Image description
 

আমেরিকার নতুন শুল্কনীতির আওতায় বাংলাদেশি পণ্যের ওপর শুল্কহার বাড়িয়ে ৩৭ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। এতদিন এই হার ছিল গড়ে ১৫ শতাংশ। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন নতুন এ সিদ্ধান্ত নেওয়ায় বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পের ওপর প্রভাব পড়তে পারে বলে প্রাথমিকভাবে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

তবে যেহেতু আমেরিকার এই সিদ্ধান্ত শুধু বাংলাদেশকে ঘিরে রাজনৈতিক নয়, তাই বাংলাদেশের জন্য সম্ভাবনার দুয়ারও খোলা রয়েছে বলে মনে করছেন রপ্তানিকারকরা।

রপ্তানি খাতের উদ্যোক্তা ও বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমানে আমেরিকার পণ্য বাংলাদেশের বাজারে প্রবেশের ক্ষেত্রে ৭৪ ভাগ শুল্ক রয়েছে। তবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বলছে, এটি গড় শুল্ক নয়। গড় শুল্কহার ১৫-২৫% এর মধ্যে। ৭৪ ভাগের হিসাবটি হয়তো কোনো একটি পণ্যের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। আমেরিকার পণ্য আমদানিতে শুল্ক কমিয়ে অর্ধেকে আনলেও বাংলাদেশ আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। কারণ এগুলো মৌলিক পণ্য নয়। অন্যদিকে আমেরিকায় বাংলাদেশি রপ্তানি পণ্যের সবই মৌলিক চাহিদার পণ্য। আর এই সুযোগ কাজে লাগাতে পারে বাংলাদেশ।

বাংলাদেশের প্রধান দুই রপ্তানি বাজারের একটি আমেরিকা, অন্যটি ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। আমেরিকায় বছরে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি হয় প্রায় ৮ দশমিক ৪ বিলিয়ন (৮৪০ কোটি) ডলার, যা প্রধানত তৈরি পোশাক। গত বছর দেশটিতে তৈরি পোশাক রপ্তানি দাঁড়ায় ৭ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন (৭৩৪ কোটি) ডলারে। আমেরিকায় তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের প্রতিযোগী দেশগুলোর মধ্যে আছে চীন, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, ভারত, কম্বোডিয়া, শ্রীলংকা ও পাকিস্তান।

ট্রাম্পের নতুন শুল্কনীতিতে চীনা পণ্যে শুল্ক ধরা হয়েছে ৩৪ শতাংশ, ভিয়েতনামের পণ্যের ওপর ৪৬ শতাংশ, ইন্দোনেশিয়ার পণ্যে ৩২ শতাংশ, ভারতের ওপর ২৬ শতাংশ, কম্বোডিয়ার ওপর ৪৯ শতাংশ, শ্রীলংকার ওপর ৪৪ শতাংশ ও পাকিস্তানের ওপর ২৯ শতাংশ।

এছাড়া ইইউর পণ্যের ওপর ২০ শতাংশ, তাইওয়ানের পণ্যে ৩২ শতাংশ, জাপানের পণ্যে ২৪ শতাংশ, দক্ষিণ কোরিয়ার পণ্যে ২৫ শতাংশ, থাইল্যান্ডের পণ্যে ৩৬ শতাংশ, সুইজারল্যান্ডের পণ্যে ৩১ শতাংশ, মালয়েশিয়ার পণ্যে ২৪ শতাংশ, যুক্তরাজ্যের পণ্যে ১০ শতাংশ, দক্ষিণ আফ্রিকার পণ্যে ৩০ শতাংশ, ব্রাজিলের পণ্যে ১০ শতাংশ, সিঙ্গাপুরের পণ্যে ১০ শতাংশ, ইসরাইলের পণ্যে ১৭ শতাংশ, ফিলিপাইনের পণ্যে ১৭ শতাংশ, চিলির পণ্যে ১০ শতাংশ, অস্ট্রেলিয়ার পণ্যে ১০ শতাংশ, তুরস্কের পণ্যে ১০ শতাংশ, মিয়ানমারের পণ্যে ৪৪ শতাংশ, লাওসের পণ্যে ৪৮ শতাংশ এবং মাদাগাস্কারের পণ্যের ওপর ৪৭ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে।

