Image description
৭৮ কোটি টাকার প্রকল্প বেড়ে ৬০৪ কোটি

ঢাকা শিশু পার্ক। রাজধানীর শিশু-কিশোরদের জন্য একমাত্র সরকারি বিনোদন কেন্দ্র। উন্নয়নের নামে ১৮ সাল থেকে দফায় দফায় প্রকল্প ব্যয় বাড়ালেও এখনো শেষ হয়নি পার্কের সংস্কার কাজ। অভিযোগ উঠেছে নির্মাণাধীন এই পার্কের প্রকল্প ব্যয় বাড়িয়ে কোটি কোটি টাকা লোপাট করেছে একটি পক্ষ। সরজমিন গিয়ে দেখা যায়, শাহবাগ মোড়ের অদূরে ঢাকা শিশু পার্কের চারপাশ সবুজ রঙের টিন দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। ভেতরে ঠিক কী কর্মযজ্ঞ চলছে বাইরে থেকে কেউ বলতে পারে না। এক সময় এই পার্কের ভেতরে একটি খেলনা ট্রেন, একটি গোলাকার মেরি গো রাউন্ড রাইড ও একাধিক হুইলসহ ১২টি রাইড ছিল। ১৯৯২ সালে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর পক্ষ থেকে সৌজন্য উপহার হিসেবে একটি জেট প্লেনও দেয়া হয়েছিল শিশুদের একমাত্র এই বিনোদন কেন্দ্রে। মাত্র ১০ টাকার টিকিটে ৬টি রাইড ব্যবহার করতে পারতো শিশুরা। তাই পার্কটিতে ছিল উপচেপড়া ভিড়। পার্কটিতে প্রবেশ করে দেখা যায়, শিশু পার্কের ভেতরে যে রাইডগুলো ছিল এখন তার অধিকাংশেরই অস্তিত্ব নেই। দু’টি রাইড টিন দিয়ে ঘেরা। টিনের মধ্যে রাইডের পাশ দিয়ে বিভিন্ন গাছ জন্মেছে। সামনের গ্রিলগুলোয় মরিচা পরে নষ্ট হয়ে গেছে। পার্কের পশ্চিম পাশে ঝোপঝাড়ে ফেলে রাখা হয়েছে বিমান বাহিনীর উপহার দেয়া সেই জেট প্লেন। আর নির্মাণাধীন শিশু পার্কটির পুরো মাঠের মাটি উপড়ে ফেলা হয়েছে। শিশু পার্কের মাঝামাঝি ভূগর্ভস্থ গাড়ি পার্কিং এর কাজ চলছে। তার মধ্যেও পানি জমে রয়েছে। এ ছাড়াও পানির কৃত্রিম লেক বানানো হয়েছে। যদিও তাতে কোনো পানি দেখা যায়নি। আছে হাঁটার জায়গাও। কিন্তু এখনো মূল পার্কটির কোনো কাজই শুরু হয়নি। পার্কের পাবলিক টয়লেটের ভবনটি ছাড়া আর একটিও ভবন আস্ত নেই। এই সবের দেখাশোনার কাজ করছেন হাতেগোনা কয়েকজন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নিরাপত্তাকর্মী বলেন, আপাতত কাজ বন্ধ রয়েছে। পার্কিং-এর কাজ প্রায় শেষ। এখানে প্রায় ৩ হাজার গাড়ি পার্ক করা যাবে। এই পার্কিং ঢাকা ক্লাব, শিশু পার্ক ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আগতরা ব্যবহার করবে। যার জন্য উভয়পাশে দুটি করে মোট ৪টি প্রবেশ গেট রাখা হয়েছে। তবে বছর দু’য়েকের আগে আর এই পার্ক খোলা সম্ভব নয় বলেও জানান তিনি।  আর এই সুযোগে ঈদের আগে থেকে শিশু পার্কের পূবালী ব্যাংকের সামনের খালি জায়গায় বিভিন্ন রাইডের পসরা সাজিয়ে নিয়ে বসেছেন মো. আব্দুল কাদির নামে এক ব্যক্তি। তার দাবি- পড়ে থাকা খালি জায়গায় শিশুদের আনন্দ দিতেই এই সেবা দিচ্ছেন। 

