Image description

রাষ্ট্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা পুলিশ বিভাগ। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয় ও পুলিশ সদর দফতরের মধ্যে বড় ধরনের দুরত্ব ওপেন সিক্রেট। সঠিক সময়ে বঞ্চিত ও যোগ্য কর্মকর্তারা পদোন্নতি ও পদায়ন না পাওয়ায় অস্থিরতা তৈরি হয়েছে পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে। অন্তবর্তীকালিন সরকারের প্রায় নয় মাস ধরে শূণ্য রয়েছে ২০ অতিরিক্ত আইজিপি ও অর্ধশত ডিআইজিসহ শতাধিক পদ। অতিরিক্ত আইজিপি পদে ডিআইজি পদের কর্মকর্তাদের দিয়ে চললেও অনেকগুলো ইউনিটে নেই ইউনিট প্রধান। বর্তমান সরকারের সময় পুলিশ বাহিনীর দাবির পরেও এসএসবি না হওয়ায় এ ধরনের শুণ্যতার সৃষ্টি হয়েছে। আর এ নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দফতরের মধ্যে চলছে রশি টানাটানি। এতে করে সারা দেশে আইন-শৃংখলা উন্নয়ন, নাগরিকসেবা, সামাজিক শৃঙ্খলা ও আইনি সুরক্ষার কাজটিও যথাযথভাবে হচ্ছে না। বরং কোথাও কোথাও পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে।
গত ১২ এপ্রিল ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ (ডিবি) রেজাউল করিম মল্লিককে ডিএমপি সদর দফতরে সংযুক্ত করা হয়। ডিবি শুধু ডিএমপি নয়, সারাদেশের আইন-শৃংখলা রক্ষায় সব সময় অতিগুরুত্বপূর্ণ পুলিশের একটি ইউনিট। অথচ চার দিন হলেও এই ইউনিটটি চলছে কোন ইউনিট প্রধান ছাড়া। গত ৬ এপ্রিল একটি জাতীয় দৈনিকের শিরোনাম ছিল “বেসামাল নরসিংদীর এসপি”। ওই সংবাদে এসপির দুর্নীতিসহ নানা বিষয় উঠে এসেছে। কিন্তু দীর্ঘ ১১ দিনেও এ বিষয়ে দৃশ্যমান কোন পদক্ষেপ গ্রহন করেনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা পুলিশ সদর দফতর। যা পুলিশ বাহিনীতে নজিরবিহীন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিক্রিয়তার কারণে দেশের সার্বিক আইন-শৃংখলায় প্রভাব পড়বে বলে অপরাধ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
পুলিশ সদর দফতরের একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ইনকিলাবকে বলেন, পুলিশ বাহিনীর শত শত পেশাদার কর্মকর্তা পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় মানসিকভাবে খারাপ অবস্থায় ছিলেন ও সামাজিকভাবে হেয় হয়েছেন; তারা এখন নতুনভাবে চাকরি শুরু করেছেন। এ অবস্থায় যত কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া যায়, তত ভালো। কারণ, অন্য ক্যাডারের ব্যাচমেটরা যখন দুই ধাপ বেশি পদোন্নতি পেয়ে যায়, সেটার নেতিবাচক প্রভাব স্বাভাবিকভাবে পুলিশের কর্মকর্তাদের ওপরও পড়বে। এতে করে পুলিশ বাহিনীর চেইন-অব-কমান্ডে প্রভাব পড়বে।
আইন-শৃংখলা ও অপরাধ পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এতগুলো গুরুত্বপূর্ণ পদ শূন্য থাকায় এবং অনেক কর্মকর্তা সংযুক্ত, ওএসডি ও আত্মগোপনে থাকায় প্রভাব পড়েছে পুলিশের সামগ্রিক কার্যক্রমেও। পুলিশের বেশির ভাগ ইউনিটের প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি হিসেবে পূর্ণ দায়িত্ব পায়নি। অনেক ইউনিটে একজন কর্মকর্তাকে একাধিক পদের দায়িত্ব সামলাতে হচ্ছে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে নিয়মিত পদোন্নতি না পাওয়া এবং ‘বঞ্চিত’ হিসেবে পরিচিত কর্মকর্তাদের মধ্যে এমন ক্ষোভ বেশি। কারণ, এমন কর্মকর্তাদের অনেকের চাকরির বয়স এখন শেষের দিকে। পদোন্নতি নিয়ে দীর্ঘসূত্রতার কারণে পদ শূন্য থাকা সত্ত্বেও পদোন্নতি না নিয়েই অনেককে অবসরে চলে যেতে হতে পারে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা ইনকিলাবকে বলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দফতর সঠিক সময়ে পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হওয়ায় ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী সরকারের পতন হলেও হত্যায় অভিযুক্ত ও ইন্ধদাতা পুলিশ কর্মকর্তারা এখনো বহাল তবিয়তে রয়েছে। একই সাথে একাধিক হত্যা মামলার আসামি হয়েও অনেক কর্মকর্তাই পুলিশ বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ ইউনিটের নানা পদে রয়েছে। এসব কর্মকর্তারা একদিকে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাচার করছে পলাতক পুলিশ কর্মকর্তা এবং পতিত আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীদের কাছে, অন্যদিকে গুরুত্বপূর্ণ পদ দখল করে থাকলেও দেশের সার্বিক আইন-শৃংখলা উন্নয়নে তেমন কোন ভূমিকা রাখছে না। ফলে দেশের সার্বিক আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি উন্নতির ক্ষেত্রে ধীরগতিতে কাজ করতে হচ্ছে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের।
