
গত দেড় বছর ধরে চুয়াডাঙ্গা থেকে ঢাকায় এসে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএমইউ) চিকিৎসা নিচ্ছেন আসমা খাতুন নামে এক নারী। ব্রেস্ট ক্যান্সারের এই রোগীকে আগে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কাটার পর আরও অপেক্ষা করে ডাক্তার দেখাতে হতো। তবে এবার তিনি ডাক্তার দেখিয়েছেন মাত্র ৩০ মিনিটে। ‘ভিআইপি গতিতে’ এই রোগী ডাক্তার দেখাতে পারলেও একই সময়ে অসংখ্য রোগীকে দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে।
একই সময়ে দুই ধরনের সেবার পার্থক্য খুঁজতে গিয়ে দেখা গেছে, যারা ডাক্তার দেখাতে আগে অনলাইন অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে রেখেছিলেন, তারা অনেকটা স্বাচ্ছ্যন্দেই সেবা নিয়ে বাড়ি ফিরছেন। তবে যারা অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছাড়া আসছেন, তাদের টিকিট কাটা, রোগী দেখানো, পরীক্ষা-নিরীক্ষার টাকা জমা দেওয়া এবং রিপোর্ট দেখানোসহ যাবতীয় কাজ লম্বা লাইনে দাঁড়িয়েই সম্পন্ন করতে হচ্ছে।
আসমা খাতুনের মতো অনেক রোগীই বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অনলাইন অ্যাপয়েন্টমেন্ট সেবা থেকে উপকৃত হচ্ছেন, যা একদিকে তাদের সময় বাঁচাচ্ছে, অন্যদিকে ভোগান্তি কমাচ্ছে এবং চিকিৎসার অভিজ্ঞতাকে অনেক বেশি আরামদায়ক করে তুলছে।
লম্বা সিরিয়ালে দাঁড়িয়ে চিকিৎসা নেওয়া রোগী ও স্বজনরা জানালেন ‘অনলাইন অ্যাপয়েন্টমেন্ট’ সম্পর্কে তাদের ধারণা নেই। এ জন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে এই সেবা নিয়ে আরও প্রচার-প্রচারণার তাগিদ দিয়েছেন তারা।
প্রযুক্তির ছোঁয়ায় বদলে যাচ্ছে স্বাস্থ্যসেবার ‘মন্দ’ অভিজ্ঞতা
বিএমইউ-এর বহির্বিভাগে সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, অনলাইন অ্যাপয়েন্টমেন্টের কারণে রোগীদের এখন আর দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হচ্ছে না। পঞ্চগড় থেকে আসা ৬৫ বছর বয়সী আলিম উদ্দিন বলেন, ‘আগে ঢাকায় এসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতাম। এখন ছেলে মোবাইলেই অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে আমাকে সময় মতো ডাক্তার দেখায়। তিনি আরও বলেন, আমরা সকালে এসে সোজা ডাক্তার দেখিয়ে ওই দিনেই বাড়ি ফিরতে পারি। আগে তো ডাক্তার দেখিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতেই সারাদিন চলে যেতো। আমাদের অনেক ভোগান্তিও পোহাতে হতো।
পুরোনো পদ্ধতি ও অনলাইন অ্যাপয়েন্টমেন্টের পার্থক্য উঠে এলো আসমা খাতুনের কথাতেও। তিনি বললেন, আগে ডাক্তার দেখাতে আগের দিন ঢাকায় এসে ফজর নামাজের পর থেকে সিরিয়ালের জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। এখন আধুনিক সিস্টেম হওয়ায় ঠিক কয়টার সময় আসলে সরাসরি ডাক্তার দেখাতে পারবো, সেটাও জেনে নেওয়া যায়। এরফলে ডাক্তার দেখানো নিয়ে আর কোনো দুশ্চিন্তা নেই।