ওয়াশিংটনের স্থানীয় সময় বুধবার বিকাল ৪টায় (বাংলাদেশ সময় বুধবার রাত ২টা) হোয়াইট হাউসে সংবাদ সম্মেলন করে নতুন করে শুল্ক ঘোষণা করেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। হোয়াইট হাউসের রোজ গার্ডেনে উপস্থিত সাংবাদিকসহ সমবেতদের উদ্দেশে বক্তব্যের শুরুতেই ট্রাম্প বলেন, ‘আজ খুব ভালো খবর’ থাকবে। এ সময় দর্শক সারি থেকে করতালি দিয়ে তাকে অভিনন্দন জানানো হয়। এ দিনটিকে আমেরিকার ‘অর্থনৈতিক স্বাধীনতা দিবস’ অভিহিত করেন ট্রাম্প।

ট্রাম্প বলেন, এই দিনের জন্য আমেরিকা দীর্ঘদিন ধরে অপেক্ষা করছে। ট্রাম্প প্রশাসনের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির অংশ হিসেবে এই শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। প্রশাসনের যুক্তি, এতদিন বিভিন্ন দেশ মার্কিন পণ্যের ওপর উচ্চহারে শুল্ক আরোপ করায়, আমেরিকাও পাল্টা ব্যবস্থা নিচ্ছে।

কী প্রতিক্রিয়া রপ্তানিকারকদের

আমেরিকার নতুন শুল্কনীতি যেহেতু কোনো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নয় এবং বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানিতে প্রতিযোগী দেশগুলোর শুল্কহারও প্রায় একই, ফলে এ নিয়ে এখনই উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই বলে মনে করছেন রপ্তানিকারকরা। তবে শঙ্কার বিষয়টি একেবারে উড়িয়ে দিচ্ছেন না তারা। বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজ আমার দেশকে বলেন, আমাদের রপ্তানি আয়ের প্রধান উৎসই তৈরি পোশাক। এটি মৌলিক পণ্য। তৈরি পোশাকের মধ্যে আবার বাংলাদেশ মূলত ‘বেসিক পণ্য’ বেশি রপ্তানি করে। ফলে আমেরিকায় এর খুব একটা প্রভাব পড়বে না। এছাড়া আমাদের প্রতিযোগী দেশগুলোর ওপরও প্রায় সমান হারে শুল্কারোপ করা হয়েছে। বরং এক্ষেত্রে বাংলাদেশ লাভবান হতে পারে দরকষাকষির সুযোগ কাজে লাগিয়ে। তিনি এর একটি স্পষ্ট ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, ‘বর্তমানে আমেরিকার পণ্যের ওপর বাংলাদেশ ৭৪ ভাগ শুল্ক আদায় করে থাকে। বাংলাদেশে যেসব পণ্য আমেরিকা থেকে আমদানি হয়, সেগুলোর কোনোটিই মৌলিক পণ্য নয়। ফলে বাংলাদেশ চাইলে আমেরিকার পণ্যের শুল্ক অর্ধেকে নামিয়ে তাদের বাজারে প্রবেশে নতুন ঘোষিত শুল্ক ছাড় নিতে পারে। এটি সম্ভাবনার দুয়ার তৈরি করবে।’

তবে কিছুটা শঙ্কার কথা বলেছেন বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফেকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম। তিনি বলেন, আমাদের পণ্য রপ্তানিতে মুনাফার হার খুবই কম। এখানে সামান্য শুল্কারোপ মানেই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার নতুন চ্যালেঞ্জ। এটি সময়মতো মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হলে মহাবিপদের আশঙ্কা রয়েছে। তিনি জানান, বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির প্রধান অংশ ট্রাউজার, টি-শার্ট, সোয়েটার, শার্ট ও ব্লাউজ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ট্রাউজার রপ্তানি ১ হাজার ১৯৩ কোটি ডলারে নেমে এসেছে, যা আগের বছরের তুলনায় ৪ শতাংশ কম। টি-শার্ট রপ্তানি ৭৭৩ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় ১০০ কোটি ডলার কম। সোয়েটার রপ্তানি ২০২১-২২ অর্থবছরে ৫০০ কোটি ডলার থাকলেও ২০২৩-২৪ সালে তা কমে ৪৮২ কোটি ডলারে নেমেছে। শার্ট ও ব্লাউজের রপ্তানি ৮ শতাংশ কমে ২৯৩ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। এর মূল কারণই হচ্ছে মুনাফার অশুভ প্রতিযোগিতা। ‘এ জন্য আমরা নিজেরাই দায়ী’ বলে মন্তব্য করেন বিকেএমইএ সভাপতি।

তৈরি পোশাকের রপ্তানিবাজার, ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা ও সমস্যা নিয়ে গবেষণা করেন এই খাতের উদ্যোক্তা মহিউদ্দিন রুবেল। তিনি বলেন, ট্রাম্পের নতুন শুল্কনীতিতে উদ্বেগের কিছুই নেই বাংলাদেশের। কারণ ব্যাখ্যা করে রুবেল বলেন, কিছুদিন আগেও বাংলাদেশ তার নীতি নির্ধারণে স্বাধীন সিদ্ধান্ত নিতে পারত না। রপ্তানিতে আমাদের প্রতিযোগী ভারতের ওপর নির্ভরশীল ছিল বাংলাদেশ। এখন এই সরকারের সেরকম কিছু নেই। সরকার চাইলেই যেকোনো নীতি সিদ্ধান্ত নিতে পারছে। ফলে আমাদের মূল রপ্তানি বাজার আমেরিকা ও ইউরোপের দিকটি মাথায় রেখে যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া এখন আমাদের জন্য সহজ।

আমেরিকা থেকে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি আমদানি করে তুলা, গম ও গাড়ি। বছরে প্রায় ২ বিলিয়ন ডলারের তুলা আমদানি হয় দেশটি থেকে। বাংলাদেশ যদি এখনই আমেরিকার পণ্যে শুল্ক কমিয়ে দেশটির সঙ্গে দরকষাকষি করে বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানিতে অন্তত ৫ থেকে ৭ ভাগ শুল্ক ছাড় আনতে পারে। এটি দেশের রপ্তানি বাজারের জন্য নতুন সম্ভাবনা তৈরি করবে বলে মনে করছেন উদ্যোক্তা ও বিশ্লেষকরা। নোমান গ্রুপের শীর্ষ কর্মকর্তা সিফাত আহমেদ ফাহিম আমার দেশকে বলেন, আমেরিকা থেকে আমরা যেসব তুলা আমদানি করি, তার সবই সে দেশের পোশাক ক্রেতাদের চাহিদার ভিত্তিতে আনা হয়। ফলে বাংলাদেশ যদি শুল্ক কমিয়ে আনে, তাতে রাজস্ব আদায়ে তেমন প্রভাব পড়বে না। বরং এতে একটি নতুন সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশ সময়মতো সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হলে শঙ্কা নিয়েই উদ্যোক্তাদের রপ্তানি বাজারে টিকে থাকতে হবে।

নিট পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সাবেক সভাপতি ফজলুল হক আমার দেশকে বলেন, বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরেই রপ্তানি বাজারে তীব্র প্রতিযোগিতার মধ্যে রয়েছে। মূলত জ্বালানি সংকট, শ্রমিক অসন্তোষ ও রপ্তানি বাজারে কম মূল্যে পণ্য বিক্রির অশুভ প্রতিযোগিতা বাংলাদেশকে সব সময় পেছনে টেনে নিচ্ছে। এই দিকগুলো মাথায় নিয়ে এখনই আমাদের এক টেবিলে বসতে হবে। মূল সমস্যাগুলো সমাধানে নজর দিতে হবে। সেই সঙ্গে আমেরিকাকে শুল্ক ছাড় দিয়ে বাড়তি সুবিধা আদায় করতে হবে। এতে বাংলাদেশই লাভবান হবে বলে মনে করেন তিনি।

ফজলুল হক বলেন, আমরা রপ্তানিমুখী শীর্ষস্থানীয় পোশাকের ক্রয়াদেশ হারাচ্ছি কি না, সেটি খতিয়ে দেখতে হবে। কারণ, এসব পণ্য উৎপাদনের সঙ্গে অনেক কারখানা ও লাখ লাখ শ্রমিক জড়িত। তৈরি পোশাক রপ্তানির এই মূল ভিত্তি টিকিয়ে রাখতে নীতিনির্ধারকদের প্রতি অনুরোধ, গ্যাস–বিদ্যুৎসহ যেকোনো মূল্যবৃদ্ধিতে রপ্তানিকারকদের সময় দিতে হবে।

নতুন শুল্ক কাঠামোর প্রভাব পর্যালোচনা করছে সরকার

মার্কিন বাজারে বাংলাদেশের রপ্তানি রণ্যের ওপর এই নতুন শুল্ক কাঠামোর প্রভাব কী হবে, তা পর্যালোচনা করে দেখছে বাংলাদেশ সরকার। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) দ্রুততার সঙ্গে শুল্ক কাঠামো পর্যালোচনা করছে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। সরকার সম্ভাব্য কৌশল হিসেবে আমেরিকার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার উদ্যোগ নিচ্ছে এবং বিকল্প বাজার সম্প্রসারণের বিষয়টি বিবেচনা করছে বলে জানান তিনি।

শফিকুল আলম বলেন, সরকারের মূল লক্ষ্য হলো আমেরিকার সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক বজায় রেখে বাংলাদেশের রপ্তানি খাতকে সুরক্ষা দেওয়া। তিনি বলেন, ‘আমেরিকা বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও আমাদের বৃহত্তম রপ্তানি গন্তব্য। ট্রাম্প প্রশাসন দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে আমরা দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে একসঙ্গে কাজ করে আসছি। আমেরিকার সঙ্গে আমাদের চলমান কার্যক্রম শুল্ক সমস্যা সমাধানে সহায়তা করবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বাংলাদেশের উচিত আমেরিকার পণ্যের ওপর প্রচলিত ৭৪ শতাংশ শুল্ক কমিয়ে ৩০ শতাংশ করা, যাতে পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর আমেরিকার শুল্ক কমতে পারে। এই কৌশল অনুসরণ করলে বাংলাদেশের রপ্তানিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আসতে পারে। বাংলাদেশ মূলত মধ্যম ও কম দামের পণ্য রপ্তানি করে। এসব পণ্যের দাম আমেরিকার বাজারে ২০ থেকে ৬০ ডলারের মধ্যে। অন্যদিকে ভিয়েতনাম, চীন এমনকি ভারত এখন উচ্চ মূল্যের পোশাক রপ্তানি করছে। ফলে তারা যতটা আক্রান্ত হবে, বাংলাদেশ ততটা হবে না বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

আন্তর্জাতিক বাজার বিশেষজ্ঞদের মতে, ট্রাম্পের এই পাল্টা শুল্ক বিশ্বকে বাণিজ্যযুদ্ধের দিকেও ঠেলে দিতে পারে। এই শুল্ক আমেরিকার বাজারেও মন্দা পরিস্থিতি তৈরি করবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন একাধিক বিশেষজ্ঞ ও বাজার সমীক্ষা সংস্থা। ইতোমধ্যে তার লক্ষণ দেখা গেছে। ট্রাম্প যখনই শুল্ক নিয়ে কিছু বলেছেন বা সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছেন, তাৎক্ষণিকভাবে মার্কিন শেয়ারবাজারে তার প্রভাব পড়েছে। শুল্কের কারণে আমেরিকায় বিভিন্ন পণ্যের দাম বাড়বে। ট্রাম্প বিদেশি গাড়ি যেমন ইউরোপীয় বা কোরীয় কিংবা জাপানি গাড়িতে শুল্ক আরোপ করেছেন। কারণটা পরিষ্কার, তিনি চান দেশের মানুষ নিজস্ব পণ্য যেমন ফোর্ডের গাড়ি বেশি কিনুক।

প্রতিবাদে সোচ্চার অনেক দেশ

বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আমেরিকায় পণ্য আমদানির ওপর উচ্চহারে শুল্ক আরোপের যে ঘোষণা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দিয়েছেন, তার বিরোধিতায় সোচ্চার হয়েছে চীন, জাপান, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যসহ আরো অনেক দেশ। দেশগুলোর দেওয়া তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তাদের ব্যাপকভাবে ক্ষুব্ধ হওয়ার বিষয়টি উঠে এসেছে বলে জানিয়েছে এএফপিসহ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম। তাদের খবরে বলা হয়, ট্রাম্পের নতুন করে এ শুল্ক আরোপ করাকে ‘বাণিজ্যযুদ্ধ’ হিসেবে আখ্যায়িত করছে অনেক দেশ। বেইজিং বলেছে, তাদের রপ্তানি পণ্যের ওপর আমেরিকার নতুন করে শুল্ক আরোপকে ‘জোরালোভাবে প্রত্যাখ্যান’ করছে তারা। সেই সঙ্গে নিজের অধিকার ও স্বার্থরক্ষায় পাল্টা পদক্ষেপ নেওয়ার অঙ্গীকার করছে।

চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলছে, আমেরিকার শুল্কারোপ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের নিয়মনীতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয় এবং এটি সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর বৈধ অধিকার ও স্বার্থকে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।

দ্য জার্মান অটোমোটিভ ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন (ভিডিএ) বলেছে, এই শুল্ক ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের সংখ্যাই শুধু বাড়াবে। ইইউ এখন নিজেদের একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানাচ্ছে উল্লেখ করে ভিডিএ আরো বলেছে, এ জোট সমঝোতায় আগ্রহের ইঙ্গিতও দিয়ে যাচ্ছে।

জার্মান কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রির সবচেয়ে বড় বাজার আমেরিকা। প্রতিষ্ঠানটি ইইউ-কে ‘মাথা ঠান্ডা’ রাখার অনুরোধ জানিয়ে বলেছে, ‘উত্তেজনা শুধু ক্ষতিই বাড়াবে।’

