
অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য আর্থিকখাতের দুর্বলতা এবং শ্রমিক অসন্তোষ স্বল্প মেয়াদে অন্যতম ঝুঁকির উৎস হতে পারে বলে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে দেয়া এক প্রেজেন্টেশনে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিল অর্থ মন্ত্রণালয়। গত ৯ ফেব্রুয়ারি অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদের উপস্থাপন করা ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা এবং ঘনীভূত হওয়ার আগেই শ্রমিক অসন্তোষ প্রশমিত করা অন্তর্বর্তী সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচনা করা প্রয়োজন। ওই প্রতিবেদনের পরও দীর্ঘ দিনেও এ নিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি বাংলাদেশ ব্যাংক; বরং এখনো আওয়ামী দোসরদের নীতিতে চলছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আগের নীতি-নির্ধারকরা এখনো বহাল তবিয়তে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যানুসারে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪ দশমিক ২২ শতাংশ, যা চার বছরের মধ্যে সর্বনি¤œ। গত বছরের মে মাসে পূর্বাভাস দেয়া ৫ দশমিক ৮২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির চেয়ে এ হার ১ দশমিক ৬ শতাংশ কম। এর আগের সর্বনি¤œ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ছিল ২০১৯-২০ অর্থবছরে, ৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ; করোনা মহামারীর কারণে সেবার প্রবৃদ্ধি এত কম ছিল। যদিও টানা তিন প্রান্তিকে জিডিপি প্রবৃদ্ধির ধীরগতির পর অবশেষে কিছুটা গতি ফিরে এসেছে দেশের অর্থনীতিতে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সাম্প্রতিক তথ্য বলছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিক অর্থাৎ অক্টোবর-ডিসেম্বর মেয়াদে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪ দশমিক ৪৮ শতাংশ। এর আগে রাজনৈতিক অস্থিরতা, ছাত্র-জনতার আন্দোলন এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের মন্থর পরিস্থিতির প্রভাবে প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছিল মাত্র ১ দশমিক ৮১ শতাংশে, যা সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে সর্বনি¤œ। অথচ দেশের জনসংখ্যার স্বাভাবিক কার্যক্রমেই জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশের উপের থাকার কথা। তবে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হিসেবে ফুটে উঠেছে আর্থিক খাতের দুর্বলতা, বিশেষ করে ব্যাংকিং খাতের দুরবস্থা। ‘জোর প্রচেষ্টা সত্ত্বেও কিছু ব্যাংক বাঁচানো যাবে না’ কয়েক মাস আগে দেয়া গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরের এই বক্তব্যে দেশের ব্যাংকিং খাতকে খাদের কিনারায় নিয়ে গেছে। এখনো অনেক ব্যাংক কাটিয়ে উঠতে পারেনি। এই ধারাবাহিকতায় ন্যাশনাল ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংক, ফাস্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক ও সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকে চরম তারল্য সঙ্কট বিরাজ করছে। এসব ব্যাংকের গ্রাহকরা চরম ভোগন্তির মধ্যে পড়েছেন। কারণ গভর্নরের বক্তব্যের পর হিড়িক পড়েছে এসব ব্যাংক থেকে টাকা তোলার। গ্রাহকদের গচ্ছিত টাকা সবাই একসঙ্গে তুলতে যাওয়ায় টাকার সঙ্কটে পড়েছে ব্যাংক। এসব ব্যাংকে গ্রাহকরা নতুন করে টাকা না রাখায় বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ধার দিয়েও দায় মেটাতে পারছে না। এমনকি গ্রাহকের চাহিদা মেটাতে গিয়ে ন্যাশনাল ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংকসহ একাধিক ব্যাংকের কর্মকর্তারা তাদের বেতনও উঠাতে পারছেন না। সঙ্কটে থাকা কয়েকটি ব্যাংকের শাখা পরিদর্শনে গিয়ে গ্রাহকদের অতি প্রয়োজনেও টাকা না পাওয়ার বেশ কিছু চিত্র চোখে পড়ে। ন্যাশনাল ব্যাংকের এক গ্রাহক জানান, ব্যাংক থেকে ৫০ হাজার টাকা তুলতে পাঁচ দিন থেকে ঘুরছি। অপর এক গ্রাহক জানান, ব্যাংক থেকে পাঁচ হাজার টাকাও পাচ্ছি না। এছাড়া একাধিক ব্যাংক নানা সূচকে ভালো থাকলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু কর্মকর্তার ইন্ধনে পরিচালনা পরিষদে পরিবর্তন আনা হয়েছে। যা ওই ব্যাংকগুলোর সঙ্গে আর্থিক খাতকে বিপাকে ফেলেছে।
ন্যাশনাল ব্যাংকের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর ইমরান আহমেদ ইনকিলাবকে জানান, বাংলাদেশ ব্যাংক আশ্বাস দিয়েছিল, ঈদের সময় একটি বড় সাপোর্ট (টাকা) পাওয়া যাবে। ঈদের পরও ১৫ দিন অতিবাহিত হয়েছে, এখনো সেই সাপোর্ট পাইনি। গ্রাহকদের ভোগান্তি হচ্ছে, কিন্তু ব্যাংকে টাকা নেই। তাই বাধ্য হয়ে ছোট ছোট অঙ্কের টাকা দিতে হচ্ছে।