সেলিম মিয়া নামে একজন রোগীর স্বজন বলেন, অনলাইনে টিকিট কাটা খুবই সহজ। আমি নিজেই প্রথমে ভয় পাইছিলাম যে অনলাইন মানে বুঝব না। কিন্তু ওয়েবসাইটে ঢুকে খুব সহজেই নাম, বিভাগ আর তারিখ দিলেই অ্যাপয়েন্টমেন্ট হয়ে যায়। একটা কনফার্মেশন এসএমএসও আসে।
অনলাইন অ্যাপয়েন্টমেন্ট সেবার ফলে ডায়াগনস্টিক সেবাতেও উন্নতি এসেছে। এখন অনেক রিপোর্ট অনলাইনে বা নির্ধারিত সময়ে কাউন্টার থেকে সংগ্রহ করা যায়। আগে যেখানে রিপোর্ট নিতে গিয়ে রোগীদের ধাক্কাধাক্কি, সিরিয়াল জটিলতা এবং দালালের কবলে পড়ার অভিযোগ ছিল, সেখানে এখন রোগীরা নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট কাউন্টার থেকে রিপোর্ট সংগ্রহ করতে পারছেন।
রোগীর স্বজন সেলিম মিয়া বলেন, আমার মায়ের ইউএসজি রিপোর্ট দুদিনে পেয়েছি। আগে ৫-৬ দিন অপেক্ষা করতে হতো। এখন সময় মতো রিপোর্ট পেয়ে চিকিৎসাও দ্রুত হয়।
অনলাইন অ্যাপয়েন্টমেন্টে দ্রুত সেবায় অন্যদের ‘আফসোস’
বিএমইউতে চিকিৎসা নিতে আসা অনেক রোগী এখনও অনলাইন অ্যাপয়েনমেন্ট সিস্টেম সম্পর্কে ভালোভাবে জানেন না। ফলে তারা হাসপাতালে এসে নানা রকম ভোগান্তির মুখে পড়ছেন। সেইসঙ্গে অনলাইন অ্যাপয়েনমেন্ট সম্পর্কে পূর্বধারণা না থাকা নিয়ে আফসোসও করছেন তারা।
তারা মনে করেন, হাসপাতালের পক্ষ থেকে যদি আগে থেকেই রোগীদের অনলাইন সেবার বিষয়ে জানানো হতো, তাহলে অনেক ভোগান্তি এড়ানো যেত। বিশেষ করে দূর-দূরান্ত থেকে যারা আসেন, তাদের জন্য অনলাইনে সিরিয়াল নেওয়ার সুবিধা খুবই প্রয়োজনীয়।
পান্থপথ থেকে আসা শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমি আগে জানতাম না যে অনলাইনে অ্যাপয়েনমেন্ট নেওয়া যায়। সরাসরি চলে এসেছিলাম। এসে দেখি, যারা আগে থেকে অনলাইনে সিরিয়াল নিয়েছেন, তারা খুব দ্রুত ডাক্তার দেখাচ্ছেন। কাউকে তাড়াহুড়ো করতে হচ্ছে না। তখন বুঝলাম, এটা অনেক সুবিধার। ভবিষ্যতে আমি অবশ্যই অনলাইন সিরিয়াল নিয়েই আসবো।’
মুন্সিগঞ্জ থেকে আসা পপি আহমেদ বলেন, আমি হাসপাতালে এসে জানতে পারি যে অনলাইনে সিরিয়াল নেওয়ার সুযোগ আছে। কিন্তু এখন অ্যাপয়েনমেন্ট নিয়ে আর আজকে দেখানোর সুযোগ নেই। তাই লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কেটেছি। এরপর ডাক্তার দেখানো, টাকা জমা দেওয়া, রিপোর্ট নেওয়া—সব মিলিয়ে অনেক সময় লেগেছে।
তিনি আরও বলেন, নিজেরা লম্বা সিরিয়ালে দাঁড়িয়ে আছি আর দেখছি, যারা অনলাইনে সিরিয়াল নিয়েছেন, তারা অল্প সময়েই সব কাজ শেষ করে বের হয়ে যাচ্ছেন। ভবিষ্যতে আসার আগে অবশ্যই সিরিয়াল নিয়েই আসবো।
আরও প্রচারণার পরামর্শ
অনলাইন অ্যাপয়েন্টমেন্ট সম্পর্কে অনেকেই জানেন না, তাই হাসপাতাল প্রশাসনের পক্ষ থেকে আরও কার্যকর প্রচারণা চালানোর দাবি জানিয়েছেন অনেক রোগী। গণমাধ্যম, পোস্টার এবং ফেসবুকের মাধ্যমে সেবার বিষয়ে তথ্য প্রচারের প্রস্তাব দিয়েছেন তারা।