আমেরিকায় রপ্তানি পণ্যে ২৪ শতাংশ শুল্ক আরোপের শিকার জাপান। দেশটির বাণিজ্যমন্ত্রী ইয়োসি মুতো ট্রাম্পের পদক্ষেপের সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেন, আমেরিকার এই একতরফা শুল্কারোপ খুবই দুঃখজনক এবং এটি জাপানের ওপর প্রয়োগ না করার জন্য আমি জোরালো আহ্বান জানাই (ওয়াশিংটনকে)। দেশটির মুখ্য কেবিনেট সেক্রেটারি ইয়োসিমাসা হায়াসি সাংবাদিকদের বলেন, এ শুল্ক আরোপ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) বিধিমালা ও দুপক্ষের মধ্যকার বাণিজ্য চুক্তির লঙ্ঘন হয়ে থাকতে পারে।

আমেরিকার সঙ্গে একটা অর্থনৈতিক চুক্তিতে আবদ্ধ হতে যুক্তরাজ্য শান্ত ও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকবে বলে জানান ব্রিটিশ বাণিজ্যমন্ত্রী জোনাথান রেনল্ডস। তিনি বলেন, এমন চুক্তি যুক্তরাজ্যের রপ্তানি পণ্যের ওপর আরোপ করা ১০ শতাংশ শুল্ক কমাতে সহায়তা করতে পারে।

কানাডার প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নি হুঁশিয়ার করে বলেছেন, এ শুল্ক আরোপ বিশ্ব বাণিজ্য ব্যবস্থাকে মৌলিকভাবে বদলে দেবে। মার্ক কার্নি আরো বলেন, আমরা পাল্টা পদক্ষেপ নিয়ে এ শুল্ক মোকাবিলা করতে যাচ্ছি। আমরা আমাদের কর্মীদের সুরক্ষা দিতে চলেছি।

ব্রাজিলের আইনসভা ‘ইকোনমিক রেসিপ্রোসিটি ল’ নামে একটি আইনের অনুমোদন দিয়েছে। এতে লাতিন আমেরিকার বৃহত্তম অর্থনীতির দেশটির রপ্তানি পণ্যের ওপর ১০ শতাংশ শুল্কারোপের পাল্টা ব্যবস্থা নিতে নির্বাহী বিভাগকে অনুমতি দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে এএফপি। দক্ষিণ আমেরিকার গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক শক্তি ব্রাজিল আমেরিকায় কানাডার পর স্টিলের সবচেয়ে বড় রপ্তানিকারক দেশ। ২০২৪ সালে দেশটি আমেরিকায় ৪০ লাখ টন স্টিল পাঠিয়েছে।

সুইজারল্যান্ডের ওপর ৩১ শতাংশ শুল্ক আরোপের পর দেশটির প্রেসিডেন্ট কারিন কেলার-সাটার বলেছেন, সামনে কী পদক্ষেপ নেওয়া হবে, সরকার শিগগিরই সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। সুইস প্রেসিডেন্ট আরো বলেন, দেশের দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক স্বার্থ অগ্রাধিকারমূলক বিষয়। আন্তর্জাতিক আইন ও অবাধ বাণিজ্যের প্রতি শ্রদ্ধা দেখানোও মৌলিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট গুস্তাভো পেত্রো বলেন, আমেরিকা সরকার এখন ধারণা করছে, তার আমদানি করা পণ্যের ওপর ঢালাওভাবে শুল্ক আরোপ করে নিজেদের উৎপাদন, সম্পদ ও কর্মসংস্থান বাড়াতে পারবে। আমার মতে, এটা বড় ভুল হতে পারে।

থাই প্রধানমন্ত্রী পেতংতার্ন সিনাওয়াত্রা বলেছেন, ট্রাম্পের ৩৬ শতাংশ শুল্ক আরোপ কীভাবে মোকাবিলা করা হবে, সে ব্যাপারে শক্ত পরিকল্পনা তার সরকারের রয়েছে।

ডেনমার্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী লার্স লোক্কে রাসমুসেন বলেছেন, ট্রাম্পের নতুন পদক্ষেপ বৈশ্বিক সমৃদ্ধিকে হুমকিতে ফেলেছে। তিনি আরো বলেন, বিশ্ব বাণিজ্য আমাদের অধিকতর ভালো একটি অবস্থানে নিয়ে এসেছে। চলতি প্রজন্মে বিশ্ব আরো সম্পদশালী হয়েছে, চরম দারিদ্র্য হ্রাস পেয়েছে, শিশু মৃত্যুহার কমেছে এবং আমরা সবাই আরো দীর্ঘজীবী হয়েছি।