
এবারের ঈদযাত্রায় যানজটের সঙ্গে নতুন আতঙ্ক হিসেবে দেখা দিয়েছে ডাকাতি ও ছিনতাই। ঈদুল ফিতরের পাঁচ দিন আগেই ঘরমুখো মানুষ ছুটছে নাড়ির টানে। পুলিশের নানা উদ্যোগের কারণে সড়ক পথে যানজটের ভোগান্তি না থাকায় কিছুটা স্বস্তি রয়েছে। ঈদের আগের দুদিন মহাসড়কগুলোতে গাড়ির চাপে যানজট সৃষ্টি হয়ে ভোগান্তি হতে পারে বলে হাইওয়ে পুলিশ ও পরিবহন সংশ্লিষ্টদের ধারণা। এরই মধ্যে সারা দেশের মহাসড়কগুলোতে এ ধরনের অন্তত ১৩৭টি স্পট চিহ্নিত করে যানজটমুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। স্পটের সঙ্গে বেশকিছু মহাসড়কে ডাকাতি-ছিনতাইয়ের মতো অপরাধ হতে পারে বলেও শঙ্কা রয়েছে।
হাইওয়ে পুলিশের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সব শঙ্কা মাথায় রেখেই ঈদযাত্রা নির্বিঘ্ন করতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। হাইওয়ে পুলিশের কর্মকর্তাসহ সব সদস্য দিন-রাত সড়কে দায়িত্ব পালন করছেন। পাশাপাশি জেলা পুলিশ, র্যাব ও যৌথ বাহিনীর সদস্যরাও যানজট নিরসন ও মহাসড়কের নিরাপত্তায় দায়িত্ব পালন করছেন।
অবশ্য ঢাকা-চট্টগ্রাম রুট ও উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এবারের ঈদযাত্রায় এখনো বলার মতো যানজট নেই। তবে ঈদ শুরুর আগের দুদিন গাড়ির চাপ বাড়লে যানজট হতে পারে। গত কয়েক মাসে বেশ কয়েকটি ডাকাতির ঘটনায় তাদের এই শঙ্কাটা বাড়িয়েছে। গত সোমবার (২৪ মার্চ) রাত ৩টার দিকে বরগুনা-বরিশাল আঞ্চলিক মহাসড়কের গলাচিপা এলাকায় গাছ ফেলে বাসে ডাকাতি হয়েছে। ইমরান পরিবহনের বাসটি ঢাকার আবদুল্লাহপুর থেকে যাত্রী নিয়ে বরগুনার উদ্দেশে যাচ্ছিল। সেটি গলাচিপায় পৌঁছালে ডাকাতরা গাছ ফেলে আরও তিনটি বাসের গতিরোধ করে। যাত্রীদের নগদ অর্থ ও মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা।
হাইওয়ে পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি (এইচআর অ্যান্ড মিডিয়া) শামসুল আলম কালবেলাকে বলেন, নানা কারণেই মহাসড়কে যানজট হয়। এসব কারণ চিহ্নিত করে এবার অন্তত ১৩৭ পয়েন্ট চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব স্পটে যানজট নিরসনে কাজও শুরু হয়েছে। তিনি বলেন, ডাকাতি-ছিনতাই হয়, এমন স্পটের তালিকা হাইওয়ে পুলিশের কাছে নেই। তবে বিভিন্ন সময়ে এ ধরনের অপরাধ সংঘটিত হওয়া এলাকাগুলোয় নজরদারি বেশি থাকে। তবে ঈদকেন্দ্রিক দেশের সব মহাসড়কেই হাইওয়ে পুলিশ ছাড়াও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অন্যান্য সংস্থার নজরদারির মধ্যে রয়েছে।
পরিবহন মালিক-শ্রমিক ও হাইওয়ে পুলিশের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কয়েক মাস ধরে মূলত ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে ছিনতাই ও ডাকাতির ঘটনা ঘটছে। এর মধ্যে মেঘনা টোলপ্লাজা ও দাউদকান্দি পার হওয়ার পর মহাসড়কে এবং নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুর থেকে কুমিল্লার চান্দিনা পর্যন্ত মহাসড়কে ডাকাতির আশঙ্কা রয়ে গেছে। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের নরসিংদীর মাধবদীর পর থেকে সড়কটিও অনিরাপদ। এর বাইরে মধ্যরাত বা গভীর রাতে মহাসড়কে যাত্রী নামার পর তারা ছিনতাইকারীদের কবলে পড়ছেন। অনেকে আইনের আশ্রয় না নেওয়ায় তা পরিসংখ্যানের বাইরেই থেকে যাচ্ছে।
