঃসাহসিক কর্মকাণ্ড (পাকিস্তানে হামলা বা আঘাত) মোকাবিলায় পাকিস্তান প্রস্তুত আছে। যথাযথ জবাব দিতেও পিছপা হবে না।
পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) নেত্রী ও সংসদ সদস্য শেরি রহমান বলেন, পহেলগাঁওয়ের ভয়াবহ হামলার নিন্দা করছি। দুঃখজনকভাবে, এর দায় আগেভাগে পাকিস্তানের ওপর চাপানো ভারতীয়দের একটা স্বাভাবিক প্রবণতা। আমাদের প্রতিবেশী দেশ নিজের ব্যর্থতা আড়াল করার চেষ্টা করছে। নিয়ন্ত্রণ রেখা ঘিরে দায়িত্বশীল ও কৌশলগত আলোচনা চেপে রাখা হচ্ছে, বরং তা নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করা হচ্ছে। অনুমান করা যায়, কোনো ধরনের পূর্ণাঙ্গ তদন্ত ছাড়াই ভারতের দক্ষিণপন্থী গোষ্ঠী এখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিক্রিয়ার আহ্বান জানাবে।
ভারতীয়দের মধ্যে যে আলোচনা
এক্স হ্যান্ডেলে জেনারেল মুনিরের বক্তব্যের একটি ভিডিও শেয়ার করে উমর আজহার নামে একটি এক্স অ্যাকাউন্টে লেখা হয়, জেনারেল মুনীর পাঁচ দিন আগেই বলেছিলেন, কাশ্মীরি ভাইদের একা ছেড়ে দেবে না পাকিস্তান। এখনকার প্রেক্ষাপটে সেই বক্তব্য আরও উদ্বেগজনক বলে মনে হচ্ছে। এমন বক্তব্য একদমই উচিত হয়নি।
আজহারের পোস্টের প্রতিক্রিয়ায় প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক আয়েশা সিদ্দিকা লেখেন, এই উৎসাহ কোথায় গড়ায়, তা এখন দেখার বিষয়।
ভারতের কূটনৈতিক সাংবাদিক সুহাসিনী হায়দার বলেন, তার সাম্প্রতিক বক্তব্য সাম্প্রদায়িক ও বিভাজনমূলক। এটি কাশ্মীরের সাম্প্রতিক হামলার উদ্দেশ্য ও নির্মমতার সঙ্গে সম্পর্কিত বলে মনে হচ্ছে।
ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট’র প্রতিরক্ষা সম্পাদক শশাঙ্ক যোশীও জেনারেল মুনীরের বক্তব্যকে সময়োপযোগী নয় বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, কাশ্মীরকে পাকিস্তানের জাগুলার ভেইন বলা যেমন উদ্বেগজনক, তেমনি কাশ্মীরিদের সংগ্রামকে ‘বীরত্বপূর্ণ’ বলা একটি স্পষ্ট রাজনৈতিক বার্তা।
পাকিস্তানের গণমাধ্যমে অভিযোগ করা হচ্ছে, ভারতে যেকোনো হামলার ঘটনায় স্বাভাবিকভাবেই পাকিস্তানকে দায়ী করা হয়। সামা টিভির এক উপস্থাপক বলেন, ভারতে হামলা হলেই প্রথমে পাকিস্তানের দিকে আঙুল তোলা হয়। সাংবাদিক সিরিল আলমেইদা বলেছেন, ভারত যদি প্রতিশোধ নিতে চায়, তবে কি কেউ তাদের আটকাতে পারবে?
এই প্রসঙ্গে সাংবাদিক শশাঙ্ক যোশী বলেন, আমি মনে করি, ভারত আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ নিতে পারে। মে মাসের শেষ সপ্তাহে এমন পদক্ষেপ নেওয়ার সম্ভাবনা ৬০ শতাংশ এবং আমি এটা নিয়ে মজা করছি না।
পুলওয়ামায় হামলা ও বালাকোটে ‘জবাব’
২০১৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি কাশ্মীরের পুলওয়ামা জেলায় ভারতের বিশেষায়িত নিরাপত্তা বাহিনী সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ ফোর্সের (সিআরপিএফ) গাড়িবহরে হামলা চালানো হয়।
এরপর জঙ্গিদের মদদ দেওয়ার জন্য ইসলামাবাদকে অভিযুক্ত করে এর ‘মোক্ষম জবাব’ দিতে ওই বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি ভোরে পাকিস্তানের বালাকোট শহরের কাছে হামলা চালায় ভারতীয় বিমানবাহিনী। সেটি জঙ্গি গোষ্ঠী জইশ-ই-মোহাম্মদের প্রশিক্ষণ ক্যাম্প ছিল বলে দাবি করে দিল্লি। তাদের দাবি অনুসারে, হামলায় প্রায় ৩০০ জঙ্গি নিহত হয়।
এর একদিন পরই ২৭ ফেব্রুয়ারি ভারতের দু’টি যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত করে পাকিস্তান। একইসঙ্গে তাদের পাইলট উইং কমান্ডার অভিনন্দনকে আটক করে। ১ মার্চ অবশ্য তাকে ফিরিয়ে দেয় পাকিস্তান।
ওই সময় দুদেশের মধ্যে ব্যাপক উত্তেজনা ছড়ায়।