Image description

অসুস্থতা , দুর্ঘটনাসহ বিপদে - আপদে বিশ্বজুড়ে মানুষের ভরসার কেন্দ্র ‘ বিমা ’ । বিমা পলিসি করা থাকলেই হাসপাতালের বিল পরিশোধ বা দুর্ঘটনার ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে নিতে কোনো চিন্তা করতে হয় না গ্রাহককে । গ্রাহকের হয়ে বিমা কোম্পানিই সব শোধ করে দেয় । কিন্তু বাংলাদেশের বিমা খাত এখনো সেই ভরসার জায়গা হয়ে উঠতে পারেনি । বিপদগ্রস্ত গ্রাহক বিমা দাবি নিয়ে পায়ের জুতা ক্ষয় করে ফেললেও অর্থ পরিশোধ নিয়ে গড়িমসি শেষ হয় না সংশ্লিষ্ট বিমা কোম্পানির । বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের ( আইডিআরএ ) এক অনিরীক্ষিত প্রতিবেদনের তথ্য বলছে , দেশের ৪৬ টি বিমা কোম্পানি গ্রাহকের বিমা দাবির প্রায় ২ হাজার ৬৩৫ কোটি টাকা পরিশোধ করেনি । এ হিসাব গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ।

বিমাসংশ্লিষ্টরা বলছেন , পরিশোধে বিমা কোম্পানিগুলোর অনীহা , কাগজপত্র ও সার্ভে প্রতিবেদনের দোহাই এবং পুনর্বিমার নামে নানা বাহানা করেই বছরের পর বছর গ্রাহকের পাওনা টাকা দিচ্ছে না কোম্পানিগুলো । এ কারণে বিমা খাতের ওপর মানুষের আস্থা দিন দিন কমছে । এ বিষয়ে আইডিআরএ চেয়ারম্যান এম আসলাম আলম বলেন, বিমা খাতের প্রধান সমস্যা দাবি পরিশোধ না করা । এ কারণে বিমা খাত এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে । আইডিআরএর সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী , ২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের ৪৬ টি নন - লাইফ , অর্থাৎ সাধারণ বিমা কোম্পানির কাছে গ্রাহকের বিমা দাবি ছিল ৩ হাজার ৮৭১ কোটি ৯২ লাখ টাকা । এর মধ্যে পরিশোধ করা হয়েছে ১ হাজার ২৩৭ কোটি ৪০ লাখ টাকা । ফলে অনিষ্পন্ন আছে ২ হাজার ৬৩৫ কোটি টাকার বিমা দাবি । এ ক্ষেত্রে দাবি নিষ্পত্তির হার মাত্র ৩২ শতাংশ । সেই হিসাবে ৬৮ শতাংশ বিমা দাবি পরিশোধ করেনি কোম্পানিগুলো । বিষয়টি নিয়ে বিমা কোম্পানিগুলোর এমডিদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্যুরেন্স ফোরামের জয়েন্ট সেক্রেটারি এস এম নুরুজ্জামান আজকের পত্রিকাকে বলেন , বিমা দাবি পরিশোধ নিশ্চিত করার জন্য আইডিআরএ এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে আরও আন্তরিক হতে হবে । দ্রুত বিমা দাবি পরিশোধে আইনগত পদক্ষেপ নিতে হবে ।

গ্রাহকের ২,৬৩৫ কোটি টাকা গ্রাহকদের বিমার টাকা পরিশোধ না করার শীর্ষে রয়েছে সিকদার ইনস্যুরেন্স লিমিটেড । ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত কোম্পানিটির কাছে গ্রাহকদের বিমা দাবির পরিমাণ ছিল ২৮ কোটি ৪০ লাখ টাকা । এর মধ্যে তারা পরিশোধ করেছে মাত্র ১ কোটি ৪৭ টাকা । অর্থাৎ ৯৩ দশমিক ৮৩ শতাংশ বিমা দাবি পরিশোধ করেনি কোম্পানিটি ।

