Image description
গত ৬ মাসে বিভিন্ন টকশো এবং ফেইসবুকে স্ট্যাটাসে ১৯৪৭ নিয়ে এই তথ্যটা শুনলাম রিপিটেডলি যে, জামায়াত ১৯৪৭ সালেও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে ছিল। তো , একজন পাঠক হিসেবে তথ্যটা মেইক সেন্স করছিল না দেখে যাচাই করার প্রয়োজন অনুভব করলাম। করে যা পেলাম, সেটাই আজকে শেয়ার করবো ।
 
১৯৪৭ এ দেশভাগের ইতিহাসে ২ টা প্রশ্ন সামনে এসে দাঁড়ায়।
 
প্রশ্ন ১ঃ মুসলিমদের জন্য স্বতন্ত্র আবাসভূমি প্রয়োজন কিনা? নাকি অখন্ড ভারত ই সমাধান?
 
প্রশ্ন ২ঃ যদি মুসলিমদের জন্য স্বতন্ত্র আবাসভূমি বা দেশ হয়, সেটা কোন নীতির ভিত্তিতে পরিচালিত হবে?
প্রথম প্রশ্নের জবাবে দেওবন্দ এর ততকালীন প্রিন্সিপ্যাল সাইয়েদ হুসাইন আহমাদ মাদানী রহিমাহুল্লাহ অখন্ড ভারতের পক্ষে অবস্থান নেন। কারন, দেওবন্দী কওমী অনেক উলামারাই ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন করতে যেয়ে কংগ্রেসে যোগ দেন। এবং ব্রিটিশদের মোকাবিলায় তারা হিন্দু কংগ্রেসের সাথে যোগ দেয়াটাকেই উত্তম মনে করেন।
এর মোকাবেলায় সবচেয়ে ক্ষুরধার যেই বই লেখা হয়, মুসলিমদের স্বতন্ত্র আবাসভূমির পক্ষে , তা লিখেন মাওলানা মওদূদী (ততকালীন জামায়াতের আমীর) (তথ্যসূত্রঃ ইসলাম ও জাতীয়তাবাদঃ মাওলানা মওদূদী - পৃষ্টা - ১০২-১১৭)।
এই বইয়ের এক পর্যায়ে মাওলানা মওদূদী লিখেন,
 
"পাক-ভারতের কোনো কল্যাণকামীই কি একজাতীয়তা সমর্থন করতে পারে ?
 
এ দেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ মনে করেন যে, বৈদেশিক শক্তির গোলামীর নাগপাশ থেকে মুক্তিলাভ করার জন্য এ দেশে জাতীয়তাবাদ সৃষ্টি করা অপরিহার্য। আর জাতীয়তাবাদ সৃষ্টির প্রয়োজন একজাতীয়তা। কাজেই বর্তমানের সকল জাতীয়তাকে নির্মূল করে এক সর্বদলীয় জাতীয়তা গঠন করা আবশ্যক। অথচ প্রকৃতপক্ষে তাদের এ চিন্তা একেবারেই অমূলক। তাদের মধ্যে যদি নির্ভূল অর্ন্তদৃষ্টি বর্তমান থাকতো এবং পাশ্চাত্যেও মানসিক গোলামী থেকে মুক্ত হয়ে যদি তারা চিন্তা করতে চেষ্টা করতেন, তবে তারা নিঃসন্দেহে বুঝতে পারতেন যে, একজাতীয়তার পথে পাক-ভারতের বিন্দুমাত্র মুক্তি নেই-আছে মারাত্মক ধ্বংস ও বিলুপ্তি।"
 
এই ব্যাপারে আরো সবিস্তারে জানতে হলে পড়ুন "ইসলামী জাগরনের তিন পথিকৃত" এবং "ইসলাম ও জাহেলিয়াতের চিরন্তন দ্বন্দ্ব"।
 
এই বইটা খোদ মুহাম্মাদ আলী জিন্নাহ সবচেয়ে বেশি ব্যাবহার করেন পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ধর্মীয় যৌক্তিকতা প্রমানের জন্য। এছাড়াও মাওলানা আশরাফ আলী থানভী এবং শিব্বির আহমেদ উসমানীর মত উলামারা এই প্রশ্নে হুসাইন আহমাদ মাদানীর বিপক্ষে এবং মাওলানা মওদূদীর লেখাকে সাপোর্ট দেন। এই বইয়ে যেহেতু তুলনামূলক ইয়াং মাওলানা মওদূদী দেওবন্দের মুহতামিম সাইয়েদ হুসাইন আহমাদ মাদানীর অখন্ড ভারত প্রকল্পের বিরোধিতা করেন, তখন থেকেই কওমীদের সাথে মাওলানা মওদূদীর প্রজন্মান্তরে শত্রুতা শুরু হয়।
 
