Image description
নগরীর বাঁকে বাঁকে মৃত্যুফাঁদ, ৫ বছরে ঝরল ৯ প্রাণ

নালায় পড়ে নিখোঁজ, এর পর মরদেহ উদ্ধার—চট্টগ্রামে এ রকম ঘটনা বেড়েই চলেছে। গত ৫ বছরে এভাবে নালায় পড়ে মৃত্যু হয়েছে অন্তত ৯ জনের। সর্বশেষ এ তালিকায় যুক্ত হয়েছে ছয় মাসের ছোট্ট শিশু সেহরিশের নাম।

শুক্রবার রাতে শিশু সেহরিশকে নিয়ে তার মা ও দাদি অটোরিকশায় বাসায় ফিরছিলেন। পথে নগরীর চকবাজার থানার কাপাসগোলা এলাকায় রাত ৮টায় তাদের বহনকারী অটোরিকশাটি উল্টে হিজরা খালের নালায় পড়ে যায়। তাৎক্ষণিক মা ও দাদিকে উদ্ধার করা গেলেও তলিয়ে যায় সেহরিশ। এর পরপরই শিশুটিকে উদ্ধারে অভিযান শুরু হয়। সিটি করপোরেশনের সদস্য, ফায়ার সার্ভিস, নৌবাহিনী রাতভর অভিযান চালিয়েও উদ্ধার করতে পারেনি শিশুটিকে। পরে নিখোঁজের ১৪ ঘণ্টা পর চাক্তাই খাল এলাকায় শিশুটির লাশ ভেসে ওঠে।

স্থানীয়রা জানান, শিশুটি যে নালায় পড়ে নিখোঁজ হয়, তার সঙ্গে সড়ক একেবারে লাগোয়া। এ সড়কে সিএনজি ও ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চলাচল করে। জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের কাজ চলায় নালার পাশে থাকা একটি নিরাপত্তাবেষ্টনী খুলে রাখা হয়েছিল। এ কারণেই দুর্ঘটনাটি ঘটে। দুর্ঘটনার পর বাঁশ দিয়ে তড়িঘড়ি করে নালার পাশে নিরাপত্তাবেষ্টনী বসানো হয়।

নালায় পড়ে মৃত্যুর ঘটনা চট্টগ্রামে এটাই প্রথম নয়। গত ৫ বছরে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে অন্তত আরও আটটি। ২০২৪ সালের জুনে গোসাইলডাঙ্গা এলাকায় সাত বছরের শিশু সাইদুল ইসলাম নালায় পড়ে নিখোঁজ হয়। পরদিন নাছির খাল থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। ২০২৩ সালের ২৮ আগস্ট আগ্রাবাদ রঙ্গীপাড়া এলাকায় দেড় বছর বয়সী শিশু ইয়াছিন আরাফাত নালায় পড়ে নিখোঁজ হয়। ১৬ ঘণ্টা পর তার মরদেহ উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিস। একই মাসের ৭ আগস্ট চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ১ নম্বর পাহাড়তলী ওয়ার্ডের ফতেহপুর ইসলামী হাটসংলগ্ন বাদামতলা এলাকার নালায় পড়ে মৃত্যু হয় কলেজছাত্রী নিপা পালিতের। এর আগে ২০২১ সালের ৬ ডিসেম্বর ষোলশহর এলাকায় চশমা খালে তলিয়ে যায় শিশু কামাল উদ্দীন। তিন দিন পর মুরাদপুর থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। একই বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর আগ্রাবাদ এলাকায় হাঁটার সময় নালায় পড়ে মারা যান বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী সেহেরীন মাহবুব সাদিয়া। একই বছর ২৫ আগস্ট আবারও চশমা খালে পড়ে নিখোঁজ হন সবজি বিক্রেতা সালেহ আহমেদ। দীর্ঘ সময় উদ্ধার অভিযান চালিয়েও তার মরদেহ পাওয়া যায়নি। একই খালে পড়ে সেই বছরের ৩০ জুন অটোরিকশাচালক ও এক যাত্রীর মৃত্যু হয়।

বাঁকে বাঁকে মৃত্যু ফাঁদ, ঝুঁকি নিয়ে চলাচল: নগরের ৪১টি ওয়ার্ডে নালা-নর্দমায় কয়েক হাজার মরণফাঁদ রয়েছে। এর মধ্যে বেশিরভাগ নালা-নর্দমাই উন্মুক্ত। সরেজমিন কয়েকটি নালা ঘুরে দেখা যায়, নালার ওপর কোথাও স্ল্যাব আছে, কোথাও নেই। আবার কোথাও স্ল্যাব ভাঙা। খালে নেই নিরাপত্তাবেষ্টনী। নালায় পড়ে মৃত্যুর পর খাল-নালায় প্রয়োজন অনুযায়ী নিরাপত্তাবেষ্টনী দেওয়ার দাবি জানানো হয় প্রতিবারই; কিন্তু বছর ঘুরে আবার দুর্ঘটনা হলেও ঝুঁকিমুক্ত করা হয় না। ঝুঁকি নিয়েই পথ চলতে হয় নগরবাসীকে।

নগরীর হালিশহর এলাকায় কথা হয় স্থানীয় বাসিন্দা মো. মাইন উদ্দীনের সঙ্গে। তিনি জানান, তার বাসার সামনে অর্থাৎ বাসস্ট্যান্ডের পাশে যে খালটি আছে, এতে সব সময় স্রোত থাকে। বর্ষায় স্রোতের মাত্রা তীব্র হয়; কিন্তু এই খালটি সব সময়ই উন্মুক্ত থাকে। এখানেও যে কোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।

