
ডিসইনফরমেশন ছড়ানোর ক্ষেত্রে ফ্রেইমিং খুবই মোক্ষম একটা অস্ত্র। আপনি আক্ষরিক অর্থে ভুল বা ভুয়া তথ্য না ছড়িয়েও তথ্যকে সুবিধামতো ফ্রেইমিংয়ের মাধ্যমে ভুল তথ্য বা ভুল পারসেপশন ছড়িয়ে দিতে পারবেন মানুষের মধ্যে।
এখানে একই খবরের দুটি পত্রিকায় কিভাবে শিরোনাম করা হয়েছে সেটা লক্ষ্য করলেই ফ্রেইমিংয়ের মাধ্যমে কিভাবে ভুল তথ্য না দিয়েও ভুল ধারণা প্রচার করা যায় তা বুঝা যাবে।
ডেইলি স্টারের শিরোনামটি দেখুন--‘গণঅভ্যুত্থানে আহত আরও ৬০ জনকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানো হবে’
এখানে মূল খবর এটাই (অবশ্য নতুন করে বিদেশে পাঠানো হবে এমন আহতদের সংখ্যা নিয়ে দ্বিমত আছে পত্রিকাগুলোর)।
পরের খবর হলো যে, এই ৬০ জনকে একাধিক দেশে পাঠানো হবে নানান কনসিডারেশনের ভিত্তিতে। এবং সেই দেশগুলোর মধ্যে পাকিস্তানও আছে।
কিন্তু প্রথম আলো শিরোনাম করেছে, ''উন্নত চিকিৎসার জন্য পাকিস্তানে পাঠানো হবে অভ্যুত্থানে আহত ৩১ জনকে''।
এই তথ্যটা অসত্য নয়।
৩১ জনকে পাকিস্তানে চিকিতসার জন্য পাঠানো হবে। এবং ৬০ জনের মধ্যে বাকিদেরকে তুরস্ক, থাইল্যান্ডসহ অন্য দেশে পাঠানো হবে।
প্রথম আলোর রিপোর্টের ভেতরেও উল্লেখ করা হয়েছে যে, পাকিস্তানে ৩১ জনের পাশাপাশি তুরস্কেও ২১ জনকে পাঠানো হবে।
প্রথম আলো শিরোনাম করতে পারতো, ''৫২ আহতকে পাকিস্তান-তুরস্কে পাঠানো হবে'', অথবা ''৫২ আহতকে বিদেশে পাঠানো হবে''।
কিন্তু তারা আহতদের বিষয়ে সামষ্টিক তথ্যকে হাইলাইট না করে নির্দিষ্ট একটা দেশে পাঠানো আহতদের ওপর হাইলাইট করেছে। এইটাই ফ্রেইমিং। কোন ঘটনার একটি দিকের ওপর ফোকাস করে পাঠকের দেখার লেন্স এমনভাবে ঠিক করে দেয়া যাতে ঘটনার বাকি দিক/তথ্যগুলোর ওপর তার দৃষ্টি গৌন হয়ে যায় বা সার্বিক চিত্র থেকে ভিন্ন একটি বাস্তবতা তার সামনে তৈরি হয়। এক্ষেত্রে যদি পাঠকের মধ্যে অলরেডি বিদ্যমান কোন বায়াস থেকে থাকে (ফ্রেইমিংয়ের অনুকূলে) তাহলে এমন ফ্রেইমিং খুবই কার্যকর একটি প্রপাগান্ডা টুলে পরিণত হয়।
যাদের মধ্যে ইতোমধ্যে পাকিস্তান নিয়ে ফোবিয়া আছে এমন পাঠকরা প্রথম আলোর শিরোনামটি দেখে ভয় পাবেন। মনে করবেন, ভারতের কায়েমী স্বার্থবাদীদের সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত বর্তমান ইন্টেরিম সরকার আসলে পাকিস্তানের প্রতি ইনক্লিন্ড হচ্ছে। আবার যারা আগে থেকে মনে করেন যে, পাকিস্তান ভঙ্গুর একটা রাষ্ট্র, ফলে এই রাষ্ট্রের চিকিতসা ব্যবস্থা ভাল হওয়ার কথা না। তার মানে, পাকিস্তানফোবিয়ায় আক্রান্ত মানুষজন আরও নিশ্চিত হবেন যে, যুক্তির উর্ধ্বে উঠে পাকিস্তানে আহতদের পাঠানোর মধ্যে অবশ্যই উচ্চ রাজনীতি রয়েছে, ভারতবিরোধিতা এবং পাকিস্তানপ্রীতি রয়েছে!
অথচ, আপনি যদি স্বাস্থ্যমন্ত্রী ভিডিও বক্তব্য দেখেন তাহলে আপনার কাছে স্পষ্ট হবে যে, পাকিস্তানে আহতদের পাঠানোর বিষয়টি সরকার বিবেচনায় নিয়েছে যুক্তরাজ্যের বিশেষজ্ঞ ডাক্তাদের একটি দলের পরামর্শ মতে। তারা মত প্রকাশ করেছেন যে, যেহেতু পাকিস্তান একটি যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ ফলে সেখানে যুদ্ধাহতদের জন্য বিশেষায়িত হাসপাতাল রয়েছে, ফলে বাংলাদেশের আহতদের সেখানে ভাল চিকিতসা হতে পারে।
ডেইলি স্টারের রিপোর্টে এই বক্তব্যগুলো আছে। প্রথম আলোর রিপোর্টের ভেতরেও সেগুলো আছে।
প্রথম আলো তাদের রিপোর্টটি এভাবে ফ্রেইম করার পর আরো অনেক সংবাদমাধ্যম একই ফ্রেইমে সংবাদটি প্রকাশ করেছে। আমি সময় মিলিয়ে অন্তত ৫টি পত্রিকার ১৩ এপ্রিলের রিপোর্ট চেক করে দেখেছি তারা প্রথম আলোর মতো শিরোনামে খবর প্রকাশ করেছে ওই দিন সন্ধ্যায় ৬টা ৫৭ মিনিটে প্রথম আলোর রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার অনেক পরে।
অর্থাত, প্রথম আলো শুধু নিজের রিপোর্টে ফ্রেইমিংয়ের মাধ্যমে ভুল ধারণা তৈরিতে (সবার জন্য না, যারা পাকিস্তান বিষয়ে একধরনের নেতিবাচক ধারণা দ্বারা প্রিঅকুপাইড আছেন এবং অথবা পুরো রিপোর্ট পড়বেন না) করেনি, বরং আরও অনেক মিডিয়ার এজেন্ডা সেট করে দিতে ভূমিকা রেখেছে।