ওই কর্মকর্তারা আরও বলেন, পুলিশ সদর দফতরসহ অতিরিক্ত আইজিপি পদমর্যাদার ২০টি ও ডিআইজি অর্ধশত পদ শূণ্য রয়েছে। কিন্তু রহস্যজনক কারনে যোগ্য কর্মকর্তা থাকার পরেও সরকারি কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দিতে গঠিত সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ডের (এসএসবি) বৈঠক দীর্ঘদিন ধরে না হবার কারণেই এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে অনেকটাই নিস্ক্রিয়। ফলে পুলিশ পুন:গঠন ও সারাদেশের পুলিশ ইউনিটগুলোকে সক্রিয় করতে অনেক সময় লেগে যাচ্ছে। শহীদদের রক্তের বিনিময়ে দেশে নতুন সরকার গঠন হলেও খুনের সাথে জড়িত শীর্ষ কর্মকর্তাদের নিয়েই বৈঠক করছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী, স্বরাষ্ট্র সচিব ও পুলিশ সদর দফতরের শীর্ষ কর্মকর্তারা। আ’লীগের ক্যাডারদের রেখে পুলিশ প্রশাসন সংস্কার করা সম্ভব নয়। অতিরিক্ত আইজিপি ও ডিআইজিদের পদোন্নতি দেয়া হলে দ্রুত অতিরিক্ত ডিআইজি, এসপি ও অতিরিক্ত এসপি পদে পদোন্নতি পাবেন যোগ্য-বঞ্চিত পুলিশ কর্মকর্তারা। সরকারের অতি গুরুত্বপূর্ণ পুলিশ প্রশাসনের বাইরে অন্যান্য ক্যাডারে এ ধরনের শূণ্য পদ থাকার নজির নেই। দেশের আইন-শৃংখলা যেন উন্নয়ন না হয় এবং পুলিশ বাহিনীর মধ্যে চেনই-অব কমান্ড যেন ফিরে না আসে সে জন্যই অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে পদোন্নতি ও পদ খালি রেখে চলছে পুলিশ বাহিনী। এমন মন্তব্য করেন এ সব কর্মকর্তা ।
আইজিপি বাহারুল আলম ইনকিলাবকে বলেন, পদোন্নতি ও শূণ্য পদে পদায়নের জন্য পুলিশ সদর দফতর কাজ করছে। একই সাথে দেশের সার্বিক আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি উন্নয়নে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহন করা হয়েছে।
পুলিশের বর্তমান ও সাবেক সদস্য ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুলিশকে সেবামুখী করতে এবং মামলা,তদন্ত, গ্রেপ্তার এবং অভিযানসহ সব ক্ষেত্রে জবাবদিহির আওতায় আনতে শক্ত কাঠামো তৈরি করতে হবে। এ জন্য পুলিশ সংক্রান্ত কিছু আইন ও বিধান যুগোপযোগী করতে হবে। পরপর তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনতে পুলিশ বাহিনীর বড় অংশ দলীয় কর্মীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। এদের মধ্যে যে সব পুলিশ কর্মকর্তারা অতিউৎসাহী ও অপেশাদার কাজের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহন করা জরুরী। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় রাজনৈতিক বিবেচনায় তিন ব্যাচ জুনিয়র কর্মকর্তাকেও তার ওপরে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছিল। বিগত সাড়ে ১৫ বছরে কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদে তাকে দেওয়া হয়নি। এখন তার চাকরির বয়স শেষের দিকে। এখন পদোন্নতি না হলে আগামী কয়েক মাসের মধ্যে তাকে ডিআইজি থেকেই অবসরে যেতে হবে। এ সব বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহন করা না হলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপর আস্থা হারাবে পুলিশ কর্মকর্তারা। আত্মগোপনে থাকা কর্মকর্তাদের অনেকের পদ আইনগতভাবে শূন্য ঘোষণার সুযোগ রয়েছে। তবে এই কাজেও ধীরগতি রয়েছে। ফলে পদোন্নতির প্রক্রিয়ায় একধরনের স্থবিরতা তৈরি হয়েছে। এতে দীর্ঘদিন পদোন্নতিবঞ্চিত কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে। এর প্রভাব পড়ছে পুলিশের সামগ্রিক কার্যক্রমে। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা পদোন্নতি ও পদায়ন নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকায় বাহিনীর ‘চেইন অব কমান্ডেও’ নেতিবাচক পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। অধস্তন কর্মকর্তাদের মধ্যে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশ পালনে ঢিলেঢালা ভাব দেখা যাচ্ছে। পদোন্নতিসহ পুলিশ বাহিনীতে চেইন অব কমান্ড ফিরিয়ে আনতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দফতরকে সমন্বয় করে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহন করা অতি জরুরী।