দ্বিতীয় প্রশ্নের জবাব খুজতে গেলে দেখা যায়, মুহাম্মাদ আলী জিন্নাহ সহ পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রস্তাবক সবাই একে ইসলামী রাষ্ট্র হিসেবে শ্লোগানে, বক্তব্যে বলছিলেন, যদিও রাষ্ট্রের গঠন প্রকৃতি এবং নীতি নির্ধারন হচ্ছিল জাস্ট নিছক একটা জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র হিসেবে, যার ক্ষমতা বংশগত মুসলিমদের হাতে থাকবে। এই দ্বিতীয় প্রশ্নের জবাবে, মাওলানা মওদূদী আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্ট্রেচি হলে "ইসলামী বিপ্লবের পথ" শীর্ষক আলোচনা রাখেন (যা এখন পুস্তিকা হিসেবে বিদ্যমান)। সেখানে তিনি দেখান যে, ইসলামী রাষ্ট্র প্রকল্প আসলে পুরাপুরি ভিন্ন একটা প্রকল্প, যেখানে রাষ্ট্রের চৌকিদার থেকে নিয়ে প্রেসিডেন্ট সবাইর চরিত্র ইসলামের ধাচে সততা, জবাবদিহিতা, আমানতদারিতার উপর তৈরী হয়ে থাকে। সুতরাং, তখন যেই প্ল্যানে মুসলিম লীগ আগাচ্ছিল, তা ছিল তেতুল গাছের বিচি লাগিয়ে আমের ফলন আশা করার মত। বরঙ, পাকিস্তান সত্যিকারের ইসলামী রাষ্ট্র হইতে গেলে মুসলিম লীগের নীতি দিয়ে হবে না। সেখানে লাগবে ইসলামী নীতি এবং তাতে করেই পাকিস্তান সত্যিকারের উন্নতি, প্রগতি, দূর্নীতিহীনতার দিকে যেতে পারবে।
সো, সহজ ভাষায় যদি আবার বলি, পাকিস্তান রাষ্ট্রের পক্ষে তো মাওলানা মওদূদী ছিলেন (জামায়াতের ততকালীন আমীর) ই ১৯৪৭ সালে, বরং তিনিই সবচেয়ে ক্ষুরধার বই লিখেছেন মুসলিমদের স্বতন্ত্র আবাসভূমির পক্ষে। সুতরাং, না জেনে যে চর্বিতচর্বন বলা হয়, সেগুলা আসলে ভুল। আর পাকিস্তানের পরিচালনার নীতিতে যেয়ে ইসলাম বনাম জাতীয়তাবাদ প্রশ্নে তিনি মুসলিম লীগের নীতির বিরোধিতা করেন।
 
আরো একটা যুক্তি দিয়ে প্রমান দেই তিনি কি পরিমান পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পক্ষে ১৯৪৭ এ ছিলেন!। অখন্ড ব্রিটিশ ভারতে তিনি বই লিখেছিলেন ধর্মহীন গনতন্ত্রের বিপক্ষে। কারন, সেখানে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। সেখানে একটা ইসলামী দল গনতন্ত্রের পক্ষে দাঁড়ানো মানেই তার কাছে ছিল হিন্দু মেজরিটিকে পলিসি মেইকিং এর জায়গায় দিয়ে দেওয়া। এই জন্য তার কাছে ব্রিটিশ ভারতে গনতন্ত্র ছিল ধর্মহীনতা। আর তিনিই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরে গনতন্ত্রে অংশগ্রহন করেন , যেহেতু তিনি বিশ্বাস করেন যে, অধিকাংশ জন্মগত মুসলিমকে দাওয়াতী কাজের মাধ্যমে ইসলামী রাষ্ট্রের সুফল বুঝাইতে পারলে তারা এইকাজে অগ্রগামী হতে পারে। ১৯৫৭ সালে মাছিগোটে জামায়াতের রুকন সম্মেলনে গনতান্ত্রিক নির্বাচনে অংশগ্রহন নিয়ে বিতর্ক হয়। ইসরার আহমেদ, মাওলানা আমীন আহসান ইসলাহী সহ কয়েকজন ছিলেন এর বিরুদ্ধে। তখন তাদের জবাব দিতে যেয়ে মাওলানা মওদূদী ৬ ঘন্টার বক্তব্য দেন। তাতেও তিনি উল্লেখ করেন যে, গনতন্ত্রের বিপক্ষে ব্রিটিশ ভারতে তার অবস্থান দিয়ে পাকিস্তানে গনতন্ত্রে অংশগ্রহনের মাসয়ালা বিচার করা যাবে না। কারন, এক দেশ হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ট। আর পাকিস্তান তো তৈরীই হইছে "পাকিস্তান কা মতলব কিয়া, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ", এবং মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট নাগরিকদের নিয়ে। সো, ব্রিটিশ ভারতে গনতন্ত্রে অংশগ্রহনকে তিনি নাযায়েজ মনে করতেন, কিন্তু পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠার পরে তিনি মনে করেন যে, নির্বাচনে অংশগ্রহনের শরয়ী বাধা দূর হয়েছে। কারন, সংখ্যাগরিষ্ঠা নাগরিক যেহেতু মুসলিম। পাকিস্তানের পক্ষে উনার অবস্থানের এরকম অনেক জোরালো প্রমান আছে। ১৯৪৯ এ পাকিস্তানে ইসলামী শাসনতন্ত্র প্রণয়নের পিছনেও তার জোরালো অবদান ছিল। অথচ, এগুলা কিছুই অখন্ড ভারতে সম্ভব হত না।
 
সুতরাং, পাকিস্তানের পরিচালনা পদ্ধতি ইসলামী নীতি বনাম জাতীয়তাবাদ নীতি প্রশ্নে জিন্নাহর সাথে তার মতবিরোধ কে নিয়ে তিনি পুরা পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্টা বা মুসলিমদের আলাদা আবাসভূমির কনসেপ্ট এর ই বিরোধী ছিলেন বলা- অত্যন্ত বিরাট ঐতিহাসিক তথ্যগত ভুল এবং জুলুম।
 
আমার জানামতে , "পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ও বিরুদ্ধে ছিল জামায়াত" - এই বয়ান তৈরী করছিলেন মরহুম আবদুল গাফফার চৌধুরী। তিনি লন্ডনে বসে বসে এরকম অনেক কল্পিত জিনিস বানিয়ে ফেলতেন। কিন্তু এসব করেও খুব ভাল সংখ্যক মেধাবী তরুন , যেমন Sadiqur Rahman Khan বা তার মত অনেককেই এই প্রপাগান্ডা স্পর্শ করে গেছে!
আশা করি, এই পোস্টে তাদের ভ্রান্তি দূর হবে।