Image description

যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প প্রশাসন দেশটির বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছে, যা আগে ছিল গড়ে ১৫ শতাংশ। নতুন এই সিদ্ধান্তের ফলে বাংলাদেশের জন্য নতুন অর্থনৈতিক চাপ তৈরি করতে পারে। এটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যনীতিতে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন হিসেবে দেখা হচ্ছে এবং বিশ্বজুড়ে অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পের উদ্যোক্তারা।

বাংলাদেশের জন্য যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে বড় একক পোশাক রফতানির বাজার। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশটিতে মোট পোশাকের ১৮ শতাংশই গেছে বাংলাদেশ থেকে। ফলে শুল্ক বৃদ্ধির কারণে রফতানির সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। যদিও শীর্ষ ১০ পোশাক রফতানিকারক দেশের মধ্যে শুধু মেক্সিকোর ওপর নতুন করে শুল্ক বসেনি, বাকিরা সবাই এ শুল্কের আওতায় পড়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি পোশাক শিল্পের জন্য এটি বড় ধরনের ধাক্কা হতে পারে, কারণ ঐতিহাসিকভাবে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশি পোশাকের অন্যতম প্রধান রফতানি গন্তব্য।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সানেমের (সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেছেন, ‘এমন একটি অনিশ্চিত বাণিজ্য পরিবেশ তৈরি হলে বাংলাদেশের জন্য কঠিন অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে’। 

তিনি আরও জানান, এই শুল্কের কারণে বিশ্ব বাণিজ্যে এক নতুন অস্থিরতা তৈরি হবে, যেখানে প্রতিযোগিতা আরও কঠিন হয়ে উঠবে। অর্থনীতিবিদদের অনেকেই মনে করছেন, এই পরিস্থিতির সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী হবে ভারত ও পাকিস্তান।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্রাটেজিক স্টাডিজের (বিস) গবেষণা পরিচালক ড. মাহফুজ কবীর বলেন, ‘আমাদের রফতানির প্রায় ১৯ শতাংশই যুক্তরাষ্ট্রে যায়। সেখানে ৩৭ শতাংশ শুল্কারোপ বড় ধরনের ধাক্কা হয়ে আসবে।’

একই মত দেন অর্থনীতিবিদ এম এম আকাশ। তার মতে, ‘যেহেতু আমাদের রফতানির ৭৬ শতাংশই পোশাক খাতের ওপর নির্ভরশীল, তাই যুক্তরাষ্ট্রে দাম বাড়লে অর্ডার কমে যাবে, যা বড় সংকট সৃষ্টি করবে।’

ড. মাহফুজ কবীর বলেন, ‘বাংলাদেশের অনেক ক্রয়াদেশ এখন ভারত ও পাকিস্তানের দিকে চলে যাবে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তারা বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যাবে।’ যদিও এসব দেশের ওপরও শুল্কারোপ করা হয়েছে (ভারতের ক্ষেত্রে ২৬ শতাংশ, পাকিস্তানের ক্ষেত্রে ২৯ শতাংশ), তবুও বাংলাদেশ তুলনামূলক বেশি চাপে পড়বে।এছাড়া, যুক্তরাষ্ট্রের কাছাকাছি দেশ হন্ডুরাস, মিসর ও তুরস্কও নতুন প্রতিযোগী হয়ে উঠছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

যুক্তরাষ্ট্র শুধু বাংলাদেশের ওপর নয়, চীন, ভিয়েতনাম, ভারত, ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশগুলোর রফতানির ওপরও শুল্ক বাড়িয়েছে। চীনের ওপর ৩৪ শতাংশ, ভিয়েতনামের ওপর ৪৬ শতাংশ, ভারতের ওপর ৩০ শতাংশ এবং ইন্দোনেশিয়ার ওপর ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। তবে ভারতের ওপর বাংলাদেশের তুলনায় ১০ শতাংশ কম শুল্ক নির্ধারণ করা হয়েছে, যা দেশটির জন্য প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা সৃষ্টি করতে পারে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশকে দ্রুত কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে শুল্ক হ্রাসের চেষ্টা করতে হবে। অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে শুল্ক পুনর্মূল্যায়নের সুযোগ থাকতে পারে। পাশাপাশি, রফতানি বাজার বৈচিত্র্যময় করার উদ্যোগ নিতে হবে।’

