Image description

২০২৪ সালের জুলাইয়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাকারী ঢাকার বিভিন্ন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের (ওসি) নামে মামলা হয়েছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ পালিয়ে গেছেন, আবার অনেকে গ্রেফতার হয়ে কারাগারে আছেন। এর মধ্যে কয়েকজনকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে।

সম্প্রতি সারাবাংলার পক্ষ থেকে পুলিশ সদর দফতরে খোঁজ-খবর নিয়ে ঢাকার ওসিদের বর্তমান অবস্থানের বিষয়ে জানা গেছে।

ছাত্র আন্দোলন চলাকালে ওসিদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মারমুখী ছিলেন- উত্তরা পূর্ব থানার ওসি, যাত্রাবাড়ী থানার ওসি, মিরপুর মডেল থানার ওসি, পল্টন থানার ওসি, শাহবাগ থানার ওসি, বাড্ডা থানার ওসি, ওয়ারী থানার ওসি, বংশাল থানার ওসি, মতিঝিল থানার ওসি, নিউমার্কেট থানার ওসি, ধানমন্ডি থানার ওসি, মোহাম্মদপুর থানার ওসি, আদাবর থানার ওসি, খিলগাঁও থানার ওসি, রামপুরা থানার ওসি, বনানী থানার ওসি, কাফরুল থানার ওসি, চকবাজার থানার ওসি ও কদমতলী থানার ওসি।

এদের চেয়ে একটু কম মারমুখী ছিলেন- শেরেবাংলা নগর থানার ওসি, কলাবাগান থানার ওসি, রমনা থানার ওসি, শাহজাহানপুর থানার ওসি, গুলশান থানার ‍ওসি, তেজগাঁও থানার ওসি, লালবাগ থানার ওসি, সুত্রাপুর থানার ওসি, শ্যামপুর থানার ওসি, উত্তরা পশ্চিম থানার ওসি, পল্লবী থানার ওসি, তুরাগ থানার ওসি, খিলখেত থানার ওসি, ভাটারা থানার ওসি, হাতিরঝিল থানার ওসি ও ডেমরা থানার ওসি।

রাজধানীতে ৫০টি থানা রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মারমুখী ছিলেন ২০ থানার ওসি। দ্বিতীয় বেশি মারমুখী ছিলেন ১৬টি থানার ওসি। বাকি ১৪টি থানার ওসি তেমন মারমুখী ছিলেন না বলে তদন্তে উঠে এসেছে। বাকি ১৪টি থানার ওসি ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের হুকুম শুনলেও সেইভাবে মারমুখী হয়ে ওঠেননি। অর্থাৎ ছাত্র-জনতার ওপর সেরকম কোনো গুলিবর্ষণ করেননি। আন্দোলন দমানোর জন্য কৌশলী ভূমিকায় ছিলেন। আবার অনেক থানা এলাকায় সেরকম আন্দোলনও ছিল না বলে উঠে এসেছে। এরমধ্যে কামরাঙ্গীরচর থানা, গেন্ডারিয়া থানা, হাজারীবাগ থানা, দারুস সালাম থানা, রূপনগর থানা, ক্যান্টনমেন্ট থানা অন্যতম।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট গণ অভ্যুত্থানের পর শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে গেলে ঢাকাসহ সারাদেশের পুলিশ নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। পুলিশ ছাড়াই বেশকিছু দিন চলে দেশ। বিশেষ করে মারমুখী পুলিশ সদস্যদের কারণে অন্যান্য পুলিশ সদস্যরাও নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। কারণ, তখন পুলিশ দেখলেই জনতা হামলে পড়ছিল। দেশ স্বাভাবিক হতে শুরু করলে মারমুখী ওসিদের বিরুদ্ধে মামলা হতে থাকে। তখন ছাত্র-জনতার ওপর গুলিবর্ষণের ঘটনায় জড়িত পুলিশ সদস্যরা পালিয়ে যায়।

পুলিশ সদর দফতর থেকে দীর্ঘদিন ধরে পলাতক পুলিশ সদস্যদের কর্মস্থলে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানালেও সাড়া মেলেনি। তবে মারমুখী বেশকিছু পুলিশ চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন। এদের মধ্যে অনেককে গ্রেফতার করা হয়। বাকিরা এখনো পলাতক রয়েছেন।

যাত্রাবাড়ী থানার ওসি আবুল হাসানকে ট্রাইব্যুনালের মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। তিনি এখন কারাগারে রয়েছেন। জুলাই আন্দোলন চলাকালে তার নির্দেশে ছাত্র-জনতার ওপর বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ করে একাধিক হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়।

