Image description
 

বিদ্যুৎখাতে লুটপাট, নানান অনিয়ম, দুর্নীতি, হত্যা মামলা— এরপরেও বহাল তবিয়তে আওয়ামী লীগ আমলে সুবিধাভোগী ব্যবসায়ী শিল্পগোষ্ঠী ইউনাইটেড গ্রুপের কর্তাব্যক্তিরা। ভুরি ভুরি অভিযোগ থাকার পরেও তাদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা এখনও নেওয়া হয়নি। বর্তমান সরকারের আমলেও দাপট কমছে না শিল্পগোষ্ঠীটির।

সম্প্রতি একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাজধানীর গুলশানের সেন্টার পয়েন্টে ইউনাইটেড গ্রুপের হেলমেট বাহিনীর হামলায় বেশ কয়েকজন গুরুতর আহত হন। এই ঘটনায় ইউনাইটেড গ্রুপের সিইওসহ বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তাছাড়া ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে ইউনাইটেড গ্রুপের চেয়ারম্যান, প্রধান উপদেষ্টা ও পরিচালকদের বিরুদ্ধে পাঁচটির মতো মামলা হয়েছে। এসব হত্যা মামলা এজহারনামীয় অন্যান্য আসামিরা গ্রেপ্তার হলেও অজ্ঞাত কারণে ধরাছোঁয়ার বাইরে ইউনাইটেড গ্রুপের কর্তাব্যক্তিরা।

অভিযোগ আছে, জুলাই আন্দোলন দমনে শেখ হাসিনা সরকারকে টাকা দিয়ে সহায়তা করেছিল ইউনাইটেড গ্রুপ। হাজার কোটি টাকা কর ফাঁকি ছাড়াও ইউনাইটেডের বিরুদ্ধে অর্থপাচারের তদন্তে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) এরই মধ্যে প্রাথমিক তথ্য পেয়েছে।

 
 

এদিকে ইউনাইটেড গ্রুপের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে ধারাবাহিকভাবে সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে। তবে কেউই তাদের রুখতে পারছে না।

সেন্টার পয়েন্টে হেলমেট বাহিনীর তাণ্ডব:

২৩ মার্চ রাতে গুলশানের সেন্টার পয়েন্টের নিচে সশস্ত্র সন্ত্রাসী হামলার শিকার হন এসএস বিল্ডার্স নামের একটি প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তারক্ষীরা। এতে বেশ কয়েকজন গুরুতর আহত হন। হামলার নেতৃত্বে দেন ইউনাইটেড গ্রুপের হেলমেট বাহিনীর প্রধান মো. আবিদ ও প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী (সিইও) শেখ ফারুক। ১০-১৫ জনের সন্ত্রাসী গ্রুপ হামলার সময় লোহার রড, রামদা ব্যবহার করে। তাদের পুলিশ ও প্রেস লেখা বুলেট প্রুফ জ্যাকেট পরিহিত দেখা গেছে এবং ঢাল ব্যবহার করেন। এসএস বিল্ডার্সের একজন কর্মকর্তা ঢাকাটাইমসকে বলেন, ক্রয় চুক্তি অনুযায়ী ইউনাইটেড গ্রুপ ওই ভবনের একটি ফ্লোর ২০১১ সালে আমাদের বুঝিয়ে দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তার প্রায় দশ বছর পর ২০২১ সালে আমাদের বুঝিয়ে দেয় (লিফটের ১৮ তলা)। এরপর আমরা তৃতীয় পক্ষকে অফিস হিসেবে ভাড়া দিয়েছিলাম। আওয়ামী লীগ সরকার পরিবর্তনের পর ওই ভাড়াটিয়া চলে গেলে নতুন করে একজনকে ভাড়া দেওয়া হয়। তারা ডেকোরেশনের কাজ শুরু করলে হঠাৎ ১৩ ফেব্রুয়ারি ১৮ তলার বিদ্যুৎ, পানি ও লিফট বন্ধ করে দেয় ইউনাইটেড। এই ঘটনার সূত্র ধরে ইউনাইটেডের ফারুক-আবিদের নেতৃত্বে তাদের হেলমেট বাহিনী তাণ্ডব চালায়।

 

বেপরোয়া ইউনাইটেড গ্রুপকে রুখবে কে?