১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ দুই প্রবাসী আবু হানিফ ও রাজীব ভূঁইয়া ঢাকা থেকে কুমিল্লা যাওয়ার পথে বন্দর এলাকার কেওঢালায় ডাকাতির কবলে পড়েন। ডাকাতরা তাদের অর্থ ও মূল্যবান জিনিসপত্র লুট করে নেয়। সাম্প্রতিক ডাকাতির ঘটনাগুলোর মধ্যে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ভোরে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয় সাধু পেপার মিলের সামনে এক প্রবাসী ডাকাতের কবলে পড়েন। ডাকাতরা তার গাড়িতে হামলা চালিয়ে পাসপোর্টসহ ৫ লাখ টাকার মালপত্র লুট নেয়। গত ১৫ মার্চ দিনদুপুরে মহাসড়কের সোনারগাঁ দড়িকান্দি ব্রিজ সংলগ্ন এলাকায় ডিবি পুলিশ পরিচয়ে একদল ডাকাত একটি প্রতিষ্ঠানের মাইক্রোবাস আটক করে টাকা লুটে নেয়।
হাইওয়ে পুলিশের কর্মকর্তারা জানান, মহাসড়কের পাশে হাটবাজার, কম গতিসম্পন্ন নছিমন-করিমন ও ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা মহাসড়কে উঠে যাওয়া, লাইন-লেন মেনে গাড়ি না চালানো এবং বিভিন্ন মহাসড়কে চলমান উন্নয়নমূলক কাজের জন্য যাতায়াত পথ সংকুচিত হয়ে যানজটের সৃষ্টি হয়। তা ছাড়া ঈদকেন্দ্রিক যানবাহনের সংখ্যাও বেড়ে যায়। এসব কারণে যানজট হচ্ছে। মহাসড়কের কিছু নিরিবিলি এলাকায় বিভিন্ন সময়ে অপরাধ সংঘটিত হয়ে থাকে। গত কয়েক বছরে মহাসড়কে ডাকাতি হয়েছে, এমন স্পটগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব ডাকাতির সঙ্গে জড়িত অন্তত দেড় হাজার অপরাধীর তালিকাও তৈরি করা হয়েছে।
পরিবহন চালক-শ্রমিক ও হাইওয়ে পুলিশের সংশ্লিষ্ট অঞ্চলগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এবারের ঈদে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে দীর্ঘ যানজটের সম্ভাবনা নেই। তবে মহাসড়কটির ঢাকা থেকে বের হয়ে সাইনবোর্ড, শিমরাইল, মোগড়াপাড়া, মদনপুর ও মেঘনা টোলপ্লাজা এলাকায় যানজটের শঙ্কা রয়েছে। এই এলাকাগুলোতে সড়কের ওপর গাড়ি থামিয়ে যাত্রী ওঠা-নামা, টোল আদায়ে ধীরগতি, যত্রতত্র গাড়ি থামানো ও মহাসড়কে চলাচলে অনুমোদনহীন ছোট যানবাহনের অবাধ চলাচল ও অবৈধ স্ট্যান্ডের কারণে এই যানজট হতে পারে।
এ ছাড়াও ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের নারায়ণগঞ্জ অংশে অন্তত ৩৫ কিলোমিটারে উন্নয়ন কাজ চলছে। এতে কাঁচপুর সেতুর ঢাল থেকে কাঞ্চন পর্যন্ত প্রায় ৫০ কিলোমিটার সড়কে যানজট লেগে থাকে। এই সড়কের সঙ্গে সংযুক্ত এক লেনের এশিয়ান হাইওয়ে (ঢাকা বাইপাস) সড়কের মদনপুর থেকে গোলাকান্দাইল পর্যন্ত যানজটের শঙ্কা রয়েছে।
ওই রুটে চলাচলকারী সোহাগ পরিবহনের কর্মী আফজাল হোসেন কালবেলাকে বলেন, ‘ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে ঈদ ছাড়াও যানজট লেগে থাকে। ঈদে একসঙ্গে গাড়ির চাপ থাকায় এই যানজট ভোগান্তিতে রূপ নেবে।’