গুলশান থানার ওসি মাজহারুল ইসলাম কাজলকে গণহত্যার দায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। তিনিও গুলশান শাহজাদপুর এলাকায় আন্দোলনরত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি বর্ষণ করেন। এতে বেশ কয়েকজন নিহত হন।

তবে বনানী থানার সাবেক আলোচিত ওসি বিএম ফরমান আলী মারমুখী আচরণ করেও পালিয়ে যাওয়ায় গ্রেফতার থেকে বেঁচে যান। পলাতক থাকায় তাকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি।

রাজধানীর উত্তরা পূর্ব থানা থেকে পালিয়েছেন গ্রেফতার হওয়া সাবেক ওসি শাহ আলম। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ঘটনায় একটি মামলায় উত্তরা পূর্ব থানা পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। গত ৯ জানুয়ারি তাকে আদালতে সোপর্দ করার প্রক্রিয়া চলছিল। তবে তার আগেই তিনি কৌশলে পালিয়ে যান। পরে ডিএমপি কমিশনার এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘সম্ভবত ওসি শাহ আলম ভারতে পালিয়ে গেছেন। তবে তার বিরুদ্ধে সারাদেশে রেড এলার্ট জারি করা আছে।’

রমনা মডেল থানার আলোচিত সাবেক ওসি মশিউর রহমানকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তিনিও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মামলায় কারাগারে রয়েছেন।

বিমানবন্দর থানার ওসি মোহাম্মদ ইয়াসির আরাফাত খানকে বান্দরবান ইন-সার্ভিস ট্রেনিং সেন্টারে, দক্ষিণখান থানার ওসি মো. আশিকুর রহমানকে পিরোজপুর ইন-সার্ভিস ট্রেনিং সেন্টারে, উত্তরা পূর্ব থানার ওসি মো. শাহ আলমকে কুষ্টিয়া ইন-সার্ভিস ট্রেনিং সেন্টারে, শাহীনুর রহমানকে লালমনিরহাট ইন-সার্ভিস ট্রেনিং সেন্টারে, বনানী থানার ওসি কাজী শাহান হককে রংপুর পিটিসিতে, বাড্ডা থানার ওসি মোহাম্মদ আবু ছালাম মিয়াকে খাগড়াছড়ি ৬ এপিবিএনে, নিউ মার্কেট থানার ওসি মো. আমিনুল ইসলামকে শিল্পাঞ্চল পুলিশে, হাজারীবাগ থানার ওসি নূর মোহাম্মদকে ঠাকুরগাঁও ইন-সার্ভিস ট্রেনিং সেন্টারে, কলাবাগান থানার ওসি মো. মফিজুল আলমকে খাগড়াছড়ি এপিবিএন এবং বিশেষায়িত ট্রেনিং সেন্টারে, রমনা থানার ওসি উৎপল বড়ুয়াকে কুষ্টিয়া ইন-সার্ভিস ট্রেনিং সেন্টারে এবং ধানমন্ডি থানার ওসি মোহাম্মদ এমরানুল ইসলামকে নোয়াখালী পিটিসিতে বদলি করা হয়েছে।

এছাড়া, শ্যামপুর থানার ওসি মো. আতিকুর রহমানকে গাইবান্ধা ইন-সার্ভিস ট্রেনিং সেন্টারে, ওয়ারী থানার ওসি জানে আলম মুনশীকে ১৪ এপিবিএনে, যাত্রাবাড়ী থানার ওসি মো. আবুল হাসানকে ১৬ এপিবিএনে, রূপনগর থানার ওসি মোহাম্মদ আব্দুল মজিদকে বরিশাল ইন-সার্ভিস ট্রেনিং সেন্টারে, ভাসানটেক থানার ওসি মো. নাসির উদ্দিনকে মহালছড়ি এপিবিএন ইন-সার্ভিস ট্রেনিং সেন্টারে, মুগদা থানার ওসি তারিকুজ্জামানকে সারদা বিপিএতে, মোহাম্মদ গোলাম মউলাকে নোয়াখালী ইন-সার্ভিস ট্রেনিং সেন্টারে, মুহাম্মদ কামরুল ইসলামকে ১০ এপিবিএনে, হাতিরঝিল থানার ওসি শাহ মো. আওলাদ হোসেনকে হবিগঞ্জ ইন-সার্ভিস ট্রেনিং সেন্টারে, মো. আহাদ আলীকে এপিবিএনে এবং মোহাম্মদপুর থানার ওসি দীপক চন্দ্র সাহাকে লালমনিরহাট ইন-সার্ভিস ট্রেনিং সেন্টারে বদলি করা হয়েছে।