সূত্র বলছে, ২০১৮ সালে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে একটি চিঠি আসে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে। চিঠিতে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে প্রস্তাব দেয়া হয়, শাহবাগে যে শিশু পার্ক রয়েছে, সেটির সংস্কার ও আধুনিকায়নের জন্য ‘স্বাধীনতা স্তম্ভ নির্মাণ’ (তৃতীয় পর্যায়) প্রকল্পের আওতায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনকে ৭৮ কোটি টাকা দেবে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। কারণ স্বাধীনতা স্তম্ভ নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় শিশু পার্কের নিচ দিয়ে ভূগর্ভস্থ পার্কিং তৈরি করা হবে। যাতে পার্কের কিছু রাইড ক্ষতিগ্রস্ত হবে। নতুন রাইড কেনার পাশাপাশি পার্কের আধুনিকায়নের জন্য মূলত ওই টাকা দিতে চেয়েছিল মন্ত্রণালয়। যেই কাজ ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে শুরু হয়ে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা ছিল। ভূগর্ভস্থ পার্কিং তৈরির জন্য সেই সময়ই পার্কটি বন্ধ করে দেয়া হয়। পার্কের অনেক রাইড খুলে ফেলাসহ বিভিন্ন স্থাপনা ভেঙে ফেলা হয়। কিন্তু কাজ শুরু হওয়ার পরও এত অল্প টাকায় আধুনিকায়নের কাজটি করা যাবে না উল্লেখ করে প্রস্তাবটি ফেরত পাঠায় ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন। মন্ত্রণালয়ের প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব নেয় গণপূর্ত অধিদপ্তর। ৭৮ কোটি টাকার এই প্রকল্পটি বেড়ে দাঁড়ায় ২৬৫ কোটি টাকাতে। পরে প্রকল্পটি সংশোধন করে ৩৯৭ কোটি টাকা করা হয়। সঙ্গে মেয়াদও বাড়ানো হয়। ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাস থেকে টিনের দেয়াল দিয়ে শিশু পার্কটি পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়া হয়। এর মধ্যেই ২০২০ সালের মে মাসে শেখ ফজলে নূর তাপস ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়রের দায়িত্ব নেন। কিছুদিন পর তিনি ঠিক করেন, শিশু পার্কের আধুনিকায়নের কাজটি সিটি করপোরেশন নিজেরাই করবে। পরে তার উদ্যোগে শিশু পার্ক নিয়ে ৬০৩ কোটি ৮১ লাখ টাকার একটি প্রকল্প তৈরি করা হয়। ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে প্রকল্পটি ২০২৩ সালের আগস্ট মাসে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদন করিয়ে নেন তৎকালীন মেয়র তাপস। প্রকল্প পাসের সময় ঠিক হয়, ৬০৩ কোটি ৮১ লাখ টাকার মধ্যে ৪৮৩ কোটি টাকা দেবে সরকার। সরকারের দেয়া টাকার অর্ধেক হবে অনুদান, বাকিটা ঋণ হিসেবে নেয়া হবে। আর দক্ষিণ সিটির নিজস্ব তহবিল থেকে খরচ করা হবে ১২০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৪৪১ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয় শিশু পার্কের ১৫টি রাইড কেনা ও স্থাপনের জন্য। এর মধ্যে ৩০ জন চড়তে পারে এমন একটি রাইড ‘মাইন ট্রেন’ কেনা ও স্থাপন করার জন্য ৯৭ কোটি টাকা খরচ করার কথা প্রকল্পে উল্লেখ করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্তৃপক্ষ। ‘ডিসকো মেগার’ দাম ধরা হয়েছে ২৭ কোটি ৪২ লাখ টাকা। ‘সুপার এয়ার রেসের’ দাম ধরা হয়েছে ৪৯ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। ১২ডি থিয়েটার স্থাপন করতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৮১ কোটি টাকা। এ ছাড়াও এই প্রকল্পের আয়তায় একটি জিপ গাড়ি ও একটি পিকআপ কেনার জন্য ১ কোটি ৬০ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়। প্রকল্পের আওতায় অন্যান্য কাজের পাশাপাশি শিশু পার্কের ভেতর দিয়ে ভূগর্ভস্থ পার্কিং নির্মাণের বিষয়টিও উল্লেখ রয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, সুকৌশলে নিজের খাতিরের ৫ ঠিকাদারকে এই পার্কের নির্মাণ কাজের দায়িত্ব পাইয়ে দেন খোদ দক্ষিণ সিটির মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস।  

দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের এক প্রকৌশলী বলছেন, ১৫ একর জমির ওপর ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের অধীনে এই শিশু পার্কটি স্থাপন করা হয়। ১৯৮৩ সালে তৎকালীন ঢাকা মিউনিসিপ্যাল করপোরেশনের কাছে এই পার্ক হস্তান্তর করা হয়। তখন এটি ‘ঢাকা শিশু পার্ক’ নামে পরিচিত ছিল। পরে সাদেক হোসেন খোকা অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র হয়ে এই পার্কের নামকরণ করেন ‘শহীদ জিয়া শিশু পার্ক’। শেখ ফজলে নূর তাপস ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র হওয়ার পর ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে ‘হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী শিশু পার্ক’ নামে পার্কটির নতুন নামকরণ করে। তিনি বলেন, পার্কের বর্তমান যেই অবস্থা, ভূগর্ভস্থ পার্কিংয়ের কাজ পুরোপুরি শেষ না হলে শিশু পার্কের কাজ পুরোদমে শুরু করা সম্ভব হবে না। কারণ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতা স্তম্ভ নির্মাণ প্রকল্পে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কাজ শেষে শিশু পার্কের জায়গা দক্ষিণ সিটিকে বুঝিয়ে দেয়ার পরই কাজ শুরু করবে সিটি করপোরেশন। তাই শিশু পার্কটি ঠিক কবে খুলবে, তা এখনো বলা যাচ্ছে না।

এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. জিল্লুর রহমান বলেন, আমি গত ফেব্রুয়ারি মাসে জয়েন করেছি। তারপরও আমি এই বিষয় বেশ কিছু খোঁজ নিয়েছি। নিজে জেনেছি, আমাদের পার্কের কাজে একটু সমস্যা হয়েছে। পার্কের রাউডগুলো স্পেসিফিকেশন নিয়ে বুয়েটের ইঞ্জিনিয়াররা নারাজি দিয়েছেন। তারা বলেছেন আগে যেই স্পেসিফিকেশন ও নিরাপত্তার কথা বলা হয়েছিল তা সঠিক নয়। তাই আমরা আবারো এর স্পেসিফিকেশনের জন্য একটি তৃতীয়পক্ষের সঙ্গে আলাপ করছি। আশা করছি দ্রুতই সমাধানে আমরা আসতে পারবো। তিনি বলেন, আমরা শুধু পার্কের কাজ করছি। আর মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রাণলায়ের ভূগর্ভস্থ পার্কিং-এর কাজ করছে গণপূর্ত। তাদের কাজ প্রায় শেষের দিকে। এরপর সব মিলিয়ে আমাদের পার্কের কাজ সম্পন্ন হতে এখনো ২ বছর লাগতে পারে।