হাইওয়ে পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘সারা দেশের মহাসড়কগুলোতে অন্তত ১৩৯টি হাট-বাজার চিহ্নিত করা হয়েছে, যেগুলো যানজটের কারণ। মহাসড়ক থেকে এসব হাটবাজার অপসারণের জন্য সরকার বারবার উদ্যোগ নিলেও বাস্তবে তা সম্ভব হচ্ছে না। এ ছাড়াও ফিটনেসহীন গাড়ি চলাচল করতে গিয়ে তা সড়কে বিকল হয়েও ঈদকেন্দ্রিক যানজট হয়। এসব বিষয় মাথায় রেখে এবার নানা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
হাইওয়ে পুলিশের ডিআইজি (অপারেশন) শফিকুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, ‘সড়ক পথে ঈদযাত্রা নির্বিঘ্ন করতে হাইওয়ে পুলিশ আগে থেকেই জেলা পুলিশ, বিভিন্ন এলাকায় দায়িত্বরত যৌথ বাহিনীর কমান্ডার ও পরিবহন মালিক-শ্রমিকসহ অংশীজনের সঙ্গে সমন্বয় সভা করেছে। সবাই মিলে সড়কের যানজট নিরসন ও নিরাপদ করতে কাজ করছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘মহাসড়কে গত কয়েক বছর ধরে ডাকাতিসহ নানা অপরাধ করেছে, এমন পেশাদার অপরাধীদের তালিকা তৈরি করে তাদের ঠিকানা সংগ্রহ করেছে হাইওয়ে পুলিশ। সেই তালিকা অনুযায়ী তাদের নজরদারি করা হচ্ছে, যাতে কোনো ধরনের অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়াতে না পারে। তা ছাড়া মহাসড়কে অপরাধ বন্ধে নানা উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে।’
হাইওয়ে পুলিশের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ‘মহাসড়কের অপরাধপ্রবণ স্পটগুলোতে নিয়মিত চেকপোস্ট ছাড়াও টহল বাড়ানো হয়েছে। এজন্য জেলা পুলিশের সঙ্গে সমন্বয় করে হাইওয়ে পুলিশ দায়িত্ব পালন করছে। কোনো গাড়ি মহাসড়কে বিকল হলে তা দ্রুত অপসারণের ব্যবস্থা করা হয়েছে।’
এদিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সম্প্রতি সচিবালয়ে আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির সভায় ঈদযাত্রা নির্বিঘ্ন করতে বেশকিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই সভায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষার পাশাপাশি সড়কের শৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশ সদর দপ্তর এবং অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিয়ন্ত্রণকক্ষ স্থাপন করার সিদ্ধান্ত হয়। সব নিয়ন্ত্রণ কক্ষ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কেন্দ্রীয় জয়েন্ট অপারেশন সেন্টারের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করবে বলে নির্দেশনা দেওয়া হয়।
ওই সভা থেকে ঈদের সময় ট্রাফিক ও যানজট নিয়ন্ত্রণে যমুনা সেতু, পদ্মা সেতু এবং ফ্লাইওভারসহ টোল প্লাজাগুলোতে ইটিসিসহ দ্রুত টোল আদায়ে সংশ্লিষ্টদের কার্যকর ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়। জরুরি পণ্য পরিবহনকারী বা যাত্রীবাহী যানবাহন ছাড়া স্থলবন্দর ও নৌবন্দরসহ যে কোনো জায়গা থেকে নির্মাণসামগ্রী বহনকারী ও লম্বা যানবাহন ঈদের তিন দিন এবং পরের তিন দিন যেন মহাসড়কে চলাচল না করে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই না করা হয় ও অতিরিক্ত ভাড়া আদায় না করা হয় সে জন্যও সংশ্লিষ্ট বিভাগ, দপ্তর ও সংস্থাকে নির্দেশনা দেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা।