Image description
৩ মে ঢাকায় মহাসমাবেশ

বেশকিছু ইস্যুতে আবারও মাঠে নামছে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক অন্যতম বৃহৎ সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। এরই অংশ হিসেবে আগামী ৩ মে ঢাকায় মহাসমাবেশ করবে সংগঠনটি। মূলত মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতের সমাবেশে নৃশংসতা ও আওয়ামী লীগ আমলে গুম-খুনের বিচারসহ চার দফা দাবিতে এ মহাসমাবেশের ডাক দেওয়া হয়েছে। গত ২৮ মার্চ বিকেলে ঢাকার জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা মাদ্রাসায় হেফাজতের কেন্দ্রীয় বিশেষ কমিটির জরুরি সভায় এই সিদ্ধান্ত হয়। এ ছাড়া সিদ্ধান্ত মোতাবেক বিভিন্ন ইসলামী দলের সঙ্গে বৈঠক করবে হেফাজতে ইসলাম। সে অনুযায়ী আগামী শনিবার কয়েকটি ইসলামী দলের সঙ্গে সংগঠনটির বৈঠক করার কথা রয়েছে।

এদিকে দেশের চলমান বিভিন্ন ইস্যুতে গত শনিবার রাতে বিএনপির সঙ্গে বৈঠক করেছে হেফাজতে ইসলাম। বৈঠকে উভয় সংগঠনের শীর্ষ নেতারা অংশ নেন। গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে দীর্ঘ আলোচনার পর বিএনপিকে লিখিত আট দফা প্রস্তাবনা দিয়েছে। এ ছাড়া আগামী জুনে সব জেলা ও মহানগর প্রতিনিধিদের নিয়ে জাতীয় সম্মেলন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সংগঠনটি। সবমিলিয়ে নিজেদের অবস্থান জানান দিতে আবারও মাঠে নামবে হেফাজতে ইসলাম। সংগঠনটির শীর্ষ নেতারা বলছেন, হেফাজতে ইসলাম আগামীতে কারও ক্ষমতায় যাওয়ার হাতিয়ার হবে না। কোনো নির্বাচনী জোটে না যাওয়ার ঘোষণাও দিয়েছে সংগঠনটি।

চার দাবিতে ৩ মে ঢাকায় মহাসমাবেশ: চারটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে আগামী ৩ মে ঢাকায় মহাসমাবেশ করবে হেফাজতে ইসলাম। ২০১৩ সালের ৫ মে রাজধানীর মতিঝিলে শাপলা চত্বরে হেফাজতের সমাবেশে নির্বিচারে হত্যাসহ আওয়ামী লীগ আমলে গুম-খুনের বিচার, সংগঠনের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে করা সব মামলা প্রত্যাহার, গণহত্যার দায়ে আওয়ামী লীগের বিচার এবং সংবিধানে আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস ফের সংযুক্ত করা। হেফাজতের মহাসচিব সাজিদুর রহমান কালবেলাকে বলেন, তারা সংগঠনের কেন্দ্রীয় বিশেষ কমিটির জরুরি সভায় বিভিন্ন বিষয়ে প্রস্তাবনা গ্রহণ করেছেন। ধীরে ধীরে সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সাংগঠনিক কার্যক্রমও জোরদার করবেন। তিনি বলেন, হেফাজতে ইসলাম দেশ ও ইসলামের জন্য কাজ করছে এবং আগামীতেও করবে। ইসলামের মৌলিক বিধিবিধানের বিরুদ্ধে কোনো চাপিয়ে দেওয়া মতবাদকে কখনোই প্রশ্রয় দেওয়া হবে না।

হেফাজতের বিশেষ কমিটির ওই সভায় গৃহীত এক প্রস্তাবে বলা হয়, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ও তার দল অবৈধ ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে দেশে ১৬টি বছর মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে। দেশে গুম, খুন, সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা হয়েছিল। ২০০৯ সালের সন্ত্রাস দমন আইনে প্রশাসনিক আদেশের মাধ্যমে এবং ১৯৭৮ সালের ‘দ্য পলিটিক্যাল পার্টিস অর্ডিন্যান্স’ অনুযায়ী সরকার চাইলে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে পারবে। এই দাবি আদায়ে দেশের স্বার্থেই সব মত-পথ ও ঘরানার মানুষকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। প্রস্তাবে আরও বলা হয়, ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। এ জন্য ইসলাম, দেশ ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় ওলামায়ে কেরামের ঐক্যের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। সভায় আরেক প্রস্তাবে সমাজের গরিব, অসহায় দরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানানো হয়।

বিএনপি-হেফাজতের রুদ্ধদ্বার বৈঠক:

গত শনিবার রাতে গুলশানে দলের চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে বিএনপির শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন হেফাজতে ইসলামের শীর্ষ নেতারা। সেদিন রাত ৮টার দিকে শুরু হওয়া বৈঠকটি প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে চলে। বৈঠকটি হেফাজতে ইসলামের আগ্রহেই অনুষ্ঠিত হয় বলে জানা গেছে। বৈঠক সূত্র জানায়, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে হেফাজতে ইসলামের সমর্থন চায় বিএনপি। বৈঠকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর হেফাজত নেতাদের উদ্দেশে বলেন, হেফাজতে ইসলাম অনেক বড় সংগঠন। বড় একটি সমর্থকগোষ্ঠী আছে। নির্বাচনে অবশ্যই আপনাদের সমর্থন চাইব। সবার সমর্থন পেলে আমাদের কাজগুলো সহজ হবে। এ সময় হেফাজতের নেতারা ইতিবাচক সাড়া দিলেও তারা বলেছেন, হেফাজতে ইসলাম কারও ক্ষমতায় যাওয়ার হাতিয়ার হবে না।

বৈঠক থেকে বেরিয়ে হেফাজতের এক শীর্ষ নেতা কালবেলাকে বলেন, ভবিষ্যতে দেশ পরিচালনার সুযোগ সৃষ্টি করতে বিএনপি মহাসচিব হেফাজতের সমর্থন চেয়েছেন। দ্রুত নির্বাচন আয়োজনে আমাদের ভূমিকা জারি রাখার কথা বলেছেন। তিনি বলেন, বিএনপি বড় দল। তাদের কাছে ইসলামী সংগঠন হিসেবে আমাদের বেশকিছু দাবিদাওয়া উত্থাপন করেছি। তারা প্রায় সবগুলোতেই সায় দিয়েছেন। হেফাজতের ওই নেতা জানান, বৈঠকে আমরা সবাই কথা বলেছি। বিএনপি কেন আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবি জানাচ্ছে না, সে বিষয়ে বিএনপি মহাসচিবের কাছে আমরা প্রশ্ন রাখি। জবাবে মহাসচিব বলেন, প্রত্যেক দলের কিছু নিজস্ব পলিসি আছে; সীমাবদ্ধতা রয়েছে। গণতান্ত্রিক দল হিসেবে আমরা অন্য কোনো দলের নিষিদ্ধ চাইতে পারি না। জনগণ যদি সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে আমরাও এতে একমত থাকব। বিএনপি মহাসচিবের এমন বক্তব্যের সময় হেফাজতের এক নেতা শেখ হাসিনা কর্তৃক বিএনপিকে নিষিদ্ধ করার উদ্যোগের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, আপনারা অন্তত শেখ হাসিনার সুরে তার আগের কথাটা তাকে ফিরিয়ে দিতে পারেন। আমরা কোনোভাবে আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে চাই না।

হেফাজতের নায়েবে আমির মাওলানা মুহিউদ্দিন রব্বানী কালবেলাকে বলেন, মতিঝিলের শাপলা চত্বরে মহাসমাবেশে হত্যাযজ্ঞ, আওয়ামী লীগ আমলে গুম-খুনের বিচার, সব মামলা প্রত্যাহার, গণহত্যার দায়ে আওয়ামী লীগের বিচার এবং সংবিধানে আল্লাহর ওপর আস্থা ও পূর্ণ বিশ্বাস ফের সংযুক্ত করার দাবিতে আগামী ৩ মে ঢাকায় মহাসমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। এরপর বিভিন্ন ইসলামী দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গেও মতবিনিময় হবে ইনশাআল্লাহ।

বিএনপির কাছে হেফাজতের ৮ প্রস্তাব:

