
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) রাজশাহী অফিসে বেশ কিছু সেবার জন্য গ্রাহকেরা প্রতিদিনই ভিড় করেন। কেউ আসেন ড্রাইভিং লাইসেন্স করতে, কেউ গাড়ির রেজিস্ট্রেশন, গাড়ির মালিকানা পরিবর্তন, নম্বর প্লেটের কাজ করতে, ফিটনেস নবায়নের জন্যও আসেন কেউ কেউ।
বৃহস্পতিবার রাজশাহীর এই কার্যালয়ে দিনব্যাপী অবস্থান করে এমন চিত্র পাওয়া গেছে। কাজ কীভাবে করাচ্ছেন—গ্রাহকদের কাছে এমন প্রশ্ন করতেই বেশির ভাগ উত্তর দিলেন, দালালের মাধ্যমে করাচ্ছেন। নিজে কিছু জানেন না। এই না জানার কারণে গ্রাহকের পকেট থেকে অতিরিক্ত দুই হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকা খরচ হয়।
গ্রাহকদের ভাষ্য, কাজ করতে এসে নানা রকম হয়রানি হতে পারে, সময় লাগতে পারে; এ কারণে তৃতীয় পক্ষের (দালাল) মাধ্যমে কাজ করিয়ে নেন তাঁরা।
আর বিআরটিএ কর্মকর্তারা বলছেন, সেবার মান বাড়লেও সময় বাঁচাতে গিয়ে এবং অলসতার কারণে বাড়তি টাকা বাইরে দিচ্ছেন গ্রাহকেরা।
চিরচেনা ভিড় নেই
বৃহস্পতিবার সকাল পৌনে নয়টা। নগরের নওদাপাড়া আমচত্বরের পাশেই বিআরটিএ অফিস। অফিসের গেট খুলে গেছে। সেবা নিতে আসা কেউই নেই। নয়টা বাজতেই কয়েকজন মোটরসাইকেল চালিয়ে এলেন। এসে তাঁরা অপেক্ষা করছিলেন। তাঁদের দুজন গোদাগাড়ী উপজেলার আলফাজ মিয়া ও মো. সবুজ। আলফাজ মিয়া বলেন, বছর দুই আগে তিনি ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য পরীক্ষা দিয়েছিলেন। প্রায় দেড় বছর পর স্মার্ট কার্ড পেয়েছিলেন তিনি। তখনকার অভিজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বললেন, তখন সকাল সাতটার দিকে পরীক্ষা দিতে এসেছিলেন। অনেক ভিড় ছিল। পরে আরও কয়েকবার তাঁকে আসতে হয়েছে। এখন তিনি তাঁর চাচাতো ভাই সবুজের স্মার্ট কার্ড নেওয়ার জন্য এসেছেন। সবুজের ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে শুধু একবার পরীক্ষা ও ফিঙ্গার দিতে আসতে হয়েছিল। সবুজ বলেন, আড়াই–তিন মাসেই তাঁর স্মার্ট কার্ড হয়ে গেছে। তুলে নেওয়ার জন্য এসেছেন।
বিআরটিএ সূত্রে জানা গেল, ২০২৩ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে ড্রাইভিং লাইসেন্সসহ অন্যান্য কার্যক্রম অনলাইনে পুরোপুরি করা যায়। আগে একটি ড্রাইভিং লাইসেন্স করতে হলে সেবাগ্রহীতাকে অন্তত চার থেকে পাঁচবার বিআরটিএতে আসতে হতো। এখন একবার এলেই হয়ে যাচ্ছে। স্মার্ট কার্ড হয়ে গেলে বাসায় পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। প্রতিটি ধাপ সম্পূর্ণ হয়ে গেলে গ্রাহক মুঠোফোনে খুদে বার্তাও পাচ্ছেন।
তবে স্মার্ট কার্ড নিতে আসা সবুজ জানালেন, তাঁর ড্রাইভিং লাইসেন্সের কাজ করতে নির্ধারিত ফির চেয়ে দুই হাজার টাকা বেশি লেগেছে। তিনি দালালের মাধ্যমে কাজটি করিয়ে নিয়েছেন।

দালাল–শোরুমেই স্বাচ্ছন্দ্য
রাজশাহীর একটি মোটরসাইকেল ব্র্যান্ডের শোরুম থেকে আবদুর রহিম নামে এক ব্যক্তি মোটরসাইকেল কিনেছেন। ৬ এপ্রিল গাড়ি কিনে তিনি এসেছেন গাড়ি দেখাতে। সকাল সাড়ে নয়টার দিকে তিনি কাউকে ফোন করে জানতে চাইলেন কোন পাশে যেতে হবে। পরে তিনি রাজশাহী কার্যালয়ের পূর্ব পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। এক ব্যক্তি অনেকগুলো কাগজ গুছিয়ে তাঁর কাছে দিয়ে গেলেন। বললেন, একটু পরই মোটরযান পরিদর্শক আসবেন। পরে মোটরযান পরিদর্শক এসে গাড়ি দেখে কাগজপত্রে সই করলেন।