ব্যবসায়ীরাও মনে করেন, বাজার ধরে রাখতে হলে ক্রেতাদের সঙ্গে সমঝোতা করে নতুন কৌশল গ্রহণ করতে হবে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্কনীতি কার্যকর হলে বাংলাদেশের রফতানি ব্যয় বাড়বে, যা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ার ঝুঁকি তৈরি করবে। তাই দ্রুত কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য আলোচনায় নামা জরুরি।

অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক আরোপের ভিত্তি পরিষ্কার নয় বলে মন্তব্য করেছেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেছেন, ‘এই সিদ্ধান্ত কীভাবে নেওয়া হলো, তা বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।’

তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র বলছে, বাংলাদেশ তাদের দেশ থেকে যেসব পণ্য আমদানি করে, তাতে গড়ে ৭৪ শতাংশ শুল্ক বসানো হয়েছে। সেই হিসেবে বাংলাদেশের রফতানি পণ্যের ওপর ৩৭ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে যে পণ্য আমদানি করে, সেগুলোর শুল্কহার অনেক কম।’

মোস্তাফিজুর রহমান আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে মূলত তিনটি প্রধান পণ্য আমদানি করে—স্ক্র্যাপ আয়রন, পেট্রোলিয়াম ও কটন। এর মধ্যে স্ক্র্যাপ আয়রন ও কটন কাঁচামাল হিসেবে আমদানি হয়, যার ওপর কোনও শুল্ক নেই। অথচ যুক্তরাষ্ট্র বলছে, বাংলাদেশের আমদানি শুল্ক ৭৪ শতাংশ। এই হিসাব কোন যুক্তিতে করা হলো, তা ব্যাখ্যা প্রয়োজন।’

তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব নীতিমালা অনুযায়ী, তাদের কাঁচামাল ব্যবহার করে প্রস্তুতকৃত পণ্য পুনরায় সেই দেশেই রফতানি হলে শুল্ক ছাড় দেওয়ার কথা। বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের কটনের অন্যতম প্রধান ক্রেতা এবং সেই কটন দিয়ে তৈরি পোশাক রফতানি করছে যুক্তরাষ্ট্রেই। তাহলে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই নীতি কেন প্রযোজ্য হলো না, সেটিও প্রশ্নসাপেক্ষ।’

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো আরও বলেন, ‘টিকফার মতো প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে আমাদের জানতে চাইতে হবে, ঠিক কী ভিত্তিতে তারা এই শুল্কহার নির্ধারণ করলো। তাদের আমদানি শুল্কের হার কম, অথচ আমাদের ওপর পাল্টা শুল্ক আরোপ করা হলো।’

তবে ‘পাল্টা শুল্কের’ ফলে যুক্তরাষ্ট্রে পোশাকের দাম বেড়ে যেতে পারে, যা বাজারে চাহিদা কমিয়ে দেবে বলে মনে করছেন এই খাতের উদ্যোক্তারা। তারা বলছেন, এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারের দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। মার্কিন সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে শুল্ক কমানোর উদ্যোগ নিতে হবে। প্রয়োজনে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা পণ্যে শুল্ক কমিয়ে রফতানিতে সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করা যেতে পারে।

এ প্রসঙ্গে নিট শিল্প মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘শুল্ক বৃদ্ধির ফলে প্রতিযোগিতা কঠিন হয়ে পড়বে। তবে বাংলাদেশ যদি যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা পণ্যের শুল্ক কমায়, তাহলে পাল্টা শুল্কের চাপ কিছুটা কমতে পারে। কারণ, দেশটি থেকে আমরা তুলা আমদানি করে পোশাক তৈরি করি এবং তা আবার তাদের কাছেই রফতানি করি। এতে শুল্কমুক্ত সুবিধার দাবি জানানো যেতে পারে।’

