Image description

বিশ্বজুড়ে মুসলিমদের অন্যতম প্রধান উৎসব হচ্ছে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা। পারস্পরিক ভেদাভেদ ভুলে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার শিক্ষা এবং আনন্দের বার্তা নিয়ে প্রতিবছর সবাই এই উৎসব উদযাপন করেন। ‘ঈদ’ শব্দের অর্থ ‘খুশি’ অথবা ‘উৎসব’। এদিন পুরুষরা নতুন জামাকাপড় পরে ঈদগায় নামাজ আদায় করতে যায়, আর নারী ও শিশুরা নতুন পোশাক পরে পাড়াপ্রতিবেশীর সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করে। তবে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয় হয়ে দাঁড়ায় ‘ঈদ সালামি’ প্রসঙ্গ।

সালামি বলতে ঈদ উপলক্ষে বড়দের সালাম করে যেকোনো পরিমাণ অর্থ অথবা অন্য কোনো উপহার পাওয়াকে বোঝানো হয়ে থাকে। এ ছাড়া এই আয়োজন ‘ঈদি’ বা ‘ঈদিয়া’ নামেও বহুল প্রচলিত। ‘ঈদিয়া’ দুটি ভিন্ন শব্দ–‘ঈদ’ ও ‘হাদিয়া’র সমন্বয়ে গঠিত। ‘হাদিয়া’ একটি আরবি শব্দ, যার অর্থ হলো ‘উপহার’ অথবা ‘উপঢৌকন’।

শুরুর কথা
ঈদ সালামির প্রচলন কোথায় প্রথম চালু হলো, কবে থেকে এর যাত্রা, কারা এর শুরুটা করেছেন, এমন সূচনাকাল সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। তবে ঈদের দিনে সালামির রেওয়াজ‌ ছিল ব্রিটিশ আমলের বাংলায়। অনেকে ফাতিমীয় খিলাফতের যুগে এর শুরু কলে জানান। ছিল অটোমান সাম্রাজ্যেও।

হিন্দি ভাষার জনপ্রিয় লেখক মুনশি প্রেমচাঁদ ‘ঈদগাহ’ নামে একটি গল্প লিখেছেন। গল্পটির কেন্দ্রীয় চরিত্র এতিম বালক হামিদ ও তার দাদি আমেনা। আমেনা ঈদের দিন খাবার কেনার জন্য হামিদকে ৩ পয়সা উপহার দেয়। কিন্তু হামিদ ওই ৩ পয়সা দিয়ে খাবারের পরিবর্তে একটি চিমটা সংগ্রহ করে। বাড়ি ফিরে আমেনার হাতে চিমটাটি তুলে দিতেই সে কান্নাজড়িত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, ‘ওরে ও হতভাগা, খাবারের জন্য এই কটা পয়সা দিয়েছি, কে তোকে চিমটা কিনতে বলল!’ হামিদ নমিত কণ্ঠে বলে, ‘রুটি সেঁকতে গিয়ে রোজ তোমার হাত পুড়ে যায়, চিমটা দিয়ে রুটি সেঁকলে আর হাত পুড়বে না, এ জন্যই তো এটা কিনে আনলাম।’

তবে কতিপয় ইতিহাসবিদের মতে, দশম শতাব্দীতে ফাতিমীয় খিলাফতের যুগে মিসরে সালামি প্রথার সূচনা ঘটে। এ সময় ঈদের দিন বড়রা ছোটদের হাতে কিছু পরিমাণ পয়সা তুলে দিতেন। এই প্রথা তখন ‘ঈদি’, ‘হাদিয়া’ প্রভৃতি নামে পরিচিত ছিল। ক্রমে অটোমান সাম্রাজ্য ও আরবেও ঈদি বিনিময়ের রীতি সম্প্রসারিত হয়। কেবল নগদ অর্থ নয়, রুচিভেদে কেউ কেউ নতুন কাপড়, মিষ্টিও ঈদির তালিকায় যুক্ত করেন।

বাংলায় ঈদ সালামি
এই ভূখণ্ডে ঈদ উৎসবের পরিসর খুবই সমাকীর্ণ। এর পেছনে রয়েছে দুটি কারণ: এক. গ্রামবাংলার মুসলমানরা ছিলেন দরিদ্র; দুই. মুসলমানের মধ্যে স্বতন্ত্র কমিউনিটির বোধ তখনো প্রবল হয়নি। ফলে ধর্মীয় উৎসবকে একটি সামাজিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করানো সহজ ছিল না। নবাব-বাদশাহরা ঈদ করতেন, তবে তা সীমিত ছিল অভিজাত উচ্চবিত্তের মধ্যে, উৎসব হিসেবে ঈদের তাৎপর্য জনসাধারণের নাগালের বাইরে ছিল। তবে উনিশ শতক ধরে চলা ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনের প্রভাবে গ্রামীণ ও নগরজীবনের উৎসবে নতুনত্বের ছোঁয়া লাগে। আর বিশ শতকের চতুর্থ দশক থেকেই ঈদ উৎসব সর্বব্যাপী ছড়িয়ে যেতে শুরু করে।

অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন তার বাংলাদেশের উৎসব (১৯৯৪) বইয়ে লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের ঈদ উৎসবের বয়স বড়জোর ৪০ থেকে ৫০ বছর। তিনি এটাও বলেছেন, ঢাকা, কলকাতা প্রভৃতি শহরে নাচ, গান ও মিছিলের সমন্বয়ে ঈদ উদ্‌যাপনের চিত্র পাওয়া গেলেও গ্রামবাংলার তেমন উল্লেখযোগ্য খবর পাওয়া যায় না।’

ঈদ উৎসবের আনন্দ সব সময় সবার কাছে সমান হয়ে আসে না। কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায় যেমনটা পাওয়া যায়, ‘জীবনে যাদের হররোজ রোজা ক্ষুধায় আসে না নিদ/ মুমূর্ষু সেই কৃষকের ঘরে এসেছে কি আজ ঈদ?’ অনেকের কাছে ঈদ ভালো খাওয়া, কাপড় পরা নয়, সালামি তো নয়ই। ফলে ঈদ উৎসবের মতো সালামিও সর্বাঙ্গীণ হয়ে উঠতে পারেনি। যেদিন বিত্তবণ্টনে সাম্যাবস্থা আসবে, সেদিনই ঈদ উৎসব যেমন সর্বাঙ্গীণ রূপ লাভ করবে, তেমন ঈদ সালামিতেও আসবে নতুন সমারোহ।

ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে সালামি
ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বলা হয়, ইসলামে উপহার আদান-প্রদানের ব্যাপারে উৎসাহিত করা হয়েছে; তবে সেটি কোনো শর্তযুক্ত হতে পারবে না। বিখ্যাত সাহাবি হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা একে অন্যকে উপহার দাও, এতে তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা সৃষ্টি হবে। (সূত্র: আল-আদাবুল মুফরাদ; হাদিস নং: ৫৯৪)

তবে কয়েকজন হাদিস বিশারদ এই হাদিসকে মানের দিক থেকে ‘হাসান’ বলেছেন।

’ঈদ সালামি’ প্রচলনের ইতিহাস নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে, মধ্যযুগের শুরুর দিকে ‘ঈদ সালামি’ প্রদানের সূচনা হয়। ফাতিমীয় খিলাফতের সময়ে সমাজের শিশু-কিশোর এবং বয়স্ক অধিবাসীদের অর্থ, মিষ্টান্ন জাতীয় খাবার, অথবা পোশাক উপহার দেওয়া শুরু হয়। পরে আনুষ্ঠানিকভাবে মামলুক সাম্রাজ্যের আমলে পোশাক-পরিচ্ছদ কেনার জন্য ঈদের সময় একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ নগদ অর্থ প্রদান করার প্রচলন ঘটে।

এই আর্থিক বরাদ্দের পরিমাণ ব্যক্তিভেদে আলাদা হতো এবং তা একজন ব্যক্তির সামাজিক মর্যাদা ও গুরুত্ব অনুযায়ী নির্ধারণ করা হতো। এরই ধারাবাহিকতায়, উসমানী সাম্রাজ্যের শেষ দিকে এসে এই প্রথা ব্যাপকভাবে পারিবারিক পরিসরে বিকশিত হয়। এই সময় থেকে পরিবারের মাতা-পিতা ও জ্যেষ্ঠ সদস্যদের কাছ থেকে শিশুদের নগদ অর্থ উপহার পাওয়ার প্রচলন সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। ইসলাম ধর্ম প্রসারের কারণে ক্রমান্বয়ে ‘ঈদ সালামি’ প্রদানের এই রীতি মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর পাশাপাশি একসময় ভারতীয় উপমহাদেশে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে এটি একটি সামাজিক রীতি, এবং ঐতিহ্যের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

শহর ছাড়িয়ে লোকালয়ে
ঈদ সালামি আর ঈদ উৎসব একই সূত্রে গাঁথা। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর যদিও একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে উঠেছিল, কিন্তু জাঁকজমকপূর্ণ ঈদ উৎসবের জন্য তা যথেষ্ট ছিল না। আশির দশক থেকে রপ্তানিমুখী পোশাকশিল্পের বিপুল বিস্তার ঘটে। বিদেশের শ্রমবাজারগুলোতে বাংলাদেশের মানুষজন কাজ করতে শুরু করেন। এসব কারণে গ্রাম ও শহরের মধ্যকার আর্থিক ব্যবধান ঘুচতে থাকে। এই আর্থিক সচ্ছলতার ভিত্তিতেই গত চার দশকে বাংলাদেশের ঈদ উৎসব যেমন ব্যাপকতা পেয়েছে, তেমনি সর্বজনীন হয়ে উঠেছে। পোশাকশিল্পে কাজ করা গ্রামের মেয়েটি ঈদের ছুটিতে বাড়ি যায় আপনজনদের জন্য হরেক রকমের উপহার নিয়ে। প্রবাসে থাকা ছেলেটিও বিপুল পরিমাণ অর্থ দেশে পাঠান প্রিয়জনদের সাড়ম্বরে ঈদ করার জন্য। এরাই খুশির আমেজে ঈদের দিন ছোটদের হাতে তুলে দেয় কড়কড়ে নতুন টাকা। আর এভাবেই সালামি শহর থেকে পৌঁছে গেছে লোকালয়ে, উচ্চশ্রেণি থেকে সাধারণ্যে।