 

আসামি গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে গুলশান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহমুদুর রহমান ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত কোনো আসামি গ্রেপ্তার হয়নি।’

গুলশান বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) তারেক মাহমুদ ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘দুইপক্ষ চাইছে আমাদের সঙ্গে বসে একটা সমাধান করতে। এখন পর্যন্ত কোনো আসামি গ্রেপ্তার হয়নি।’

সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীকে জমি ঘুষ

পতিত শেখ হাসিনা সরকারের সাবেক বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু, আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানি-এপিএসসিএলের তৎকালীন চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুরুল আলম মিলে ইউনাইটেডকে নানান অনিয়ম ও দুর্নীতির সুযোগ করে দেয়। যার নেপথ্যে থেকে সবাইকে সহায়তা করেন সাবেক মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদ। যিনি আওয়ামী লীগ আমলের বিদ্যুৎ খাত নিয়ন্ত্রণ করতেন। আওয়ামী লীগ আমলে বিদ্যুৎ খাতে মাফিয়া হয়ে উঠেছিল ইউনাইটেড গ্রুপ।

 

বেপরোয়া ইউনাইটেড গ্রুপকে রুখবে কে?

 

প্রতিমন্ত্রী বিপুকে ঘুষ হিসেবে রাজধানীর মাদানি অ্যাভিনিউর ১০০ ফিট সড়কের পাশে অবস্থিত ৮০ কাঠা জমি দেওয়া হয়। যার বর্তমান মূল্য দেড়শ কোটি টাকার বেশি।

জানা গেছে, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর ইউনাইটেড গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে ইউনাইটেড ইউনিভার্সিটি থেকে অনেককে নিয়ে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিভাগের বিভিন্ন কোম্পানিতে পরিচালক হিসাবে বসানো হয়।

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় অস্বীকৃতি:

আওয়ামী লীগ সরকারকে খুশি করতে গত বছরের ২১ জুন বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে চিকিৎসা সহায়তা না দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে ইউনাইটেড গ্রুপের প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড হাসপাতালের বিরুদ্ধে। ঘটনার দিন খালেদা জিয়ার জন্য ‘ইনজেকশন ও অ্যাম্বুলেন্স’ সহায়তার জন্য বারবার ফোন করা হয় হাসপাতালটিতে। কিন্তু কোনো সাড়া মেলে না তাদের পক্ষ থেকে। পরে খালেদা জিয়াকে নেওয়া হয় এভারকেয়ার হাসপাতালে। এই ঘটনা জানাজানি হলে তখন থেকে ইউনাইটেড হাসপাতালের ওপর ক্ষুব্ধ হন দলটির নেতা-কর্মীরা। এই ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বয়কটের পাশাপাশি বিচারও দাবি করেন তারা।

 

বেপরোয়া ইউনাইটেড গ্রুপকে রুখবে কে?

 

বিষয়টি নিয়ে বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সাবেক চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুক বলেন, ‘কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে অ্যাম্বুলেন্স, ইনজেকশন, ওষুধ চাইলে কোনো হাসপাতালের তা প্রত্যাখ্যান করা চরম অমানবিকতা ও নির্মমতার প্রকাশ। রাজনীতি অন্য বিষয়, কিন্তু মানবিক দিক থেকে তারা যে অবহেলার পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছে এটি ঠিক করেনি।’

সাবেক এই চিফ হুইপ বলেন, ‘একটা দেশের তিনবারের প্রধানমন্ত্রী, দুইবারের বিরোধীদলীয় নেত্রী ও বৃহত্তর রাজনৈতিক দলের চেয়ারপারসনকে তার অসুস্থতায় ওষুধপত্র ও অ্যাম্বুলেন্স দেওয়া হয়নি- এটা সবচেয়ে বড় মানবাধিকার লঙ্ঘন বলে আমি মনে করি। যারা এসব ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত ছিল, যারা অগণতান্ত্রিক কাজে সরকারকে সহায়তা করেছে, তাদের সবাইকে আইনের আওতায় আনা উচিত।’