তিনি বলেন, ‘টিকফা চুক্তির আওতায় মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে বসে আলোচনার মাধ্যমে শুল্কহার কমানোর চেষ্টা করতে হবে।’

এছাড়া, যুক্তরাষ্ট্র থেকে পণ্য আমদানির ওপর শুল্ক পর্যালোচনা করে বাংলাদেশ পাল্টা চাপ সৃষ্টি করতে পারে বলেও মনে করছেন অনেকে। তবে দ্রুত উদ্যোগ না নিলে দেশের প্রধান রফতানি খাত মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন এই খাতের উদ্যোক্তারা।

এ প্রসঙ্গে বিকেএমইএর সাবেক সভাপতি ফজলুল হক বলেন, ‘শুল্ক বৃদ্ধির ফলে মার্কিন ক্রেতারা প্রথমেই পোশাকের দাম কমানোর চাপ দিতে পারেন। বর্তমান ক্রয়াদেশের দামও তারা পুনর্মূল্যায়ন করতে চাইতে পারে। তাই সরকারের উচিত বেসরকারি খাতের সঙ্গে আলোচনা করে দ্রুত কার্যকর কৌশল নির্ধারণ করা।’

বিজিএমইএর নেতারাও বলছেন, বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের ওপর শুল্ক বৃদ্ধির ফলে মার্কিন ক্রেতাদের জন্য এই পণ্য ব্যয়বহুল হয়ে উঠবে। এতে বাজার ধরে রাখা কঠিন হবে বলে মনে করেন বিজিএমইএ’র সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল।

বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘শুল্ক বৃদ্ধির ফলে আমাদের প্রতিযোগিতার সক্ষমতা হ্রাস পাবে। দ্রুত কূটনৈতিক আলোচনা শুরু করা জরুরি।’

শাশা ডেনিমসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামস মাহমুদ বলেন, ‘যদি আমরা মার্কিন পণ্যের শুল্ক শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে পারি, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রেও আমাদের রফতানিতে শুল্ক কমানোর সুযোগ তৈরি হতে পারে।’

তবে যুক্তরাষ্ট্রের ৩৭ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপে ‘বিচলিত হওয়ার কিছু নেই’ বলে মনে করেন বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান মইনুল খান। তিনি বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘পাল্টা শুল্ক আরোপ আমাদের রফতানিতে কতটা প্রভাব ফেলবে, তা বিশ্লেষণ করে দেখা হবে। বিষয়টি নিয়ে ট্যারিফ কমিশন ছুটির পর কাজ শুরু করবে।’

মইনুল খান মনে করেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের এ ধরনের শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত এখনও চূড়ান্ত নয়, দর-কষাকষির সুযোগ রয়েছে। টিকফা চুক্তির আওতায় আমরা আলোচনার মাধ্যমে শুল্কহার কমানোর চেষ্টা করবো। কারণ এটি শুধু বাংলাদেশের ওপরই আরোপ হয়নি, সব দেশকে লক্ষ্য করেই এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।’

তবে তিনি স্বীকার করেন, এই পাল্টা শুল্কের কারণে বাংলাদেশ কিছুটা চাপে পড়বে। কিন্তু একইসঙ্গে তিনি মনে করিয়ে দেন, বাংলাদেশের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী চীন ও ভিয়েতনামের ওপরও উচ্চ হারে শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। ফলে প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ এখনও টিকে থাকার মতো অবস্থানে রয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির ওপর প্রভাব

মইনুল খান বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের আমদানি করা পণ্যের দাম বাড়লে দেশটির অভ্যন্তরীণ মূল্যস্ফীতি বাড়তে পারে। এতে মার্কিন অর্থনীতি সংকুচিত হতে পারে এবং ভোক্তা ও ব্যবসায়ীরা ট্রাম্প প্রশাসনের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারেন। এই পরিস্থিতি বাংলাদেশসহ অন্যান্য রফতানিকারক দেশের জন্য ইতিবাচক হতে পারে।’

