
ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পতনের খবর পেয়ে ৫ আগস্ট দুপুর তিনটার দিকে উত্তরায় সহযোদ্ধাদের সঙ্গে উল্লাস করতে করতে রাজপথে নামে সামিউ আমান নূর। সেখানেই গুলিতে আহত হয়ে হাসপাতালে প্রাণ ত্যাগ করে সে।
নূরের মা শাহনূর আমান বলেছেন, ‘আমার আদরের নূরের কত স্বপ্ন ছিল বিজ্ঞানী হবে, দেশের বাইরে যাবে, বড় দেশের নাগরিক হবে। একটা গুলি আমার কলিজার টুকরার সব স্বপ্ন শেষ করে দিল।
তিনি বলেন, নূর তার বড় দুই বোনকে প্রায়ই বলত, আমার নামেই সবাই তোমাদেরকে চিনবে। তা আর হলো না। মা শাহনূর বলেন, আদরের ছেলেকে হারিয়ে কিভাবে মুখে খাবার তুলি, নূরবিহীন বাড়িটা খাঁ খাঁ করছে, এবারই প্রথম বিস্বাদ ঈদ কেটেছে আমাদের। এ কথা বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।
কিশোর নূর টঙ্গী সিরাজ উদ্দিন সরকার বিদ্যানিকেতনের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র ছিল। তার পরিবার টঙ্গীর পূর্ব আরিচপুর এলাকার কাজী নজরুল ইসলাম সড়কের নিজ বাড়িতে বসবাস করেন। তাদের গ্রামের বাড়ি চাঁদপুর জেলার কচুয়া উপজেলার বাঘমারায়। নূর সবার ছোট। আফরিন আমান ও আফসানা আমান নামের দুই বোনের আদরের ছোট ভাই সে। মাত্র ১৩ বছর বয়সি নূর ছিল নম্র, ভদ্র, মেধাবী, ইংরেজিতে পারদর্শী।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে রাজপথের লড়াইয়ে ১৮ জুলাই উত্তরা বিএনএস সেন্টারে আহত হয়েছিল সামিউ আমান নূর। সারাদেশে কারফিউ থাকা সত্ত্বেও সে রাজপথ ছাড়েনি। ১৯ জুলাই থেকে প্রতিনিয়তই সামনের সারিতে মিছিলে ছিল সে। ৫ আগস্ট জাতীয় পতাকা হাতে বিজয় মিছিল করছিল উত্তরা বিএনএস সেন্টার এলাকায়। উড়াল সড়ক থেকে নামার সময় পাশের একটি ভবন থেকে টার্গেট করে মাথায় গুলি করা হয় তাকে। ঘটনাস্থলেই লুটিয়ে পড়ে নূর। তাকে দ্রুত টঙ্গী শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখান থেকে স্থানান্তর করা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। তবে তাকে বহনকারী অ্যাম্বুলেন্স উত্তরা আজমপুর পার হতে না পেরে নেওয়া হয় উত্তরা আধুনিক হাসপাতালে। সেখানে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে শহীদ সামিউ আমান নূর।
নূরের বড় বোন আফরিন আমান কান্নাজড়িত কণ্ঠে আমার দেশকে বলেনÑ ‘আমাদের আদরের ছোট ভাইকে শেখ হাসিনার নির্দেশে হত্যা করা হয়েছে। আমরা এই হত্যার বিচার চাই, তাদের রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে। আদরের ভাইকে ছাড়া একটা বাজে ঈদ কাটালাম এবার।’
জুলাই বিপ্লবের আট মাস পেরিয়ে গেলেও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কোনো নেতা শহীদ সামিউ আমান নূরের পরিবারের সঙ্গে দেখা করেননি। কেন্দ্রীয় বা স্থানীয় পর্যায়ে কেউই তাদের খোঁজ-খবর নেয়নি কখনো। তবে গাজীপুর মহানগর জামায়াতে ইসলামীর আমির অধ্যাপক মুহাম্মদ জামাল উদ্দিন শহীদ সামিউ আমান নূরের বাসায় গিয়ে খোঁজ-খবর নেন এবং উপহার হিসেবে বাংলাদেশ জামায়াতের পক্ষ থেকে দুই লাখ টাকা প্রদান করেন।
শহীদ সামিউ আমান নূরের সহপাঠীরা জানায়, শহীদ নূর শুধু একটি নাম নয়, বরং জুলাই বিপ্লবের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তার রক্ত যেন বৃথা না যায়, তার স্বপ্ন যেন বেঁচে থাকে প্রতিটি বিপ্লবীর হৃদয়ে।
নূরের বাবা মো. আমান উল্লাহ বলেন-‘ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা পালিয়েছে, জীবিত আন্দোলনকারীরা যে যার মতো বাবা-মার কোলে ফিরে গেছে। কিন্তু আমার আদরের ধন নূর তো ফিরে এলো না। আমার ছেলেসহ সব শহীদের হত্যাকারীদের দ্রুত সময়ের মধ্যে বিচার নিশ্চিত করতে হবে। শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে ফাঁসি কার্যকর করতে হবে। এ দেশের মাটিতে আওয়ামী লীগের কোনো স্থান নেই, আওয়ামী লীগের নিবন্ধন বাতিল করতে হবে। তাহলেই শহীদদের আত্মা শান্তি পাবে।