জানতে চাইলে সিকদার ইনস্যুরেন্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুর রফিক আজকের পত্রিকাকে বলেন , ৫ আগস্টে কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে । এই বিমা দাবি সাধারণ বিমা কোম্পানিতে রয়েছে । এসবিসি থেকে দাবির অর্থ পেলেই পরিশোধ হয়ে যাবে । সরকারি বিমা সাধারণ বীমা করপোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ( এমডি ) হারুন - অর - রশিদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ এসবিসি বিমা পরিশোধ না করার বিষয়ে আমি কোনো মন্তব্য করব না । তবে আমরা বিমা কোম্পানির দাবি বাবদ ২০২৪ সালে ৪৬৩ কোটি টাকা পরিশোধ করেছি ।” বিমা দাবি পরিশোধ না করার ক্ষেত্রে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে নর্দান ইসলামী ইনস্যুরেন্স লিমিটেড । প্রতিষ্ঠানটির কাছে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত দাবির পরিমাণ ছিল ৬৬ কোটি ৬৮ লাখ টাকা । এর মধ্যে ৫ কোটি ২২ লাখ টাকা পরিশোধ করেছে তারা । টাকার হিসাবে কোম্পানিটির অনিষ্পন্ন বিমা দাবির হার ৯২ শতাংশ । এ বিষয়ে নর্দান ইসলামী ইনস্যুরেন্স লিমিটেডের সিইও চৌধুরী গোলাম ফারুক কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি ।

তবে কোম্পানির এক কর্মকর্তা বলেন , এস আলম - কাণ্ডের কারণে কোম্পানির বিমা দাবির পরিমাণ বেড়েছে । সবচেয়ে কম বিমা দাবি পরিশোধ করা কোম্পানির তালিকায় তৃতীয় , চতুর্থ ও পঞ্চম স্থানে থাকা বাকি তিন কোম্পানি হলো ঢাকা ইনস্যুরেন্স , পিপলস ইনস্যুরেন্স এবং সাধারণ বীমা করপোরেশন । প্রতিষ্ঠান তিনটি যথাক্রমে ৯ দশমিক ২২ , ৯ দশমিক ৩৬ এবং ১২ দশমিক ১০ শতাংশ বিমা দাবি পরিশোধ করেছে । বিমা দাবি পরিশোধ না করার পেছনে তিনটি কারণকে দায়ী করেছে সংশ্লিষ্ট বিমা কোম্পানি কর্তৃপক্ষ । কারণগুলো হলো গ্রাহকদের যথাযথ ডকুমেন্ট না থাকা , ডকুমেন্ট থাকলেও সার্ভের রিপোর্ট পেতে দেরি হওয়া এবং পুনবিমা পেতে সাধারণ বিমার গড়িমসি । এ বিষয়ে সিকদার ইনস্যুরেন্স কোম্পানির পরামর্শক মীর নাজিম উদ্দিন আজকের পত্রিকাকে বলেন , বিমা দাবি পরিশোধের প্রধান বাধা হলো সার্ভে রিপোর্ট না পাওয়া । আমরা দেখছি ঘটনা ঘটছে , কিন্তু তারপরও সার্ভে রিপোর্ট পাচ্ছি না । সার্ভে রিপোর্ট পেতে লাগে টাকা । এমনও হয় যে মূল টাকার চেয়ে বেশি টাকা চলে যায় সার্ভে রিপোর্টের জন্য । সার্ভে রিপোর্ট হলো সোনার হরিণ । আইডিআরএর প্রতিবেদনের তথ্যমতে , বিমা দাবি পূরণে শীর্ষ রয়েছে রূপালী ইনস্যুরেন্স , জনতা ইনস্যুরেন্স , সোনার বাংলা , ইস্টল্যান্ড , নিটল এবং প্রাইম ইনস্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড এই কোম্পানিগুলো গ্রাহকদের ৯৭ শতাংশ পর্যন্ত বিমা দাবি পরিশোধ করেছে ।

আইডিআরএ উপপরিচালক ও মুখপাত্র মো . সোলাইমান আজকের পত্রিকা বলেন , ' প্রতিবেদনটি হাতে পেয়েছি । আইডিআরএ কর্তৃপক্ষ বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে । বিমা দাবির অধিকাংশ বিষয়টির সঙ্গে সাধারণ বিমা কোম্পানির সংশ্লিষ্টতা রয়েছে । আইডিআরএ কর্তৃপক্ষ এসবিসির কথা বলে সমাধানের পথ বের করবে । ' গ্রাহকদের করণীয় : বিমা দাবি আদায়ের জন্য গ্রাহককে কিছু পরামর্শ দিয়েছেন বিমা বিশেষজ্ঞেরা । তাঁদের পরামর্শ— প্রথমত , দাবির সপক্ষে সব কাগজপত্র নির্ভুলভাবে জমা দিয়ে আবেদন করতে হবে । আবেদনের ৯০ দিনের মধ্যে দাবির অর্থ না পেলে আইডিআরএতে অভিযোগ করতে হবে । তাতেও যদি কাজ না হয় , তবে আইডিআরএর বিরোধ নিষ্পত্তি কমিটির কাছে আবেদন করতে হবে । এতেও ব্যর্থ হলে দ্রুত মামলার মাধ্যমে আদালতের শরণাপন্ন হতে হবে ।