নগরবাসীর দাবি, নালায় পড়ে প্রতি বছরই একাধিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটলেও কর্তৃপক্ষের টনক নড়ছে না। নেওয়া হচ্ছে না কার্যকর কোনো পদক্ষেপ। প্রতিটি দুর্ঘটনার পর বিষয়টি নিয়ে কয়েকদিন আলোচনা থাকলেও পরে তা চাপা পড়ে যায়।

নগর পরিকল্পনাবিদদের মতে, এই মৃত্যুর মিছিল বন্ধে বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে কমিটি করে উন্মুক্ত নালার দুই পাশে নিরাপত্তা বেষ্টনী গড়ে তুলতে হবে। অন্যথায় এই মৃত্যুর মিছিল থামানো যাবে না।

দায় নিয়ে টানাটানি: নগরীর উন্মুক্ত নালা-খালে পড়ে একাধিক মানুষের হতাহত হওয়ার ঘটনা ঘটলেও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) কেউ সরাসরি এর দায় নেয়নি। সর্বশেষ শিশু মৃত্যুর বিষয়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা জানান, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কাছে যে ৩৬টি খাল সিটি করপোরেশন হস্তান্তর করেছে, হিজড়া খাল তার মধ্যে একটি।

চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী নুরুল করিম বলেন, ‘প্রতিটি মৃত্যুই মর্মান্তিক। আমি কাউকে দায় দেব না। এখানে আমাদের সবারই দোষ। হিজড়া খালের কাজ আমরা এখনো শুরু করিনি। সেনাবাহিনী ময়লা পরিষ্কার করে গেছে। আমরা যেগুলোর কাজ শেষ করেছি, সেগুলোয় বেষ্টনী করে দিয়েছি।’

মেয়রের তদারকি: এদিকে শুক্রবার রাতে শিশু নিখোঁজ হওয়ার পর ঘটনাস্থলে ছুটে যান সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন। মধ্যরাত পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করে উদ্ধার অভিযান কার্যক্রম তদারকি করেন তিনি। এ ছাড়া নগরীর কয়েকটি জায়গায় পরিদর্শন করে তাৎক্ষণিক নিরাপত্তা বেষ্টনী দেওয়ার ব্যবস্থা করেন।

এ বিষয়ে ডা. শাহাদাত কালবেলাকে বলেন, ‘শুক্রবার রাতে যে ঘটনাটি ঘটেছে এটা অত্যন্ত মর্মান্তিক। এই ধরনের ঘটনা কোনোভাবেই কাম্য নয়। আগামীতে যাতে এই ধরনের ঘটনা আর না ঘটে, আমরা সে ব্যবস্থা নিচ্ছি। আমরা সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দিয়েছি, যাতে দুর্ঘটনাপ্রবণ জায়গা চিহ্নিত করে নিরাপত্তা বেষ্টনী গড়ে তোলে।’ মেয়র আরও বলেন, যে খালগুলোয় কাজ চলছে, সেগুলোয় যাতে দুর্ঘটনা না ঘটে, সে জন্য যথাযথ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কাজ বাস্তবায়নকারী সংস্থাকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা যা বলেছেন: চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) স্থাপত্য ও পরিকল্পনা অনুষদের ডিন অধ্যাপক মুহাম্মদ রাশিদুল হাসান কালবেলাকে বলেন, ‘গত ৪-৫ বছর প্রতি বর্ষা মৌসুমে আমরা এই ধরনের মর্মান্তিক মৃত্যুর খবর পেয়ে থাকি। বারবার আমরা এই বিষয় নিয়ে সোচ্চার হচ্ছি; কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক, তা কমে আসছে না। এটা নিয়ে কার্যকরী কী পদক্ষেপ নেওয়া যায়, তা নিয়ে আরেকটু আলোচনা করা জরুরি।’

তিনি বলেন, চট্টগ্রামে কয়েক ধরনের খাল রয়েছে। প্রধান যে খালগুলো রয়েছে, অর্থাৎ যেগুলোর গভীরতা বা প্রশস্ততা অনেক বেশি, সেগুলোর ক্ষেত্রে নিরাপত্তা বা মৃত্যুঝুঁকির বিষয়টা সামনে নিয়ে আসতে হবে। নালাগুলোকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ঢেকে দেওয়া যাবে না। চট্টগ্রামের ভূ-প্রাকৃতিক অবস্থার কারণে নালাগুলোয় প্রচুর পরিমাণ বালু জমে। এক্ষেত্রে প্রধান নালাগুলোর দুই পাশে নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করতে হবে। এই বেষ্টনী কংক্রিট বা লোহার গ্রিল দিয়ে করলে হবে না। এটাকে একটু দৃষ্টিনন্দন করে করতে হবে। বেষ্টনীর পাশে ফুলের গাছ বা গুল্মলতা লাগিয়ে দিলে তখন সেটা একদিকে যেমন শোভা বাড়াবে, অন্যদিকে নিরাপত্তার কাজও করবে। বিষয়টি নিয়ে অবশ্যই প্রকৌশলী, স্থপতি, নগর-পরিকল্পনাবিদদের পরামর্শ নিয়ে জননিরাপত্তা নিশ্চিত ও নিরাপদ নগরী তৈরিতে এখনই কাজ শুরু করা উচিত।