এর আগে গত ১২ আগস্ট পুলিশ সদরদফতরের অপর এক প্রজ্ঞাপনে ১৮ পুলিশ পরিদর্শককে বদলি করা হয়। প্রজ্ঞাপনে দেখা যাচ্ছে, উত্তরা পশ্চিম থানার ওসি বিএম ফরমান আলীকে খাগড়াছড়ি এপিবিএন ট্রেনিং সেন্টারে, গুলশান থানার মো. মাজহারল ইসলামকে খাগড়াছড়ি এপিবিএন ট্রেনিং সেন্টারে, শাহবাগ থানার মো. মোস্তাজিরুর রহমানকে বরিশাল ইন-সার্ভিস ট্রেনিং সেন্টারে, মতিঝিল থানার মো. আবুল কালাম আজাদকে পিরোজপুর ইন-সার্ভিস ট্রেনিং সেন্টারে পাঠানো হয়েছে।

পল্টন থানার মনির হোসেন মোল্লাকে সুনামগঞ্জ ইন-সার্ভিস ট্রেনিং সেন্টারে, কদমতলী থানার কাজী আবুল কালামকে খাগড়াছড়ি এপিবিএন ট্রেনিং সেন্টারে, পল্লবী থানার অপূর্ব হাসানকে ঠাকুরগাঁও ইন-সার্ভিস ট্রেনিং সেন্টারে, তেজগাঁও থানার মোহাম্মাদ মহসীনকে সুনামগঞ্জ ইন-সার্ভিস ট্রেনিং সেন্টারে, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার এবিএম মশিউর রহমানকে রাঙ্গামাটি এপিবিএন-এ, উত্তরখান থানার ওসি মো. আবু সাঈদ আল মামুনকে বান্দরবান ইন-সার্ভিস ট্রেনিং সেন্টারে বদলি করা হয়েছে বলে প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়েছে।

তুরাগ থানার ওসি আনিচুর রহমান মোল্লাকে শেরপুর ইন-সার্ভিস ট্রেনিং সেন্টারে, ভাটারা থানার কাজী মাইনুল ইসলামকে নেত্রকোনা ইন-সার্ভিস ট্রেনিং সেন্টারে, খিলক্ষেত থানার শেখ শাহানুর রহমান খাগড়াছড়ি ইন-সার্ভিস ট্রেনিং সেন্টারে, মুগদা থানার আবু আনছারকে জামালপুর ইন-সার্ভিস ট্রেনিং সেন্টারে, রামপুরা থানার মোহাম্মদ রিজাউল হককে সিলেট ইন-সার্ভিস ট্রেনিং সেন্টারে, ডেমরা থানার মোহাম্মদ জহিরুল ইসলামকে খাগড়াছড়ি এপিবিএন ট্রেনিং সেন্টারে, মিরপুর মডেল থানার মুন্সী সাব্বির আহম্মদকে লালমনিরহাট ইন-সার্ভিস ট্রেনিং সেন্টারে, আদার থানার মো. মাহাবুব রহমানকে গাইবান্ধা ইন-সার্ভিস ট্রেনিং সেন্টারে বদলি করা হয়েছে।

দুই দফায় ডিএমপির ৫০ থানার ওসিকে বদলি করা হয়। শিক্ষার্থীদের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় এসব ওসির বেশিরভাগই ছাত্রদের ওপর গুলি চালানো, গণগ্রেফতার ও হয়রানির সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন। যার কারণে সব ওসিকে বদলি করা হয়। এর পর তদন্ত সাপেক্ষে ওসিদের বিচার কথা বলা হয়েছিল।

এনসিপির উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম সারাবাংলা বলেন, ‘জুলাই আন্দোলনে গুলিবর্ষণের সঙ্গে জড়িত অনেক ওসি ধরা-ছোঁয়ার বাইরে রয়েছে। অনেকে পলাতক আছে। কিন্তু পুলিশ কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। জুলাই আন্দোলনের বাহক হিসেবে আমরা সরকারকে সবসময়ই জড়িত অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে বলে আসছি। কিন্তু সরকারের মধ্যে অনেক ধীর গতি দেখা যাচ্ছে। আবার যারা গ্রেফতার হয়েছেন তাদেরও অনেকে এরই মধ্যে বেরিয়ে গেছে বা যাচ্ছে। এভাবে চললে বিপ্লবের যে চেতনা নিয়ে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে তা বাধাগ্রস্ত হবে বলে মনে করি।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ সদর দফতরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর সারাবাংলাকে বলেন, ‘গণহত্যার সঙ্গে জড়িত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মামলায় ঢাকা ও ঢাকার বাইরের সাবেক বেশ কয়েকজন ওসি গ্রেফতার হয়েছেন। বেশ কয়েকজন পলাতক রয়েছেন। তাদের ধরতে চেষ্টা চলছে। তাদেরকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে। আরও যারা আছেন আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে তাদেরও গ্রেফতার করা হবে।