পদ্মা ব্যাংকের এক গ্রাহকের হিসাবে গচ্ছিত আছে সাড়ে তিন লাখ টাকা। হার্টের রিং পরাতে হবে। অথচ ব্যাংক টাকা দিতে পারছে না। ওই গ্রাহক কী করবেনÑ ভেবে পাচ্ছেন না। অথচ দ্রুত হার্টের রিং পরানোর জন্য তার টাকা প্রয়োজন। ইতোমধ্যে বিভিন্ন ব্যাংককে সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা ছাপিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। একই সঙ্গে গত কয়েক মাসে তারল্য সঙ্কটে থাকা ব্যাংকগুলোকে প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকা ধার দেয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধার পেয়েও সঙ্কট কাটাতে পারছে না ব্যাংকগুলো। কারণ, একাধিক ব্যাংকের এই ধারের অঙ্ক প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। কারণ, ব্যাংকগুলো থেকে গ্রাহকরা শুধু টাকা তুলছে, টাকা রাখছে না। ফলে গ্রাহকের চাহিদামতো টাকা দিতে পারছে না এসব ব্যাংক।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, শিল্পায়নবিরোধী নীতি, চলমান জ্বালানি সঙ্কট ও ভঙ্গুর ব্যাংকিং খাতের কারণে বিনিয়োগ কার্যত স্থবির হয়ে পড়েছে। সরকারের কার্যকর বিনিয়োগনীতির অভাবের সমালোচনা করে তিনি বলেন, পুরোনো বিধিবিধান, দুর্বল পরিষেবা ও নিয়ন্ত্রক বাধাগুলো বিনিয়োগ প্রক্রিয়াকে দেরি করিয়ে দেয়।
এদিকে স্বৈরাচার হাসিনার ভারতে পলায়নের পর সঠিক সিদ্ধান্তের অভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা, নতুন করে শিল্প-কারখানা গড়ে উঠছে না, এলসি নেই, শ্রমিক অসন্তোষসহ পরিবেশ না থাকায় অনেক ছোট-বড় শিল্প-কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানই ভালো নেই। এমনকি ব্যবসার জন্য ব্যাংক থেকে ‘নতুন ঋণ’ চাহিদাও নেই। অধিকাংশ ব্যবসায়ীর ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ করে রাখা হয়েছে। আবার যে সব ব্যবসায়ীর হাতে টাকা ছিল তারা পরিবেশের অভাবে বিদেশমুখী হয়েছেন। ব্যাংকগুলো নিয়ে গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরের অমূলক বক্তব্যেও বিপাকে পড়েছে এক ডজন ব্যাংক। দুর্বল এই ব্যাংকগুলোকে আরো দুর্বল করা হয়েছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, করোনা মহামারীর পর টাকার দাম কমে যাওয়া, জীবনযাত্রার খরচ বেড়ে যাওয়া ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মতো বিষয়গুলো নতুন বিনিয়োগকে বাধাগ্রস্ত করেছে। হাসিনার পতনের পরও ব্যবসায়ীরা আশাবাদী ছিলেনÑ নানামুখী সংস্কারে আর্থিক খাত আবারো ঘুরে দাঁড়াবে। কিন্তু বাস্তবমুখী কোনো পদক্ষেপ না আসায় আর্থিক খাতে সঙ্কট আরো বেড়েছে।
অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কাÑ বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় অদূর ভবিষ্যতে কাজের সুযোগ ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমে যেতে পারে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ তথ্যে দেখা যায়, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সরকারি ও বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ কমছে।
রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলেছে। ঘন ঘন নীতি পরিবর্তন, নিয়ন্ত্রকের পরিবর্তন ও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বিনিয়োগকারীরা সতর্কাবস্থায় আছেন। এমনকি অনেকে তাদের পরিকল্পিত বিনিয়োগে দেরি করছেন। অনেকে আবার বাতিলও করে দিয়েছেন।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন রাজনৈতিক অস্থিরতা ও জ্বালানি সঙ্কটকে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে প্রধান বাধা বলে মনে করেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দেশে গ্যাস সরবরাহে সীমাবদ্ধতা ও বিদ্যুৎ বিভ্রাটের সময় বিকল্প জ্বালানির খরচ বেড়ে যাওয়ায় অনেক কারখানায় উৎপাদন কমিয়ে দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও ব্যবসা পরিচালন খরচ বেড়ে যাওয়ায় বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ কম। এ কারণেই বিনিয়োগ-জিডিপি অনুপাতও কম। তার মতে, মূল্যস্ফীতি ও সামগ্রিক সামষ্টিক অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অনিশ্চয়তা তৈরি করছে। নতুন বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে পারছে না।
অর্থনৈতিক সাংবাদিকদের সংগঠন ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম ইনকিলাবকে বলেন, বিনিয়োগ-জিডিপি অনুপাত বাড়াতে দুর্নীতি দমন ও অর্থনৈতিক বহুমুখীকরণ, প্রণোদনা কাঠামোর পুনর্মূল্যায়ন, ক্ষুদ্র ব্যবসা ও কম আয়ের মানুষকে রক্ষা এবং কর সংস্কারের দিকে মনোযোগ দিতে হবে।
পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী এম মাসরুর রিয়াজ বলেছেন, সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা, ব্যবসায়িক আস্থা বাড়ানো ও বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। তিনি বলেন, গত কয়েক বছর ধরে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ-জিডিপি অনুপাত ২২ থেকে ২৩ শতাংশের আশেপাশে। এটি লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় কম। একই সঙ্গে সরকারি বিনিয়োগে কিছুটা প্রবৃদ্ধি দেখা গেলেও বেসরকারি খাত ক্রমাগত গুরুত্বপূর্ণ সমস্যায় পড়ছে। এটি অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার অদক্ষতা দূর ও ব্যবসায়ীদের আস্থা বাড়ানো বিনিয়োগ ফিরিয়ে আনার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করেন তিনি।