ঈদ সালামির সংস্কৃতিতে পরিবর্তন
ঈদ উৎসব এখন বিচিত্র ও বহুমুখী উপাদানে সমৃদ্ধ। এতে যুক্ত হয়েছে বলিহারি বাণিজ্যিক ও পণ্যগত বিষয়। আর তাই ঈদ সালামিতেও লেগেছে নবায়নের ছটা। পোশাক, খাবার, অর্থের সীমানা পেরিয়ে ঈদ উপহারে যুক্ত হয়েছে গাড়ি, ফ্রিজ, স্মার্টফোন, আইফোন, ল্যাপটপ ও বই। ফেসবুকের পর্দায় ভেসে ওঠা ‘ঈদের চাঁদ আকাশে, সালামি দিন বিকাশে’, ‘ঈদের খুশি ঘরে ঘরে, সালামি দিন বিকাশ করে’ এসব বিজ্ঞাপনী স্লোগান জানান দেয়, ঈদ সালামি এখন ডিজিটাল ঈদ সালামিতে রূপান্তরিত হয়েছে। অনলাইন বই বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোও পাঠকদের টানতে ঈদের মৌসুমে বিশেষ ছাড়ে বই বিক্রির চেষ্টা করে। তাদের বিজ্ঞাপনেও শোভিত থাকে ‘সালামি হিসেবে বইয়ের তুলনা নেই’, ‘প্রিয়জনকে সালামি হিসেবে বই দিন’ প্রভৃতি।

এদিকে নিত্যপণ্যের বাজার চাঙা করতে ঈদ উপলক্ষে সালামিবিষয়ক স্মৃতি ও ঘটনা নিয়ে বিভিন্ন প্রতিযোগিতার খবরও পাওয়া যায়। এসব আয়োজনে বিজয়ীদের সালামি হিসেবে দেওয়া হয় মোটা অঙ্কের অর্থ, ভ্রমণের বিমান টিকিট, ফ্ল্যাট বাড়িসহ নানা রকম ঘরোয়া জিনিস। বলা বাহুল্য, বাণিজ্যিক স্বার্থ থাকলেও সালামি বিষয়টিকে জনপ্রিয়করণের পেছনে এসব বাণিজ্যিক প্রকল্পের জোরালো ভূমিকা রয়েছে।

অর্থ প্রদানের ক্ষেত্রে সালামির একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো সেই অর্থের পরিমাণ যা-ই হোক না কেন, সেটা চকচকে নতুন নোট হতে হবে। আর গ্রাহকদের এই চাহিদার কথা মাথায় রেখে, প্রতিবছর ঈদ উৎসবের সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নতুন নোট সরবরাহ করা হয়ে থাকে। এ ছাড়া অন্যান্য উপহার ক্রয়-বিক্রয়ের কারণে দেশের অর্থনীতির চাকা আরও গতিশীল হয়ে থাকে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সালামি প্রদানের রীতিতে নতুনত্ব যুক্ত হয়েছে। বর্তমানে যান্ত্রিকতার এই যুগে প্রযুক্তির কল্যাণে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ব্যাপক প্রসারের কারণে অনেকে দূরদূরান্তের প্রিয়জনকে সহজে সালামি দিতে পারেন।

‘ঈদ সালামি’ প্রদানের ক্ষেত্রে নগদ অর্থের পরিমাণ কোনো বিষয় নয়, বরং সবাই মিলে উৎসবে শামিল হওয়ার আনন্দই মুখ্য। বর্তমানে ‘ঈদ সালামি’ আদান-প্রদানের এই রীতি শুধু শিশুদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। তবে এই সময়ে এসে সালামি প্রদান খানিকটা আনুষ্ঠানিকতার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনকি এটি বিভিন্ন অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যেও ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করার একটি অন্যতম অনুষঙ্গে পরিণত হয়েছে।

বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রভাবে এই আনন্দ আয়োজনের ব্যাপকতা ধীরে ধীরে আরও বেশি প্রসারিত হচ্ছে। পারস্পরিক সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি আর ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সুদৃঢ় করার পাশাপাশি বিশেষ করে শিশুদের মাঝে উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে দিতে ঈদের সালামি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।