শফিকুল ইসলাম বলেন, গ্রামাঞ্চলের অনেক মানুষ এখনও অনলাইন সেবা সম্পর্কে জানেন না। এমনকি কিছু ক্ষেত্রে সেবাটি ব্যবহার করা তাদের জন্য কঠিন। তাই এ বিষয়টি নিয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের আরেকটু কাজ করতে হবে। প্রচার-প্রচারণা চালালো সাধারণ মানুষও এই সেবা সম্পর্কে জানতে পারবেন।
পপি আহমেদ বলেন, আমরা জানতাম না অনলাইনে টিকিট পাওয়া যায়, এখানে এসে শুনলাম। এতদূর থেকে এসে লাইনে দাঁড়িয়ে এখন কষ্ট হচ্ছে। অথচ এখন সবার হাতে হাতেই মোবাইল আছে, কীভাবে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে হয় একটু বুঝিয়ে দিলে মানুষ ভোগান্তি থেকে মুক্তি পেতো।
অনলাইন অ্যাপয়েন্টমেন্টের বাইরে প্রায় ৭০ শতাংশ রোগী
বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের আউটডোরে রোগীদের সেবায় কাজ করছেন বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির স্বেচ্ছাসেবকরা। তারা বলছেন, এখনও প্রায় ৭০ শতাংশ রোগীই অনলাইন অ্যাপয়েনমেন্ট সিস্টেমের বাইরে সেবা নিতে আসছেন। তাদের অনেকে এখনও অনলাইন অ্যাপয়েনমেন্ট পদ্ধতি সম্পর্কে জানেনই না। বিশেষ করে যারা ঢাকার বাইরে থেকে আসছেন, তারা সরাসরি হাসপাতালে এসে জানতে পারছেন অনলাইন সেবার বিষয়টি।
রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির স্বেচ্ছাসেবক মহসিন সাহেরী বলেন, অনলাইন সেবা সম্পর্কে অনেকেই জানেন না। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চল বা মফস্বল থেকে যারা আসছেন, তাদের ধারণা নেই যে ঘরে বসেই সিরিয়াল নেওয়া যায়। তবে একবার আসার পর অনেকে পরের বার থেকে অনলাইনে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে আসছেন। এ কারণে ধীরে ধীরে সেবাগ্রহীতার সংখ্যা বাড়ছে।
রেড ক্রিসেন্টের আরেক স্বেচ্ছাসেবক আজমাইন মাহতাব বলেন, এখনও বেশিরভাগ মানুষই অফলাইনে আসছেন। আমাদের হিসাবে প্রায় ৭০ শতাংশই সরাসরি এসে সিরিয়াল নিচ্ছেন। তবে যারা এখানে এসে অনলাইনের সুবিধা সম্পর্কে জানছেন, তারা আগ্রহ দেখাচ্ছেন।
অনলাইন অ্যাপয়েন্টমেন্টে রোগী ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা এসেছে
বিএমইউয়ের নিউরোসার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. রুহুল কুদ্দুস বিপ্লব জানান, অনলাইন অ্যাপয়েন্টমেন্ট চালুর মাধ্যমে রোগী ব্যবস্থাপনায় একটি সুস্পষ্ট শৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে। তার ভাষায়, আগে রোগীরা হঠাৎ করেই এসে ভিড় করতেন। কখন কতজন রোগী আসছেন, তা জানার কোনো উপায় ছিল না। অনেক সময় অতিরিক্ত রোগীর চাপে চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হতো। কিন্তু অনলাইন অ্যাপয়েন্টমেন্ট চালুর পর থেকে এখন আগেভাগেই জানা যাচ্ছে, কোন দিনে কতজন রোগী আসবেন।