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ‘ইউনাইটেড গ্রুপের এমন আচরণের পর থেকে আজ পর্যন্ত সেখানে কখনো চিকিৎসা নেয়নি; ভবিষ্যতেও কোনো দিন নেবো না।’

 

বেপরোয়া ইউনাইটেড গ্রুপকে রুখবে কে?

 

তিনি বলেন, ‘ইউনাইটেড গ্রুপ গত সরকারের আমলে নানাভাবে সুবিধাভোগী। তারা কৌশলে সরকারের পাওয়ার প্লান্ট কিনে নিয়েছে। ওই সরকারের নানা দুর্নীতির সঙ্গেও তারা জড়িত।’

খালেদা জিয়াকে বাড়ি থেকে বিদায়ে হাসান রাজার বিয়াই:

ক্যান্টনমেন্টের মইনুল রোডের বাড়ি থেকে বেগম খালেদা জিয়াকে বের করে দেওয়ার ঘটনায় সরাসরি জড়িত ছিলেন তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল আব্দুল মুবীন। এই মুবীন সম্পর্কে ইউনাইটেড গ্রুপের প্রধান উপদেষ্টা হাসান মাহমুদ রাজার বেয়াই। মুবীন পরে ইউনাইটেড গ্রুপের প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড পাওয়ারের চেয়ারম্যান হন। এই মুবীন আওয়ামী লীগ আমলে বিভিন্ন তদবির নিয়ে মন্ত্রণালয়ে ঘুরে বেড়াতেন। তার মাধ্যমেই নামমাত্র মূল্যে সরকারের কাছ থেকে বিদ্যুৎ কিনে গ্যাস ভিত্তিক দুটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু করে ইউনাইটেড। তাদের উৎপাদিত বিদ্যুৎ বাজারে বিক্রির অনুমতি না থাকলেও তা এখনও অব্যাহৃত রেখেছে।

 

বেপরোয়া ইউনাইটেড গ্রুপকে রুখবে কে?

 

তৎকালীন বিইআরসির সদস্য (গ্যাস) মকবুল ই-এলাহী চৌধুরী ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘কীভাবে ইউনাইটেড কমদামে গ্যাস পেল বুঝতে পারি না। তারা আমাদের কাছে আবেদন নিয়ে এলে আমরা তা নাকচ করে দেই। পরে রিভিউয়ের আবেদন করলে সেটাও নাকচ হয়ে যায়। এরপর উচ্চ আদালতে গেলে সেখানেও তাদের আবেদন খারিজ হয়ে যায়।’

মকবুল ই-এলাহী বলেন, ‘তাদের (ইউনেইটেড) প্রকল্পের হয়ে একজন লোক আমাদের কাছে তদবির নিয়ে এসেছিল। আমরা জানিয়ে দিই ভবিষ্যতে যেন তিনি এসব বিষয় নিয়ে আর না আসেন।’

এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘তখন বিভিন্ন অনৈতিক সুবিধা নিতে প্রায়ই কমিশনে আসতেন ইউনাইটেড পাওয়ারের বর্তমান চেয়ারম্যান সাবেক সেনা কর্মকর্তা আব্দুল মুবীন। তার সঙ্গে আরও কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা থাকতেন। তারা কমিশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের হুমকি-ধমকি দিতেন। কিন্তু তাদের চোখরাঙানি আর বন্দুকের নল উপেক্ষা করে কমিশন। এরপরও ইউনাইটেড পাওয়ার কীভাবে নিয়মবহির্ভূত সুবিধার অনুমতি পেল সেটা বর্তমান সরকারের বের করা উচিত।’

