
প্রায় দুই বছর আগে রাজধানীর বাড্ডায় মা মাহামুদা হক ওরফে বৃষ্টি (৩৩) ও মেয়ে সানজা মারওয়া (১০) হত্যার ঘটনাটি ছিল বেশ আলোচিত। মা-মেয়ে হত্যা মামলার আসামি মাহামুদার স্বামী এস এম সেলিম (৩৬) চলতি বছরের জানুয়ারিতে হাইকোর্ট থেকে জামিন পান। জামিনে মুক্ত হয়ে তিনি বিয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। বিয়ের জন্য কনে দেখাও হয়ে গেছে।
পুলিশের অভিযোগপত্র অনুযায়ী, পারিবারিক কলহ থেকে ২০২৩ সালের ১৩ জুন রাত সাড়ে ১০টা থেকে ১৪ জুন দিবাগত রাত আড়াইটার মধ্যে পরিকল্পিতভাবে মা-মেয়ে হত্যার ঘটনাটি ঘটে। হত্যার জন্য সেলিম গরুর দুধের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে ছিলেন। এই দুধ পানে তাঁর স্ত্রীর পাশাপাশি সন্তানের মৃত্যু হয়।
জামিনে মুক্ত হয়ে বিয়ের প্রস্তুতি নেওয়ার কথা নিজেই প্রথম আলোর কাছে স্বীকার করেছেন সেলিম। তবে এলাকার ভাষ্য, সেলিম ইতিমধ্যে বিয়ে করে ফেলেছেন। তিনি নববধূকে নিয়ে নিজের পৈতৃক ফ্ল্যাট ছেড়ে অন্য জায়গায় বাসা ভাড়া নিয়েছেন।
সেলিমের জামিনে মুক্ত হওয়ার ঘটনায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন মাহামুদার পরিবারের সদস্যরা। মাহামুদার মা জুঁই বেগম প্রথম আলোকে বলেন, এভাবে খুনের আসামি যদি জামিন পেয়ে যান, বিচার না হয়, তাহলে ঘরে ঘরে খুন হবে।
সেলিমের জামিন বাতিল করে তাঁর বিচার ও শাস্তির দাবি জানান জুঁই বেগম। তাঁর আশঙ্কা, সেলিম দেশের বাইরে পালিয়ে যেতে পারেন।
কী ঘটেছিল
মামলার এজাহার ও অভিযোগপত্র থেকে জানা যায়, ২০২৩ সালের ১৪ জুন দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে মাহামুদার দ্বিতীয় বোন মারিয়া হককে মুঠোফোনে কল করেন সেলিম। তিনি বলেন, স্ত্রী মাহামুদা ও মেয়ে সানজা কোনো সাড়া দিচ্ছেন না। দুজনের শরীর শীতল হয়ে গেছে।
মাহামুদার এই বোন ময়মনসিংহে নিজের শ্বশুরবাড়িতে থাকায় তিনি ফোন করে বিষয়টি ঢাকায় তাঁর মামা ও ফুফুদের জানান। তাঁরা রাজধানীর মেরুল বাড্ডায় অর্কিড জামশেদ টাওয়ারে সেলিম-মাহামুদার ফ্ল্যাটে যান। দেখেন, মাহামুদা তাঁর শয়নকক্ষের বিছানায় নিথর অবস্থায় পড়ে আছেন। পাশের কক্ষের বিছানায় নিথর অবস্থায় পড়ে আছে সানজা।
সে সময় সেলিম জাতীয় জরুরি সেবা নম্বরে (৯৯৯) কল করে বাসায় অ্যাম্বুলেন্স আনেন। তিনি ও মাহামুদার পরিবারের সদস্যরা মা-মেয়েকে (মাহামুদা ও সানজা) নিয়ে রামপুরার ফরাজী হাসপাতালে যান। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দুজনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিতে বলেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নেওয়া হলে মাহামুদা ও সানজাকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক। পরে পুলিশ এসে হাসপাতাল থেকে সেলিমকে আটক করে।
মা-মেয়ে হত্যার ঘটনায় মাহামুদার বাবা মো. মোজাম্মেল হক বাদী হয়ে সেলিমকে আসামি করে রাজধানীর বাড্ডা থানায় মামলা করেন। মাহামুদার বাবা পানি উন্নয়ন বোর্ডের গাড়িচালক ছিলেন। তাঁর চার মেয়ের মধ্যে মাহামুদা ছিলেন বড়। মোজাম্মেল এজাহারে অভিযোগ করেন, ১৪ বছরের বিবাহিত জীবনের মধ্যে ৩ বছর ধরে (হত্যার আগের) পারিবারিক কলহ চলছিল মাহামুদা-সেলিমের। এর জেরে মাহামুদাকে নির্যাতন করতেন সেলিম।
এই মামলায় গ্রেপ্তারের পর সেলিম স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। পুলিশ সূত্র ও অভিযোগপত্রের তথ্য অনুযায়ী, জবানবন্দিতে তিনি স্ত্রী-মেয়েকে হত্যার কথা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, স্ত্রী তাঁকে মানসিকভাবে নির্যাতন করতেন। সেই ক্ষোভ থেকে তিনি স্ত্রীকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে মাহমুদা গরুর দুধ পান করতেন। সেই সুযোগ তিনি নেন। ওষুধের দোকান থেকে তিনি (সেলিম) ঘুমের ট্যাবলেট কিনে এনে দুধের সঙ্গে মিশিয়ে দেন। তবে শুধু স্ত্রীকে হত্যার উদ্দেশ্য ছিল তাঁর। সন্তানও যে দুধ পান করবে, তা তিনি বুঝতে পারেননি।