তিনি আরও জানান, অতীতেও বাংলাদেশ রফতানির ক্ষেত্রে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেছে। কোটাপ্রথা উঠে যাওয়ার পরও পোশাকশিল্প দ্রুত মানিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছিল।

শুল্কহার পর্যালোচনার প্রয়োজন

ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য আমদানির ওপর শুল্কহার ৭৪ শতাংশ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু এই হিসাব কীভাবে করা হলো, তা বাস্তবসম্মত উপায়ে পর্যালোচনা করতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের কাছে এ সংক্রান্ত কয়েকটি সমীক্ষা প্রতিবেদন রয়েছে। এগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা হবে, পাল্টা শুল্ক আমাদের রফতানির জন্য আসলেই হুমকি কিনা। সেই অনুযায়ী আমরা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা করবো।’

তিনি আশাবাদ প্রকাশ করে বলেন, ‘আলোচনার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্কনীতি বাংলাদেশের জন্য সহনীয় পর্যায়ে আনা সম্ভব হবে।’

এদিকে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক বৃদ্ধির বিষয়টি আলোচনার মাধ্যমে ইতিবাচকভাবে সমাধান হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

তিনি বলেন, ‘বিষয়টি আমরা পর্যালোচনা করছি। এটি আলোচনার মাধ্যমে সমাধানযোগ্য, তাই আমরা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা করবো এবং আশাবাদী যে সর্বোত্তম সমাধানে পৌঁছাতে পারবো।’

বৃহস্পতিবার (৩ এপ্রিল) ব্যাংককে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম এ তথ্য জানান।

তিনি বলেন, ‘আমাদের সম্পর্ক আরও শক্তিশালী করতে দুই দেশ একসঙ্গে কাজ করছে। আমরা এমন একটি সমাধানের দিকে এগোচ্ছি, যা উভয়পক্ষের জন্যই উপকারী হবে।’

এদিকে, বাংলাদেশ সরকার যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানিকৃত পণ্যের শুল্ক কাঠামোও পর্যালোচনা করছে বলে জানান শফিকুল আলম। এ বিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছে বলেও জানান তিনি।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানিকৃত পণ্যের ওপর যে পাল্টা শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছেন, তা বৈশ্বিক অর্থনীতির জন্য এক ধরনের ‘সুনামি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন।

তিনি বলেন, “গত শত বছরে এ ধরনের নজিরবিহীন ঘটনা আর ঘটেনি। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) কাঠামোর আওতায় স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশের ওপর এ ধরনের শুল্কারোপ অনুচিত। তা সত্ত্বেও এমন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, যা আমাদের জন্য একেবারে অনাকাঙ্ক্ষিত এক ধাক্কা।”

শেখ বশিরউদ্দীনের মতে, যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশের মধ্যকার পণ্য আমদানি-রফতানির ভারসাম্যকে কেন্দ্র করেই এ শুল্ক নির্ধারণ করা হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশ যে পরিমাণ সেবা—যেমন প্রযুক্তি, ব্যাংকিং ও বিমা খাতভিত্তিক সেবা—আমদানি করে, সেটিকে শুল্ক নির্ধারণের ক্ষেত্রে আমলে নেওয়া হয়নি।

তিনি বলেন, “যদি সেবা খাতের আমদানিকেও বিবেচনায় নেওয়া হতো, তাহলে হয়তো বাংলাদেশের রফতানি পণ্যের ওপর এত পরিমাণে পাল্টা শুল্কারোপ হতো না। এখনও পুরো বিষয়টি আমাদের কাছে পরিষ্কার নয়। অনেক দিক থেকেই এটি অস্পষ্ট। তাই আমরা প্রথমে বিষয়টি ভালোভাবে বিশ্লেষণ করছি। এরপর করণীয় নির্ধারণে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হবে।”