বিইআরসির তৎকালীন চেয়ারম্যান আব্দুল জলিল বলেন, ‘আইনগতভাবে ইউনাইটেডের ১৬ টাকায় গ্যাস পাওয়ার সুযোগ নেই। তারপরেও তারা কম মূল্যে গ্যাস নিচ্ছে, এটা বিস্ময়কর।’

জুলাই আন্দোলন দমনে পাঁচটি হত্যা মামলা:

গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর ইউনাইটেড গ্রুপের কর্ণধার হাসান মাহমুদ রাজা, চেয়ারম্যান ও এমডি মঈনউদ্দিন হাসান রশিদ ও গ্রুপের কর্মকর্তা কর্নেল (অব.) আফজালের বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলনে হত্যা মামলা হয়। আন্দোলনের সময় ঢাকার প্রগতি সরণিতে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত বাহাদুর হোসেন মনিরের বাবা আবু জাফরের করা মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে এই তিনজনও আসামি। তাদের বিরুদ্ধে আরও চারটি মামলা আছে।

 

বেপরোয়া ইউনাইটেড গ্রুপকে রুখবে কে?

 

অনুমতি ছাড়া ইউনাইটেডের গ্রুপের প্রধান কার্যালয় ও ইউনিভার্সিটি:

মাদানি এভিনিউয়ে ইউনাইটেড গ্রুপের প্রধান কার্যালয় ও ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ভবন নির্মাণে অনিমের অভিযোগও রয়েছে। ইউনাইটেড গ্রুপ এসব স্থাপনা গড়ে তোলায় অনুমোদন নেই রাজউকের। এ নিয়ে রাজউক থেকে বিভিন্ন সময় নকশা ও নথি চেয়ে একাধিকবার চিঠি দিলেও তা সরবরাহে গড়িমসি করে ইউনাইটেড।

 

বেপরোয়া ইউনাইটেড গ্রুপকে রুখবে কে?

 

হাজার কোটি কর ফাঁকি ইউনাইটেডের:

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর গোয়েন্দা বিভাগের অনুসন্ধান থেকে জানা গেছে, ১ হাজার ২৬০ কোটি টাকার কর ফাঁকি দিয়েছে শিল্পগ্রুপটি। এমনকি ব্যক্তি পর্যায়ে গ্রুপের কয়েকজন পরিচালক কর ফাঁকি দিয়েছেন ৪০ কোটি টাকা। তারা হলেন— মঈনুদ্দিন হাসান রশিদ, হাসান মাহমুদ রাজা, খন্দকার মঈনুল আহসান শামীম ও ফরিদুর রহমান খান।

 

বেপরোয়া ইউনাইটেড গ্রুপকে রুখবে কে?

 

হাসপাতালের বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ:

এই গ্রুপের ইউনাইটেড হাসপাতালের বিরুদ্ধেও নানা সময়ে চিকিৎসা অবহেলার অভিযোগ উঠেছে রোগীর স্বজনদের তরফে। সুন্নতে খতনা করাতে গিয়ে ইউনাইটেড হাসপাতালে মারা যায় শিশু আয়ান। শিশুটির বাবা শামিম আহমেদ ইউনাইটেড গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মঈন উদ্দিন হাসান রশিদ এবং সাবেক চেয়ারম্যান ও ইউনাইটেড মেডিকেল হাসপাতালের চেয়ারম্যান হাসান মাহমুদ রাজাসহ আটজনের বিরুদ্ধে ডিবিতে অভিযোগ করেন।

 

বেপরোয়া ইউনাইটেড গ্রুপকে রুখবে কে?

 

এছাড়া ২০২০ সালের ২৭ মে রাতে ইউনাইটেড হাসপাতালে আগুনে করোনা আইসোলেশন সেন্টারে পাঁচ রোগীর মৃত্যু হয়। এই ঘটনায় হওয়া মামলায় কর্তৃপক্ষের চরম অবহেলার অভিযোগ পায় পুলিশ। তবে এখনও পর্যন্ত মামলাটি বিচারিক আদালতে ওঠেনি।

(ঢাকাটাইমস