মা-মেয়ে হত্যার ঘটনার এক সপ্তাহ পর ২০২৩ সালের ২১ জুন মাহামুদার মামা সোহেল শিকদারের বাড্ডার বাসায় গিয়েছিলেন এই প্রতিবেদক। সে সময় বাড়িটিতে মাহামুদার মা ও ছোট সন্তান সারিম ছিলেন। সারিম সারাক্ষণই কান্নাকাটি করছিল।
মাহামুদার মামা সোহেল শিকদার সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, সেলিমের বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক ছিল। এ নিয়ে সেলিম-মাহামুদার দাম্পত্য কলহ চলছিল। এর আগে করোনা মহামারির সময় ফরিদপুরে গিয়ে এক মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন সেলিম। অল্প সময়ের মধ্যে সেই বিয়ের বিচ্ছেদ হয়। মাহামুদাকে হত্যার আগেও এক নারীর সঙ্গে সেলিমের সম্পর্ক চলছিল। সেই মেয়েটিকেই সেলিম বিয়ে করে থাকতে পারেন।
হত্যার ঘটনার সময় মাহামুদা-সেলিম দম্পতির ছোট ছেলে সারিম মারওয়ানের বয়স ছিল ৯ মাস। ঘটনার পর থেকে ছেলেটি তার নানা-নানির সঙ্গে মুন্সিগঞ্জে থাকে। ছেলেটির বয়স এখন প্রায় আড়াই বছর। তার নানি জুঁই বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘মা (মাহামুদা) আর বোনের (সানজা) কথা জিজ্ঞেস করলে শিশু সারিম আকাশের দিকে আঙুল তুলে আধো স্বরে বলে, “আম্মু আকাশে, আপু আকাশে।”’
মাহামুদার মা জুঁই বেগম বলেন, হত্যার ঘটনার পর পুলিশ ও পারিবারিক হস্তক্ষেপে সারিমের জন্য মাসে ১০ হাজার টাকা করে সেলিমের পরিবার দেবে বলে বন্দোবস্ত হয়। সেই টাকা তাঁরা পাচ্ছেন বলে জানান মাহামুদার মা।
কনে দেখা শেষ
হাইকোর্ট থেকে পাওয়া জামিনের আদেশের অনুলিপির তথ্য অনুযায়ী, গত ২৮ জানুয়ারি ৬ মাসের জন্য অন্তর্বর্তী জামিন দেওয়া হয়েছে সেলিমকে।
স্ত্রী-সন্তানকে হত্যার অভিযোগের বিষয়ে গত ৫ এপ্রিল সেলিমের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তিনি এই হত্যা ও অন্য নারীর সঙ্গে সম্পর্কে জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেন।
স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির বিষয়ে জানতে চাইলে সেলিম বলেন, ষড়যন্ত্র করে তাঁর কাছ থেকে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদায় করা হয়েছিল।
তাহলে স্ত্রী-সন্তানকে কে হত্যা করেছে, এমন প্রশ্নে সেলিম বলেন, ‘আমি নিজেও বুঝতে পারছি না। এ নিয়ে আপনার সঙ্গে সামনাসামনি কথা বলব।’
সেলিম বলেন, তিনি তাঁর ছেলে সারিমের খোঁজখবর রাখছেন। তার জন্য প্রতি মাসে টাকা পাঠাচ্ছেন।
আবার বিয়ে করেছেন কি না, জানতে চাইলে তা অস্বীকার করেন সেলিম। তবে এলাকার লোকজন বলেন, সেলিম বিয়ে করে তাঁর মেরুল বাড্ডার পৈতৃক ফ্ল্যাট ছেড়ে আফতাবনগরে বাসা ভাড়া নিয়েছেন।
এ বিষয়ে জানতে ৬ এপ্রিল সেলিমের সঙ্গে আবার যোগাযোগ করলে তিনি আফতাবনগরে বাসা ভাড়া নেওয়ার কথা স্বীকার করেন। সেলিম বলেন, তিনি বিয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। অল্প কিছুদিনের মধ্যে বিয়ে করবেন।
কনে ঠিক হয়েছে কি না, জানতে চাইলে সেলিম বলেন, ‘কনে দেখা হয়েছে। আম্মুর পছন্দে বিয়ে করছি।’
মাহামুদার মা জুঁই বেগম বলেন, ‘সেলিমই আমার মেয়ে আর নাতনিকে হত্যা করেছে। আমার মেয়ে আমাকে বারবারই বলত, “অসুস্থ হওয়া ছাড়া কোনো দিন যদি আমি মারা গেছি শোনো, তাহলে বুঝবা, সেলিম আমাকে মেরে ফেলছে।” আমি এই হত্যার বিচার চাই। এমন হত্যার বিচার না হলে ঘরে ঘরে খুনের ঘটনা ঘটবে।’