অর্ডার হারানোর শঙ্কা

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময়ে আরোপিত পাল্টা শুল্ক বলবৎ থাকলে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের ওপর চাপ বাড়তে পারে। সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা করছেন, অতিরিক্ত শুল্কের কারণে যুক্তরাষ্ট্রে রফতানিযোগ্য হেভি জার্সি, ডেনিম প্যান্ট ও হোম টেক্সটাইলের কিছু ক্রয়াদেশ ভারত ও পাকিস্তানের মতো প্রতিযোগী দেশে স্থানান্তর হতে পারে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের ফলে যুক্তরাষ্ট্রে ভোক্তাপণ্যের দাম বাড়বে, যা দেশটিতে মূল্যস্ফীতি বাড়িয়ে দিতে পারে। একইসঙ্গে পাল্টা শুল্কের কারণে অন্যান্য দেশেও মূল্যস্ফীতি বেড়ে যেতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে বিশ্ববাজারে তৈরি পোশাকের সামগ্রিক চাহিদা হ্রাস পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। চাহিদা কমে গেলে কমে যেতে পারে নতুন অর্ডারের সংখ্যাও। এতে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

প্রতিটি শার্টের দাম বাড়বে গড়ে ৩ দশমিক ৪০ ডলার

যুক্তরাষ্ট্রের নতুন পাল্টা শুল্কে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্প পড়েছে বড় ধরনের চাপের মুখে। বিশেষ করে তৈরি পোশাকের মতো মূল্য সংবেদনশীল পণ্যে অতিরিক্ত শুল্কের প্রভাব সরাসরি বাজারে পড়বে।

বর্তমানে একটি সাধারণ তৈরি পোশাক— যেমন একটি শার্ট— যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি হলে তার ভিত্তিমূল্য ধরা হয় ১০ ডলার। ১৬ শতাংশ বিদ্যমান শুল্ক যুক্ত হলে চূড়ান্ত মূল্য দাঁড়ায় ১১ দশমিক ৬০ ডলার। তবে ট্রাম্প প্রশাসনের ঘোষিত নতুন ৩৭ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপ হলে মোট শুল্ক দাঁড়াবে ৫৩ শতাংশ। এতে ওই একই শার্টের বাজারদর গিয়ে ঠেকবে প্রায় ১৫ ডলারে।

মূল্য এই মাত্রায় বেড়ে যাওয়ায় মার্কিন ভোক্তাদের মধ্যে বাংলাদেশি পণ্যের প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়তে পারে। অনেকেই সস্তা পণ্যের উৎস হিসেবে অন্য দেশ বা বিকল্প ব্র্যান্ডের দিকে ঝুঁকতে পারেন।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের পণ্যের গুণগত মান ভালো হলেও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে মূল্যই মূল নিয়ামক। ফলে শুল্ক বৃদ্ধির সরাসরি প্রভাব পড়তে পারে রফতানির পরিমাণে।

ঝুঁকিতে ৪০ বিলিয়ন ডলারের পোশাক

যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষিত ৩৭ শতাংশ পাল্টা শুল্কের প্রভাব শুধু তৈরি পোশাক শিল্পেই সীমাবদ্ধ থাকবে না— বরং তা আঘাত হানতে পারে এই খাতকে ঘিরে গড়ে ওঠা পুরো অর্থনৈতিক ইকোসিস্টেমে। এমনটাই আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অর্থনীতিবিদ ও শিল্প সংশ্লিষ্টরা।

তাদের মতে, তৈরি পোশাক খাতে সরাসরি কর্মরত প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক এই সংকটে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে পড়বেন। তবে এর চেয়েও বড় উদ্বেগের বিষয় হলো, পোশাকশিল্প সংশ্লিষ্ট যে বিশাল নেটওয়ার্ক বাংলাদেশের অর্থনীতিকে সাপোর্ট দিচ্ছে, সেই নেটওয়ার্কেও প্রভাব পড়তে শুরু করবে।

