Image description

দ্রুতগতির ইন্টারনেট সেবাদাতা ‘স্টারলিংক’ নিয়ে বাংলাদেশে চলছে ব্যাপক মাতামাতি। বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় প্রযুক্তি উদ্যোক্তা ইলন মাস্কের প্রতিষ্ঠান ‘স্পেসএক্স’ পরিচালিত স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সেবা স্টারলিংক। সম্প্রতি বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নিবন্ধন পাওয়ার পর বাংলাদেশে পরীক্ষামূলক কার্যক্রম শুরু করেছে স্টারলিংক। তাদের সেবা পুরোদমে চালু হলে বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারের অভিজ্ঞতা পুরোপুরি বদলে যাবে বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের। তবে সেজন্য স্টারলিংককে আগে পেতে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) লাইসেন্স। একই সঙ্গে কার্যক্রম পরিচালনার জন্য স্থাপন করতে হবে অবকাঠামো। এ কাজের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো গ্রাউন্ড স্টেশন স্থাপন। এ কাজে বাংলাদেশের কোন প্রতিষ্ঠান স্টারলিংকের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে, তা নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে ব্যাপক কৌতূহল।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, গ্রাউন্ড স্টেশন স্থাপনের জন্য সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চলছে স্টারলিংকের আলোচনা। তবে এ আলোচনার ক্ষেত্রে কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করছে প্রতিষ্ঠানটি। এমনকি আলোচনার আগে গোপনীয়তা বজায় রাখার শর্তে চুক্তিও করছে তারা। তাই এ নিয়ে দায়িত্বশীল কারও বক্তব্যও পাওয়া যাচ্ছে না। তবে কালবেলার অনুসন্ধানে জানা গেছে, স্টারলিংকের সহযোগী হওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে দেশে প্রযুক্তি খাতের অন্যতম বৃহৎ প্রতিষ্ঠান ‘ফাইব্যার অ্যাট হোম’। এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মঈনুল হক সিদ্দিকীও আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু বলতে রাজি হননি। তবে আলাপকালে কালবেলাকে তিনি বলেন, ইন্টারনেট সেবা পরিচালনার জন্য স্টারলিংক আমাদের কিছু অবকাঠামো ব্যবহার করবে বলে শুনেছি।

যেভাবে এগোচ্ছে স্টারলিংক

একাধিক সূত্র জানিয়েছে, আগামী জুন অথবা জুলাই মাসে শুরু হতে পারে স্টারলিংকের বাণিজ্যিক যাত্রা। প্রথমে ব্যান্ডউইথ ইন্টারনেট সেবা দিয়ে যাত্রা শুরু করবে তারা। আপাতত মোবাইল ইন্টারনেট সেবা মিলবে না স্টারলিংক থেকে। ব্যান্ডউইথ সেবা বাণিজ্যিকভাবে চালুর আগে অবকাঠামো স্থাপনের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে তারা। বাণিজ্যিকভাবে ইন্টারনেট সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে স্টারলিংকের প্রথম টার্গেট থাকবে দেশের বিভিন্ন বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠান, যারা উচ্চগতিসম্পন্ন নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সেবা চান, তারাও হতে পারেন স্টারলিংকের গ্রাহক। এর বাইরে অগ্রাধিকার তালিকায় থাকবে প্রত্যন্ত অঞ্চলের সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো।

দেশে ব্যবসা পরিচালনার জন্য বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) লাইসেন্স পেয়েছে স্টারলিংক। বাংলাদেশ বিনিয়োগ সম্মেলনের উদ্বোধন অনুষ্ঠান থেকে শুরু হয়েছে পরীক্ষামূলক কার্যক্রম। স্টারলিংকের এ সেবা উদ্বোধন করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরুর আগে বিটিআরসি থেকে এনজিএসও (নন-জিওস্টেশনারি অরবিট) নীতিমালার আওতায় লাইসেন্স নিতে হবে। এজন্য তারা আবেদন করলেও এ-সংক্রান্ত আনুষ্ঠানিকতা ও যাচাই-বাছাই শেষ হতে কিছুটা সময় লাগবে। এরপর ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনক্রমে স্টারলিংককে বাণিজ্যিক লাইসেন্স দেবে বিটিআরসি।

