
ট্রেড ব্যালান্স বা বাণিজ্য সমন্বয়ের কথা বলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর বিভিন্ন হারে শুল্ক বসাতে যাচ্ছে আমেরিকা। বাংলাদেশের ওপর এ শুল্কহার ধার্য করা হয়েছে ৩৭ শতাংশ।
অর্থাৎ আগামী ৯ এপ্রিলের মধ্যে ট্রেড ব্যালান্স না করলে বাংলাদেশি পণ্যের জন্য মার্কিন আমদানিকারকদের ৩৭ শতাংশ শুল্ক গুনতে হবে। এতদিন এ শুল্কের পরিমাণ ছিল গড়ে ১৫ শতাংশ। নতুন আরোপিত এ শুল্কহার বাস্তবায়ন হলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে জাতীয় অর্থনীতি। তাই এখন থেকেই সরকারের শীর্ষ মহল থেকে কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা। তবে এ শুল্কারোপে শঙ্কার পাশাপাশি সম্ভাবনাও দেখছেন তারা।
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সাবেক সহসভাপতি এএসএম আবু তৈয়ব বলেন, বেশকিছু ভুল তথ্যের ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর ৩৭ শতাংশ শুল্ক বসানোর হুমকি দিয়েছে আমেরিকা। সরকারের উচিত কূটনৈতিক চ্যানেলে সঠিক তথ্য তাদের সামনে তুলে ধরা। আমেরিকার পণ্য বাংলাদেশে আমদানি করতে হলে সর্বোচ্চ ৭৪ শতাংশ শুল্ক দিতে হয় আমদানিকারকদের। কিন্তু সব পণ্যের ওপর একই হারে শুল্ক দেওয়া লাগে না। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কাছে এ তথ্য তুলে ধরতে হবে। এ ছাড়া তৈরি পোশাকের অধিকাংশ ক্ষেত্রে কাঁচামাল চীন থেকে আমদানি করে রপ্তানি করা হয়। এ ক্ষেত্রে বৈচিত্র্য আনার সুযোগ রয়েছে।
আবু তৈয়ব বলেন, মার্কিন সরকার যে ভাষায় কথা বলছে, আমাদেরও সে ভাষায় উত্তর দিতে হবে। যেমন তারা ট্রেড ব্যালান্সের কথা বলছে। আমেরিকায় তুলার বাজার আছে, ভোজ্যতেল, গম, বিভিন্ন ধরনের কৃষিপণ্যসহ বাংলাদেশের বাজারে চাহিদা আছে এমন পণ্য যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করার সুযোগ করে দিতে হবে। এতে বাংলাদেশের বাজারেও ইতিবাচক প্রভাব পরবে।
চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক পরিচালক মাহফুজুল হক শাহ বলেন, রপ্তানি বাণিজ্যে বাংলাদেশের প্রধান প্রতিযোগী চীন আর ভিয়েতনাম। ভিয়েতনামকে ৪৬ শতাংশ আর চীনকে ৩৪ শতাংশ শুল্কারোপ করার পরিকল্পনা আছে আমেরিকার। ভারত আর পাকিস্তানকে কেউ কেউ প্রতিযোগী বললেও মূলত বাংলাদেশ যে ক্যাটাগরির পোশাক তৈরি করে, ভারত-পাকিস্তান তা করে না। তাই ভারত আর পাকিস্তান বাংলাদেশের জন্য খুব বেশি মাথাব্যথার কারণ নয়। তবে ভিয়েতনাম ইতোমধ্যে বাণিজ্য সমন্বয় প্রক্রিয়ায় অনেকদূর এগিয়েছে। আমাদেরও বিলম্ব না করে সরকারি উদ্যোগে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা শুরু করতে হবে।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে আমেরিকার দৃশ্যমান ভালো সম্পর্ক রয়েছে উল্লেখ করে মাহফুজুল হক বলেন, এ সম্পর্কও কাজে লাগাতে হবে। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের বাজার আমাদের জন্য একটি স্থায়ী ও তৈরি করা বাজার। এটি কোনোভাবেই হাতছাড়া করার সুযোগ দেওয়া যাবে না।
বিজিএমইএর সাবেক সহসভাপতি রকিবুল আলম বলেন, আমেরিকা থেকে আমাদের রপ্তানি আয় মোট আয়ের এক-পঞ্চমাংশ হলেও একক দেশ হিসেবে সবচেয়ে বেশি। তাই যুক্তরাষ্ট্রের বাজার আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আর এ সুযোগ কাজে লাগাতে চায় দেশটি। এক্ষেত্রে অনেক বেশি কৌশলী হতে হবে বাংলাদেশকে। এই মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রের বাজার ধরে রাখতে কূটনৈতিক চ্যানেলে তৎপরতা চালাতে হবে। তবে হালের সাউথ আফ্রিকা, জাপান, তুরস্ক ও ভারতে রপ্তানির সম্ভবনা তৈরি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের কড়াকড়ির কারণে নতুন বাজার তৈরির দিকেও মনোযোগী হবেন রপ্তানিকারকরা। এটিকেও একটি সম্ভাবনা হিসেবে দেখতে চান তিনি।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক নসরুল কদির বলেন, বিগত সরকার নিজেদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী দেখাতে গিয়ে বারবার ভুয়া পরিসংখ্যান প্রচার করায় বাংলাদেশের প্রতি উন্নত রাষ্ট্রগুলোর ধারণা বদলে গেছে। বর্তমান সরকারকে ওই ধারণা বদলে দিতে হবে। আমেরিকাকে আমাদের চ্যালেঞ্জগুলো সম্পর্কে বোঝাতে হবে। না হলে হঠাৎ করে বাংলাদেশের অর্থনীতি এ চাপ সামলাতে হিমশিম খাবে।
অধ্যাপক নসরুল কদির আরো বলেন, ব্যবসায়ীদেরও কিছু দায়িত্ব আছে। তারা তাদের চ্যানেলে বায়ারদের সঙ্গে আলোচনা করতে পারেন। কারণ বাংলাদেশ সবচেয়ে সস্তায় পণ্য তৈরি ও রপ্তানি করে থাকে। এতে এককভাবে বাংলাদেশ নয়; বরং আমেরিকাও লাভবান হয়। তাই বায়ারদের মাধ্যমে তাদের সরকারের ওপর চাপ তৈরির একটি প্রেক্ষাপট বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরাও তৈরি করতে পারেন। সবাইকে এগিয়ে এসে এ চাপ মোকাবিলা করতে হবে। তবে সরকারের দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি।