
পতিত শেখ হাসিনার শাসনামলে আয়কর অব্যাহতি সুবিধা দেওয়ার ক্ষেত্রে চরম আওয়ামীকরণ ঘটেছে। একদিকে দলীয় লোকদের একচ্ছত্র ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ তৈরি করে দেওয়া হয়, অপরদিকে সেসব ব্যবসা থেকে অর্জিত আয়কে করমুক্ত সুবিধা দেওয়া হয়।
সেবামূলক কাজের নামে আওয়ামী লীগের আদর্শ প্রচারে নিয়োজিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকেও দেওয়া হয় কর অব্যাহতি সুবিধা। এসব সুবিধা দেওয়ার কারণে সরকারের রাজস্ব আদায় কমেছে কিন্তু পকেট ভারী হয়েছে আওয়ামী সুবিধাভোগী ব্যবসায়ী ও দোসরদের।
আওয়ামী লীগের শাসনামলের পুরো সময়ে বিভিন্ন সময়ে এসআরও জারি করে কর অব্যাহতি সুবিধা দেয় রাজস্ব আদায়কারী প্রতিষ্ঠান এনবিআর। কর অব্যাহতি সুবিধার আড়ালে কালো টাকার প্রভাব, দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের মতো গুরুতর অপরাধ ঘটে থাকতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে আয়কর আইন সংস্কারে গঠিত টাস্কফোর্স কমিটি কর অব্যাহতি সুবিধা বাতিলের সুপারিশ করেছে। ইতোমধ্যে বেশকিছু প্রতিষ্ঠানের কর অব্যাহতি সুবিধা বাতিল করেছে এনবিআর। এগুলোর মধ্যে শেখ হাসিনার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের সূচনা ফাউন্ডেশন, আওয়ামী লীগের থিংকট্যাঙ্ক হিসেবে পরিচিত সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন-সিআরআই অন্যতম।
সংশ্লিষ্টরা জানান, রপ্তানি আয় বৃদ্ধি, সুষম আঞ্চলিক উন্নয়ন, বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও উন্নয়নে উৎসাহ প্রদান এবং অবকাঠামোগত প্রবৃদ্ধিকে উদ্দীপিত করতে আয়করব্যবস্থায় বিভিন্ন অগ্রাধিকারমূলক বা প্রণোদনা দেওয়া হয়। এগুলোর মধ্যে রয়েছে হ্রাসকৃত হারে কর কর্তন, সম্পূর্ণ কর অব্যাহতি কিংবা আর্থিক প্রণোদনা। কিন্তু শেখ হাসিনার শাসনামলে অগ্রাধিকারমূলক এসব প্রণোদনার সুবিধাভোগীর বেশিরভাগই পেয়েছে আওয়ামী ঘনিষ্ঠ প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিবর্গ। অর্থনৈতিক গুরুত্বের চেয়ে প্রাধান্য পেয়েছে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি।
অর্থনীতিবিদরা জানান, রাজনৈতিক কিংবা দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে করছাড় দেওয়ার সুযোগ থাকা উচিত নয়। কিন্তু বিগত সময়ে এমন অনেক প্রতিষ্ঠানকে করছাড় দেওয়া হয়েছে, যেগুলোর অর্থনৈতিক কোনো উপযোগ নেই। শুধুমাত্র দলীয় লোকদের সুবিধা দেওয়ার জন্যই কর অব্যাহতি কিংবা হ্রাসকৃত হারে কর সুবিধা দেওয়া হয়েছে। এতে কোনো ধরনের নিয়মনীতি অনুসরণ করা হয়নি।
জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মাসরুর রিয়াজ আমার দেশকে বলেন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনা বিবেচনায় আয়কর অব্যাহতি সুবিধা দেওয়া হয়। এ ছাড়া প্রাকৃতিক বিপর্যয় বা বড় ধরনের অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় আয়কর অব্যাহতি সুবিধা দেওয়া হয়। কিন্তু বিগত সময়ে এমন অনেক প্রতিষ্ঠানকে আয়কর সুবিধা দেওয়া হয়েছে, যার সঙ্গে এর কোনোটিরই কোনো সম্পর্ক নেই। শুধুমাত্র দলীয় বিবেচনায় আয়কর সুবিধা দেওয়া হয়েছে।
আওয়ামী লীগের আমলে আয়কর সুবিধাপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আওয়ামী লীগের দলীয় আদর্শ প্রচারে গঠিত সিআরআই, রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ফাউন্ডেশন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্ট, ললিত মোহন ধনবতী মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশন এবং সুরের ধারা অন্যতম। এসব প্রতিষ্ঠানকে আয়কর অব্যাহতির যে সুবিধা দেওয়া হয়েছে, তার কোনো সময়সীমা উল্লেখ নেই। অর্থাৎ সীমাহীন সময়ের জন্য তাদের এ সুবিধা দেওয়া হয়েছিল।