সংশ্লিষ্টরা জানান, বাণিজ্যিক সেবা চালুর আগে দেশে একাধিক গ্রাউন্ড স্টেশন স্থাপন করবে স্টারলিংক। স্টেশনের জমি নির্ধারণের জন্য এরই মধ্যে দেশের বিভিন্ন জায়গা পরিদর্শন করেছে স্টারলিংক কর্তৃপক্ষ। সেগুলোর মধ্যে প্রথম ধাপে ৪টি জেলায় গ্রাউন্ড স্টেশন স্থাপনের পরিকল্পনা হয়েছে। এগুলো হতে পারে গাজীপুরের কালিয়াকৈর, কক্সবাজার, যশোর ও চট্টগ্রামে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গ্রাউন্ড স্টেশন স্থাপনসহ অন্যান্য সহযোগিতার জন্য সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে অত্যন্ত গোপনীয়তা বজায় রেখে আলোচনা এগোচ্ছে স্টারলিংক। আলোচনার আগে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ‘নন-ডিসক্লোজার এগ্রিমেন্ট (এনডিএ)’ বা ‘অপ্রকাশযোগ্য চুক্তি’ করেছে তারা। চুক্তির পর শুরু হচ্ছে আলোচনা। শর্ত অনুযায়ী, আলোচনার কোনো বিষয় কোথাও প্রকাশ করা যাবে না। গোপন এমন চুক্তির কারণে স্টারলিংক কোন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কি চুক্তি করছে বা কি সহযোগিতা নিচ্ছে, সেসব বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো তথ্য জানা যাচ্ছে না।

সূত্র বলছে, আলোচনায় ফাইভার অ্যাট হোম এগিয়ে থাকলেও বাংলাদেশে ইন্টারনেট সেবা পরিচালনায় তাদের কাছ থেকেই স্টারলিংক সব সহযোগিতা নেবে—বিষয়টি এমন নয়। স্টারলিংক বাংলাদেশের আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলোচনা করছে। তারা কয়েকটি কোম্পানির কাছ থেকে সহযোগিতা নেবে। তবে সবচেয়ে বেশি সার্ভিসের ব্যবস্থা থাকায় ফাইবার অ্যাট হোমের কাছ থেকেই বেশিরভাগ সহযোগিতা নিতে পারে স্টারলিংক।

স্টারলিংককে যেসব সহায়তা দেবে ফাইবার অ্যাট হোম

সূত্র বলছে, গ্রাউন্ড স্টেশন স্থাপনের পাশাপাশি স্টারলিংকের প্রয়োজনী ট্রান্সমিশন, ব্যান্ডউইথ, কানেক্টিভিটি এবং ডাটা সেন্টার ব্যবহারে সহযোগিতা করবে ফাইবার অ্যাট হোম। গ্রাউন্ড স্টেশনের জন্য জায়গা দেওয়ার পাশাপাশি বিদ্যুতেরও ব্যবস্থা করবে দেশীয় প্রতিষ্ঠানটি। এ ছাড়া গ্রাউন্ড স্টেশন থেকে ডাটা সেন্টারের কানেক্টিভিটি তৈরিতেও ফাইবার অ্যাট হোম থেকে সহায়তায় নেওয়া হবে।

ডাটা রাখার জন্যও ব্যবহার করা হবে গাজীপুর হাইটেক পার্কে ফাইবার অ্যাট হোমের ডাটা সেন্টার। হাইটেক পার্কে থাকা ফাইবার অ্যাট হোমের ডাটা সেন্টারের কয়েকটি র্যাক ব্যবহার করবে স্টারলিংক। এরই মধ্যে এসব বিষয়ে দেশীয় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে আলোচনা শেষ করেছে তারা। এমনকি চুক্তির বিষয়েও অনেকটাই এগিয়ে রয়েছে। যদিও এসব বিষয়ে এখনই আনুষ্ঠানিকভাবে কিছুই প্রকাশ করেনি ফাইবার অ্যাট হোম এবং স্টারলিংক কর্তৃপক্ষ।

‘ফাইবার অ্যাট হোম’ ন্যাশনওয়াইড টেলিকমিউনিকেশন ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক (এনটিটিএন) লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠান। শহর থেকে ইউনিয়ন পর্যায়ে দ্রুতগতির ইন্টারনেট পৌঁছাতে ২০০৯ সালে ফাইবার অ্যাট হোমসহ ছয়টি প্রতিষ্ঠানকে এনটিটিএন লাইসেন্স দেয় সরকার। এরপর গত ১৫ বছরে সারা দেশে ৬০ হাজার কিলোমিটারের বেশি অপটিক্যাল ফাইবার কেবল স্থাপন করেছে প্রতিষ্ঠানটি। আইসিটি বিভাগের আওতাধীন ‘ইনফো-সরকার ২’ ও ‘ইনফো-সরকার ৩’ প্রকল্পও বাস্তবায়ন করেছে ফাইবার অ্যাট হোম। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মঈনুল হক সিদ্দিকী চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার সন্তান।

স্টারলিংকের সঙ্গে সম্পৃক্ততা নিয়ে জানতে চাইলে মঈনুল হক সিদ্দিকী কালবেলা বলেন, এ বিষয়ে বিস্তারিত বলতে পারব না, এটা নিয়ে যারা কাজ করছেন তারা ভালো বলতে পারবেন। ইন্টারনেট সেবা পরিচালনার জন্য স্টারলিংক আমাদের কিছু অবকাঠামো ব্যবহার করবে বলে শুনেছি। ফাইভার অ্যাট হোমের ডাটা সেন্টার অনেকে ব্যবহার করছে উল্লেখ করে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান আরও বলেন, ওরা (স্টারলিংক) যদি ব্যবহার করে তাহলে হয়তো ওদের ৫-৬টা র্যাক লাগতে পারে।