এই নেটওয়ার্কের মধ্যে রয়েছে— টেক্সটাইল কাঁচামাল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান, তৈরি পোশাক রফতানিতে অর্থায়নকারী ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান, পণ্য পরিবহনকারী শিপিং লাইন, বিমা কোম্পানি এবং বিভিন্ন রফতানি প্রক্রিয়াকরণ সংস্থা। প্রায় ৪০ বিলিয়ন ডলারের এই শিল্পকে ঘিরে গড়ে ওঠা এই সমন্বিত কাঠামোই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রফতানি খাতকে টিকিয়ে রেখেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের প্রতিযোগিতা কমে গেলে শুধু রফতানি আয় কমবে না, বরং পুরো অর্থনীতিতে এর বিরূপ প্রভাব পড়বে। দীর্ঘ মেয়াদে এই প্রভাব কর্মসংস্থান, ব্যাংক খাতের স্থিতিশীলতা এবং বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহেও নেতিবাচক চাপ তৈরি করতে পারে।

বাণিজ্যে ভারসাম্য বাংলাদেশের পক্ষে

২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ রফতানি করেছে ৮৩৬ কোটি ডলারের পণ্য, যার মধ্যে ৮০ শতাংশের বেশি ছিল তৈরি পোশাক। অপরদিকে, যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি হয়েছে ২২১ কোটি ডলারের পণ্য। ফলে ওই বছর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত দাঁড়ায় ৬১৫ কোটি ডলার।

গত এক দশকে বাংলাদেশের রফতানি বেড়েছে আড়াই শ কোটি ডলার, যেখানে আমদানি বেড়েছে সোয়া শ কোটি ডলারের মতো। ২০১৫ সালে রফতানি ছিল ৫৯৯ কোটি ডলার, আর আমদানি ৯৪ কোটি ডলার।

ফতানি পণ্যের ধরন

রফতানির সিংহভাগ তৈরি পোশাক হলেও, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, ওষুধ, প্লাস্টিক ও মুদি পণ্যও যুক্তরাষ্ট্রে যায়। ২০২৪ সালে তৈরি পোশাক রফতানি হয় ৭০০ কোটি ডলারের। চামড়াজাত পণ্য রফতানি হয়েছে ৮-১০ কোটি ডলার, ওষুধ ২-৩ কোটি, প্লাস্টিক ১-২ কোটি এবং মুদি পণ্যও রয়েছে তালিকায়।

যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি কী?

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) হিসাব বলছে, ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২৯১ কোটি ডলারের পণ্য এসেছে। এর মধ্যে রফতানিমুখী পোশাকশিল্পের জন্য কাঁচামাল ছিল ২৯ কোটি ডলারের, যা শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানি হয়েছে। অভ্যন্তরীণ ব্যবহারের জন্য এসেছে ২৬২ কোটি ডলারের পণ্য।

সর্বাধিক আমদানি পণ্য ছিল পুরোনো লোহার টুকরা বা স্ক্র্যাপ (৭৭ কোটি ৮৬ লাখ ডলার), যার ওপর গড়ে ৪ শতাংশ শুল্ক। এরপর রয়েছে বিউটেন (৩৩ কোটি ৩৮ লাখ ডলার), সয়াবিন বীজ (৩২ কোটি ডলার), তুলা (২৬ কোটি ৮৭ লাখ ডলার), উড়োজাহাজের ইঞ্জিন, এলএনজি, হুইস্কি, গাড়ি, গম ও কাঠবাদামসহ বিভিন্ন পণ্য।

সরকারি উদ্যোগ

যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক বৃদ্ধির ঘোষণার প্রেক্ষিতে এনবিআর ও বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন ইতোমধ্যে বিষয়টি পর্যালোচনা শুরু করেছে। এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান জানিয়েছেন, রবিবার (৬ এপ্রিল) এনবিআরে বৈঠক ডাকা হয়েছে। সেখানে শুল্ক নীতির পরিবর্তন ও সম্ভাব্য পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা হবে।

ট্যারিফ কমিশন রফতানি খাতে প্রভাব বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদন দেবে। যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্কে বাংলাদেশের রফতানি হুমকির মুখে পড়ে কিনা—সে বিষয়েও মূল্যায়ন করা হবে।