আবদুর রহিম গাড়ি কিনেছেন ২ লাখ ৯৩ হাজার টাকায়। তাঁর কাছ থেকে গাড়ির নিবন্ধন বাবদ নেওয়া হয়েছে ২৫ হাজার টাকা। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, তাঁর গাড়ির নিবন্ধন করতে সরকারি খরচ হতো সাড়ে ২০ হাজার টাকা। তাঁর কাছ থেকে অতিরিক্ত প্রায় ৫ হাজার টাকা নেওয়া হলো। রহিম বলেন, গাড়ির নিবন্ধন করতে নাকি অনেক ঝক্কিঝামেলা আছে। এ কারণে ওদের (দালাল) দিয়েই করিয়ে নেওয়া হলো। এতে সময়টা বেঁচে গেল।
এ রকম আরও কয়েকজনের সঙ্গে কথা হলো। মোটরসাইকেল ও শোরুম ভেদে তাদের কাছ থেকে ২ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয়েছে।
পবা উপজেলার বায়া এলাকার বাসিন্দা সাদিকুল ইসলাম মোটরসাইকেল নিয়ে বিআরটির প্রধান কার্যালয়ের পশ্চিম পাশে আমবাগানে বসে ছিলেন। কথা বলে জানা গেল, তিনি তাঁর খালাতো ভাইয়ের মোটরসাইকেল নিবন্ধন করতে এসেছেন। ১০০ সিসি মোটরসাইকেলে ২ বছরের নিবন্ধনে তাঁর খরচ পড়ল সাড়ে ১৩ হাজার টাকা। তিনি বলেন, ‘এই যে দেখেন, আমি এখানে মোটরসাইকেল নিয়ে বসে আছি। শুধু টাকাটা দিলাম। এখানে কিছু সময় বসে থাকার পরই কাজ হয়ে যাবে। আমার হয়তো ৩ হাজার টাকা বেশি লেগেছে। কিন্তু আমাকে এক দিনই আসতে হলো। এটা নিজে করলে হয়তো এক দিনে পারা যেত না।’
সাদিকুল যাঁকে দিয়ে মোটরসাইকেল নিবন্ধন করালেন, তাঁর সঙ্গে কথা বলিয়ে দিলেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, আগে তাঁরা স্থানীয়রা দিনে চার থেকে পাঁচটি মোটরসাইকেল নিবন্ধন, ড্রাইভিং লাইসেন্সের কাজ পেতেন। এখন শোরুমের ব্যক্তিরা এসব কাজ করে দিচ্ছেন। এতে তাঁদের কাজ কমে গেছে। তাঁর অভিযোগ, এ ক্ষেত্রে শোরুমের লোকজনের সঙ্গে বিআরটিএর যোগাযোগ আছে।
তবে এর মধ্যে একজনকে পাওয়া গেল, যিনি নিজেই মোটরসাইকেল নিবন্ধনের কাজ করছেন। নগরের কাজীহাটা এলাকার বাসিন্দা নয়ন আলী বললেন, কোথায় যেতে হবে, কী করতে হবে, এটা না জেনে এলে একটু সমস্যায় পড়তে হয়। যেহেতু আগে এই কাজ করেছেন, তাই অভিজ্ঞতা আছে। তিনি মনে করেন, নিজে নিজে কাজ করলে খরচ অনেক কমে যায়।

রাজশাহী বিআরটিএর সহকারী পরিচালক আবদুর রশিদ বলেন, ‘আগে মাসের পর মাস থেকে, বছরের পর বছর পর্যন্ত ড্রাইভিং লাইসেন্সের স্মার্ট কার্ডের জন্য গ্রাহককে অপেক্ষা করতে হতো। এখন খুব অল্প সময়ে কাজ হয়ে যায়। স্মার্ট কার্ড বাসা পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া হয়।’ তিনি জানান, ড্রাইভিং লাইসেন্স পরীক্ষা আগে বছরে কয়েকবার হতো। এখন প্রতি সপ্তাহে নেওয়া হয়। আর সব কাজ অনলাইনের মাধ্যমে হয়। সেবাগ্রহীতাকে শুধু একবারের জন্য পরীক্ষা ও ফিঙ্গারের জন্য আসতে হয়। তাঁরা চেষ্টা করছেন, যাতে ‘হিউম্যান কন্ট্রাক্ট’ কমানো যায়। এতে করে স্বচ্ছতা বাড়বে।
দালাল ধরে কাজ করার ব্যাপারে এই কর্মকর্তা বলেন, এখন অনেকেই নিজে নিজে কাজ করছেন। কিন্তু মানুষ এ ক্ষেত্রে সময় দিতে চান না। আবার অনেকে মনে করেন, বিআরটিএ বোধ হয় আগের মতোই আছে। আসলে যে বিআরটিএ পাল্টে গেছে, তাঁরা তা জানেন না। এ কারণে বাইরের লোক ধরে অযথা টাকা খরচ করেন। নিজের কাজ নিজে করতে পারলে দালালেরা কোনো সুবিধা করতে পারবে না।