তিনি আরও বলেন, এটা আমাদের জন্য বড় সুবিধা। যদি এই ব্যবস্থা আরও পরিপূর্ণভাবে চালু করা যায়, তাহলে আমরা রোগী অনুযায়ী প্রস্তুতি নিতে পারব—কতজন চিকিৎসক লাগবে, সহকারী প্রয়োজন কি না, কিংবা রোগীদের পরীক্ষার জন্য কী কী ব্যবস্থা রাখতে হবে। এতে একদিকে যেমন চিকিৎসকদের সময় বাঁচবে, অন্যদিকে রোগীরাও সঠিকভাবে ও দ্রুত সেবা পাবেন।’
ডা. রুহুল কুদ্দুস বিপ্লব আরও বলেন, ‘অনলাইনে সিরিয়াল থাকায় এখন আর রোগীদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে না। নির্ধারিত সময় জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে, ফলে রোগী হাসপাতালের বাইরে থেকেই প্রস্তুতি নিতে পারছেন। এতে দূর-দূরান্ত থেকে আসা রোগীদের সময় ও খরচ—দুই-ই সাশ্রয় হচ্ছে।’
অনলাইন অ্যাপয়েন্টমেন্ট ব্যবস্থায় চিকিৎসাসেবার মান বাড়ার পাশাপাশি রোগী ও চিকিৎসকের মধ্যে ভুল-বোঝাবুঝিও কমছে বলে মনে করেন ডা. আরিফুর রহমান। তিনি বলেন, ‘অনেক সময় রোগীরা মনে করেন, চিকিৎসক তাদের সময় দেন না। কিন্তু অনলাইন অ্যাপয়েন্টমেন্ট থাকলে নির্ধারিত রোগীর জন্য নির্দিষ্ট সময় রাখা যায়। ফলে রোগীরাও বুঝতে পারেন যে, তাদের গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে।
তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, এমন প্রযুক্তিনির্ভর সেবা শুধু রোগী নয়, হাসপাতালের সার্বিক ব্যবস্থাপনাকেও আরও আধুনিক ও কার্যকর করে তুলবে। আমাদের উচিত এই ব্যবস্থাকে পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা এবং সাধারণ রোগীদের মধ্যে এর প্রচার বাড়ানো।
স্বচ্ছতা, সময়নিষ্ঠতা ও গবেষণার নতুন দিগন্ত ‘অনলাইন অ্যাপয়েন্টমেন্ট’
বিএমইউয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শাহিনুল আলম বলেন, অনলাইন অ্যাপয়েন্টমেন্ট যদি আমরা বহির্বিভাগ (ওপিডি) এবং অন্তঃবিভাগ (ইনডোর) সেবা পুরোপুরি অটোমেটেড করতে পারি, তাহলে রোগীর সমস্ত তথ্য এক জায়গায় থাকবে। এতে চিকিৎসকরা সহজেই রোগীর চিকিৎসার ইতিহাস দেখতে পাবেন এবং আরো সঠিকভাবে সেবা দিতে পারবেন। এক রোগী যখন প্রথমবার হাসপাতালে আসবে, তখন থেকে তার চিকিৎসার প্রতিটি ধাপ—যেমন, কী পরীক্ষা হয়েছে, কী চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে, ওষুধ কী ছিল—সব কিছু সিস্টেমে রেকর্ড থাকবে।
শুধু সেবার মানই নয়, এই সিস্টেমে সংরক্ষিত তথ্য ভবিষ্যতের গবেষণাতেও সাহায্য করবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রতিদিন হাজার হাজার রোগী এখানে আসে। তাদের তথ্য যদি সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা যায়, তাহলে ভবিষ্যতে এই তথ্যগুলো ব্যবহার করে নতুন রোগ, চিকিৎসার পদ্ধতি এবং ওষুধের কার্যকারিতা নিয়ে গবেষণা করা যাবে। এটি চিকিৎসা বিজ্ঞানকে নতুন দিগন্তে নিয়ে যাবে।
‘অনলাইন অ্যাপয়েন্টমেন্টের আরেকটি সুবিধা হলো, এটি রোগী দেখার প্রক্রিয়ায় শৃঙ্খলা আনে। যারা অনলাইনে সিরিয়াল নিয়ে আসছেন, তাদের সময় নিয়ে সেবা দেওয়া হবে। এতে চিকিৎসকরা তাড়াহুড়ো করে রোগী দেখবেন না, বরং রোগীকে পুরোপুরি সময় দেবেন,’ বলেন শাহিনুল আলম।