টাস্কফোর্সের একজন সদস্য আমার দেশকে বলেন, আওয়ামী লীগের শাসনামলে খুবই প্রভাবশালী ব্যক্তিরা এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। আয়কর অব্যাহতি সুবিধার কারণে এসব প্রতিষ্ঠানের আয়কর রিটার্ন নীরিক্ষার বাধ্যবাধকতা নেই। ক্ষমতার প্রভাববলয়ে থাকায় এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দুর্নীতি, অর্থ পাচার, কালো টাকা সাদা করাসহ বিভিন্ন আর্থিক অনিয়ম ঘটে থাকতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
রবীন্দ্র সংগীতশিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার ‘সুরের ধারা’ নামে সংগীত প্রতিষ্ঠানের আয়কেও করমুক্ত সুবিধা দেয় আওয়ামী লীগ সরকার। এনবিআরের একজন সদস্য এ প্রসঙ্গে বলেন, এটার কোনো যৌক্তিকতা ছিল না। শুধু শেখ হাসিনা ও আওয়ামী ঘনিষ্ঠ হিসেবে রেজওয়ানা চৌধুরীর সুরের ধারাকে আয়কর সুবিধা দেওয়া হয় বলে মন্তব্য করেন তিনি। এভাবে আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ সংগঠন, সমিতি, ট্রাস্টিকে আয়কর অব্যাহতি কিংবা কর রেয়াত সুবিধা দেওয়া হয়েছে। অবশ্য অন্তর্বর্তী সরকার ইতোমধ্যে সুরের ধারাকে দেওয়া আয়কর অব্যাহতি সুবিধা বাতিল করেছে। রাজধানীর মোহাম্মদপুরে সুরের ধারাকে দেওয়া জমির ইজারাও বাতিল করেছে সরকার। খাল শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত জমিকে নাল দেখিয়ে সুরের ধারাকে জমির ইজারা দেওয়া হয়েছিল।
আওয়ামী লীগের আমলে কয়লাভিত্তিক নয় এমন বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানিগুলোকে ২০৩৬ সালের জুন পর্যন্ত আয়কর অব্যাহতি সুবিধা দেওয়া হয়। সামিট গ্রুপ ও ইউনাইটেড গ্রুপের মতো আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ কোম্পানিগুলো বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের লাইসেন্স পায়। এসব কোম্পানি সরকারের কাছ থেকে নানা ধরনের আর্থিক সুবিধা যেমন পেয়েছে, তেমনি তাদের অর্জিত আয়কেও করমুক্ত সুবিধা দেওয়া হয়। শুধু তাই নয়, এসব কোম্পানির শেয়ার হস্তান্তরের কারণে মূলধনী মুনাফাকেও আয়করমুক্ত রাখা হয়। এমনকি কর্মরত বিদেশি নাগরিকদের আয়ের ওপর তিন বছরের জন্য করমুক্ত রাখা হয়।
এনবিআর সূত্র জানায়, কোনো ধরনের কর না দিয়েই দেশের বাইরে অর্থ নিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয় এসব কোম্পানির মালিকদের।
এদিকে কর অব্যাহতির বিষয়ে এনবিআরের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে আয়কর অব্যাহতি সুবিধা দেওয়া হয় এক লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা যা, জিডিপির ২ দশমিক ৯ শতাংশ। কর-জিডিপি অনুপাতের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান একেবারে তলানিতে। সবশেষ তথ্যমতে, বাংলাদেশের কর-জিডিপির হার দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৪-এ।
আইএমএফ থেকে বাংলাদেশ ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণ চুক্তির অন্যতম শর্তই হলো কর-জিডিপির হার বাড়াতে হবে। চলতি বছরের জুনের মধ্যে কর-জিডিপির হার ৭ দশমিক ৯-এ এবং আগামী জুনের মধ্যে এটি ৯-এ উন্নীত করার জন্য আইএমএফের পক্ষ থেকে চাপ দেওয়া হচ্ছে।
আইএমএফের চতুর্থ কিস্তির সাড়ে ৬৪ কোটি ডলারসহ বাকি কিস্তগুলোর অর্থছাড়ের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। আর এজন্য আগামী বাজেটে কর অব্যাহতি সুবিধা বাতিলের বিষয়টি বেশ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে এনবিআর।
এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান বলেন, আমরা আয়কর অব্যাহতির সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে চাই।