বিশেষজ্ঞ এবং স্থানীয় ব্যবসায়ীরা যা বলছেন

স্টারলিংকের সেবার প্রকৃতি অনুযায়ী, খোলামেলা জায়গা, পর্যাপ্ত পরিমাণ বিদ্যুৎ এবং নিরাপত্তা আছে—এমন স্থান গ্রাউন্ড স্টেশন স্থাপনের জন্য উপযুক্ত। যেখানে গ্রাউন্ড স্টেশন স্থাপন করলে সহজেই ইন্টারনেট ফিড করা যাবে, ফলে এনটিটিএন অপারেটরদের ওপর নির্ভরশীলতা কমে আসবে। এজন্য এ ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রদান করতে পারবে—এমন প্রতিষ্ঠানকে বেছে নিতে হবে তাদের।

যেসব দেশে বর্তমানে স্টারলিংক তাদের ইন্টারনেট সেবা চালু রেখেছে, সেসব দেশেই তারা নিজস্ব গ্রাউন্ড স্টেশন স্থাপন করেছে। এই গ্রাউন্ড স্টেশনগুলো হলো স্টারলিংক স্যাটেলাইট নেটওয়ার্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যার মাধ্যমে মহাকাশে অবস্থিত স্যাটেলাইটগুলোর সঙ্গে পৃথিবীর স্থলভাগে ইন্টারনেট ট্র্যাফিক বিনিময় সম্ভব হয়।

প্রতিটি গ্রাউন্ড স্টেশন সাধারণত ৯টি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন অ্যান্টেনা দিয়ে তৈরি হয়। এই অ্যান্টেনাগুলো বিশেষভাবে ডিজাইন করা হয়, যাতে স্টারলিংকের লো-আর্থ-অরবিট স্যাটেলাইটগুলো থেকে উচ্চগতির ডাটা সিগন্যাল গ্রহণ করা যায়। সিগন্যাল গ্রহণের পর, সেই ডাটাগুলো প্রক্রিয়াকরণের জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে অবস্থিত ডাটা সেন্টারে পাঠানো হয়।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই ডাটা পরিবহন প্রক্রিয়ায় সাবমেরিন কেবল বা আইটিসি অপারেটর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। গ্রাউন্ড স্টেশনে স্যাটেলাইট থেকে প্রাপ্ত ডাটা সিগন্যালগুলো দ্রুতগতির অপটিক্যাল ফাইবার সাবমেরিন কেবলের মাধ্যমে গ্লোবাল ইন্টারনেট অবকাঠামোর সঙ্গে যুক্ত হয়। পুরো প্রক্রিয়াটি স্যাটেলাইট থেকে গ্রাউন্ড স্টেশন, সেখান থেকে সাবমেরিন কেবল হয়ে ডাটা সেন্টারে পৌঁছানো স্টারলিংকের গ্লোবাল কানেক্টিভিটির মূল ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।

দেশীয় সেবাদাতারা যা ভাবছেন

বাংলাদেশে মার্কিন প্রযুক্তি জায়ান্ট স্পেসএক্সের পরিচালিত স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সেবা চালু হলে গ্রামীণ ও দুর্গম এলাকার ডিজিটাল বৈষম্য কমাতে এবং তরুণ প্রজন্মের জন্য শিক্ষা, উদ্ভাবন ও উদ্যোক্তা হওয়ার নতুন পথ উন্মুক্ত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে—এমনটাই বলছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে স্টারলিংকের দ্রুতগতির ইন্টারনেট সেবা চালু স্থানীয় ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারদের (আইএসপি) পড়তে হবে প্রতিযোগিতার মুখে।

ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (আইএসপিএবি) সভাপতি ইমদাদুল হক কালবেলাকে বলেন, নতুন টেকনোলজি এলে সেটার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করেই টিকে থাকতে হবে, সেই বিষয়ে আমাদের প্রস্তুতি রয়েছে। আমাদের মতো কম মূল্যে তারা ইন্টারনেট সেবা দিতে পারবে না। এ কারণে স্টারলিংককে আমরা বড় প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করছি না। তবে কিছু ক্ষেত্রে দেশীয় আইএসপিগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে, বিশেষ করে করপোরেট প্যাকেজগুলোর ক্ষেত্রে লোকাল ইন্টারনেট সরবরাহকারীরা ক্ষতির মুখে পড়বেন।

তিনি আরও বলেন, সরকারের কাছে আমাদের অনুরোধ, দেশীয় উদ্যোক্তাদের সেফ রেখে পলিসি করা। কারণ দেশীয় উদ্যোক্তারা অনেক টাকা বিনিয়োগ করেছেন, তাদের ব্যবসায় যাতে ক্ষতি না হয়। বিদেশি বিনিয়োগ যেমন প্রয়োজন, একই সঙ্গে দেশীয় বিনিয়োগকারীদেরও পলিসি দিয়ে সেইফগার্ড দিতে হবে। আমাদের চাওয়া, সরকার যাতে আমাদের সেইফগার্ড দেয়।