
বাংলাদেশ রেলওয়ের একটি প্রকল্পে সাশ্রয় হওয়া টাকায় আরও ৩৫ টি কোচ ( বগি ) কেনার সিদ্ধান্ত হলেও নির্দিষ্ট মেয়াদে সেগুলো আসছে না । যে সময়ে আসবে , তখন টাকা পরিশোধে জটিলতার কারণে এই প্রকল্পের মেয়াদ আগামী বছর জুন পর্যন্ত এক বছর বাড়ানো হচ্ছে । প্রকল্পের প্রজেক্ট স্টিয়ারিং কমিটির ষষ্ঠ সভায় সময়মতো কোচগুলো না আসায় উদ্বেগ প্রকাশ করা হয় । সভায় প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর বিষয়েও আলোচনা হয় । রেলওয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে । সূত্র জানায় , বাংলাদেশ রেলওয়ে ২০১৭ সালে ডিজেলচালিত ২০ টি মিটারগেজ লোকোমোটিভ ( ইঞ্জিন ) এবং ১৫০ টি যাত্রীবাহী মিটারগেজ কোচ কেনার একটি প্রকল্প নেয় । এর মধ্যে তিনটি ছিল বিলাসবহুল প্রেসিডেন্ট সেলুন কোচ । ২০১৭ সালের ২৬ ডিসেম্বর প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদিত হয় । এই প্রকল্পের চুক্তি হয় ২০২০ সালের ২৯ জুলাই । চুক্তি অনুযায়ী ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে কোচ ডেলিভারির সময় নির্ধারণ করা ছিল । ২০ টি লোকোমোটিভ দেশে এসেছে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে । গত বছরের জুন পর্যন্ত কয়েক ধাপে দেশে এসেছে ১৪৭ টি কোচ । বাকি তিনটি প্রেসিডেন্ট সেলুন কোচের মূল্য অনেক বেশি ও অপ্রয়োজনীয় হওয়ায় বাংলাদেশ সেগুলো নেয়নি ।
প্রকল্প সূত্র জানায় , তিনটি প্রেসিডেন্ট সেলুন কোচ না নেওয়ায় প্রকল্পের প্রায় ১৮ কোটি টাকা সাশ্রয় হয় । এ ছাড়া প্রকল্পের ঋণচুক্তিতে প্রায় ২০০ কোটি টাকা বেঁচে যায় । এতে প্রকল্পে সাশ্রয় হয় প্রায় ২১৮ কোটি টাকা । কোচের সংকট থাকায় রেলওয়ে সাশ্রয় হওয়া টাকা থেকে আরও ৩৫ টি কোচ কেনার সিদ্ধান্ত নেয় । এই প্রকল্পের আওতায় ১৭৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ৩৫ টি কোচ কিনতে ২০২৪ সালের জুনে চুক্তি করে রেলওয়ে । এসব কোচ সরবরাহের মেয়াদ চলতি বছরের জুন পর্যন্ত । সব মিলিয়ে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের মেয়াদ ২০১৭ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত । এই মেয়াদ শেষ হতে আড়াই মাসের কম সময় থাকলেও ৩৫ টি কোচ আসেনি । প্রকল্পের প্রজেক্ট স্টিয়ারিং কমিটির সর্বশেষ ও ষষ্ঠ সভা হয়েছে গত ২৩ মার্চ ।
ওই সভা সূত্রে জানা গেছে , অতিরিক্ত ৩৫ টি কোচ চলতি বছরের জুনের মধ্যে পাওয়ার কথা ছিল । কোচগুলোর ম্যানুফ্যাকচারিং হচ্ছে দক্ষিণ কোরিয়ায় । এই কোচের যন্ত্রাংশ জার্মানি থেকে একটি কোম্পানি সরবরাহ করবে । তবে রাশিয়া - ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ওই কোম্পানির যন্ত্রাংশের প্রথম শিপমেন্টের জন্য জার্মানির কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স পেতে বিলম্ব হচ্ছে । প্রথম চালানের বিলম্বের কারণে দ্বিতীয় শিপমেন্ট চলতি বছরের জুনের আগে পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে । এতে প্রকল্পের মেয়াদের মধ্যে , অর্থাৎ জুনের মধ্যে ৩৫ টি কোচ পাওয়া সম্ভব হবে না । এ জন্য প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি না করে শুধু মেয়াদ এক বছর বাড়িয়ে ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত করা প্রয়োজন । প্রকল্প পরিচালকের দপ্তর সূত্র জানায় , প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধির প্রয়োজনে এক্সিম ব্যাংক , কোরিয়ার সম্মতি নিতে একটি প্রস্তাব রেলপথ মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছেন প্রকল্প - সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা । প্রকল্পের কর্মকর্তারা জানান , প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি হয়েছে ৮৫ শতাংশ এবং আর্থিক অগ্রগতি ৮০ শতাংশ । ৩৫ টি কোচের মধ্যে ১৫ টি মে মাস নাগাদ এবং ১৫ টি জুলাই - আগস্টে দেশে আসতে পারে । কিন্তু সামনে বাজেট , তাই এই অর্থবছরে আর টাকা পাওয়া যাবে না । টাকা পাওয়া যাবে আগামী অর্থবছরে । ফলে কোচ কেনার টাকা পরিশোধ করতে সময় লাগবে । এ জন্য প্রকল্পের মেয়াদ বাড়াতে হবে ।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক মো . আফজাল হোসেন আজকের পত্রিকাকে বলেন , কোচ কেনার পর কিছু টাকা সাশ্রয় হওয়ায় অতিরিক্ত ৩৫ টি কোচ কেনা হচ্ছে । কোচগুলো এখন তৈরির পর্যায়ে রয়েছে । জার্মান কোম্পানি জানিয়েছে , কোচগুলো ইউক্রেন - রাশিয়া যুদ্ধে ব্যবহার হবে কি না, এর ক্লিয়ারেন্স লাগবে এবং ভ্যাট- ট্যাক্সের বিষয় রয়েছে । এ দুই কারণে কোচগুলো আসতে দেরি হচ্ছে । এসব কারণে নির্ধারিত সময়ে প্রকল্প শেষ হবে না । তাঁরা আশা করছেন , ডিসেম্বরের মধ্যে কোচগুলো চলে আসবে । তবে প্রকল্পের মেয়াদ এক বছর বাড়বে । এই প্রকল্পের অর্থায়ন করছে কোরিয়ার এক্সপোর্ট - ইমপোর্ট ( এক্সিম ) ব্যাংকের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সহযোগিতা তহবিল ( ইডিসিএফ ) এবং বাংলাদেশ সরকার । প্রকল্পে মোট খরচ হচ্ছে ৬৫৮ কোটি টাকা । এর মধ্যে ইডিসিএফের আছে ৭৮.৬৩ শতাংশ এবং বাংলাদেশ সরকারের ২১.৩৭ শতাংশ । যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ( বুয়েট ) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মো . হাদিউজ্জামান আজকের পত্রিকাকে বলেন , বেঁচে যাওয়া টাকা দিয়ে কোচ কেনার সিদ্ধান্ত ভালো উদ্যোগ । কিন্তু প্রকল্পের শুরুতে পরিকল্পনাটা আরও ভালোভাবে করলে টাকা সাশ্রয় করে একবারেই প্রয়োজনীয় কোচ কেনা যেত । তাহলে বারবার প্রকল্পের মেয়াদও বাড়াতে হতো না । এসব কারণে প্রকল্পের উপযোগিতা নষ্ট হচ্ছে ।