গত ২৮ মার্চ অনুষ্ঠিত হেফাজতের খাস কমিটির বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী হেফাজত নেতৃবৃন্দ দেশের বর্তমান পরিস্থিতি ও বেশকিছু জরুরি ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকে বসবেন। সেই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বিএনপির সঙ্গে বৈঠক করেছেন হেফাজত নেতারা। এ সময় বিএনপির কাছে ৮ দফা প্রস্তাবনা তুলে দেয় হেফাজতে ইসলাম। প্রস্তাবনাগুলো হচ্ছে—১. সংবিধানে ‘আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ বহাল রাখা এবং ‘বহুত্ববাদ’ শব্দ না ঢোকানো। ২. শাপলা চত্বরে ও জুলাই-আগস্টের গণহত্যার দায়ে আওয়ামী লীগের বিচারকাজ দ্রুত শুরু করতে হবে। প্রয়োজনীয় সংস্কারসহ সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনে আপত্তি নেই। গণহত্যাকারী ফ্যাসিস্টদের বিচার দ্রুত করতে ট্রাইব্যুনালের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। ৩. ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরের গণহত্যা এবং ২০২১ সালে মোদিবিরোধী আন্দোলনে চালানো হত্যাকাণ্ডের জন্য আমরা (হেফাজত) মামলা দায়ের করেছি। শাপলার খুনিদের দৃষ্টান্তমূলক বিচারের দাবিতে বিএনপিকেও সরব হওয়ার আহ্বান। ৪. শাপলা চত্বরের ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় হেফাজতের আলেম-ওলামা ও কর্মী-সমর্থক ছাড়াও বিএনপির অর্ধশতাধিক নেতাকর্মীকেও আসামি করা হয়েছিল। বিএনপির ওই নেতাকর্মীদের মামলাসহ হেফাজত নেতৃবৃন্দের মামলাগুলোও দ্রুত প্রত্যাহার বা নিষ্পত্তি করার ব্যাপারে অন্তর্বর্তী সরকারকে চাপ দিতে বিএনপির সহায়তা প্রত্যাশা। ৫. ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ড এবং ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে বিএনপিকে শক্ত অবস্থান নেওয়া এবং আলেম-ওলামার বিরুদ্ধে যায়—এমন কথাবার্তা বলা থেকেও বিরত থাকতে বিএনপিকে অনুরোধ করা হয়। ৬. আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশকে জঙ্গি ও উগ্রবাদী রাষ্ট্র হিসেবে ভারত এবং আওয়ামী লীগের অপপ্রচারের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ ভাষায় কথা বলতে বিএনপিকে আহ্বান। ৭. বিএনপির কিছু কর্মকাণ্ডে দেশের মানুষ ও ওলামায়ে কেরাম যে অসন্তুষ্ট, তা বিএনপিকে জানানো হয়েছে। বরং জাতীয় ঐক্য গঠনে বিএনপি ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে, সেই আশা ব্যক্ত করা হয়েছে। ৮. গণহত্যার দায়ে ফ্যাসিস্ট দল আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় বসতে বিএনপিকে আহ্বান জানানো হয়েছে।

গতকাল হেফাজতের এক বিবৃতিতে বলা হয়, হেফাজত মনে করে কিছু মিডিয়ায় বিএনপির একতরফা বক্তব্য তুলে ধরায় জনমনে হেফাজতে ইসলাম সম্পর্কে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে, যা কাম্য নয়। এ ক্ষেত্রে কিছু মিডিয়া অপেশাদারিত্বের পরিচয় দিয়েছে। হেফাজতে ইসলাম সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক ধর্মীয় সংগঠন। কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জোটে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। এ ধরনের কোনো বক্তব্য হেফাজত থেকে দেওয়া হয়নি। হেফাজত কখনো কারও ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহৃত হয়নি এবং ভবিষ্যতেও হবে না। নির্বাচনী রাজনীতি থেকেও হেফাজত সবসময়ই মুক্ত থাকবে। হেফাজতের নাম বিক্রি করে কেউ রাজনৈতিক সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করলে তা সফল হবে না। ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়াবলিতে হেফাজত জনগণের পক্ষেই সবসময় মতামত দেয় এবং ফ্যাসিবাদ ও আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে হেফাজতের অবস্থান আগের মতোই অবিচল থাকবে ইনশাআল্লাহ।