
স্বাধীনতা দিবসে সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর পর সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন অন্তর্বর্তী সরকারের যুব ও ক্রীড়া এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। সেখানে এক সাংবাদিক তাকে প্রশ্ন করেন, ‘চব্বিশ বড় নাকি একাত্তর বড়—আপনি কি মনে করেন?’ উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলেন, ‘এটা কোনো প্রশ্ন হলো!’ সাংবাদিকের সঙ্গে উপদেষ্টার কথোপকথনের একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। একই দিন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম, যিনি জুলাই আন্দোলনে নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করেছেন তার বক্তব্য ‘৭১ ও ২৪ আলাদা কিছু নয়’।
আজ বুধবার (২৬ মার্চ) স্বাধীনতা দিবসে দুই ছাত্রনেতার বক্তব্যের রেশ ধরে একাত্তর ও চব্বিশের তুলনামূলক আলোচনায় সরব হয়ে উঠেছেন নেটিজেনরা। বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকে নিজের মতো একাত্তর ও চব্বিশ নিয়ে উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। পক্ষে-বিপক্ষে অনেকে সরব হয়েছেন। জানিয়েছেন তাদের মতামত।
ঐতিহাসিক ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী শাসনের অবসান হয়। জুলাই আন্দোলনে সামনের সারি থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বকেরা। তাদের সঙ্গে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন বিভিন্ন রাজনীতি ও মতাদর্শের মানুষ। জুলাইয়ের সফল আন্দোলনের পর নতুন প্রজন্মের অনেকে একাত্তর ও চব্বিশকে পাশাপাশি রাখার চেষ্টা করেন। এরপর কেউ কেউ ‘চব্বিশ বড় নাকি একাত্তর’ বয়ানে মেতে উঠেছেন।
স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে একটি জাতীয় দৈনিকে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সেখানে তাকে প্রশ্ন করা হয়, ‘একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এবং চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানকে অনেকে মুখোমুখি দাঁড় করাতে চাইছেন। এ বিষয়ে বিএনপির অবস্থান কী?’
উত্তরে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘একাত্তর ও চব্বিশ সমান– এটি মূলত তারা বলেন, যারা ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ করেনি; উল্টো একাত্তরে হত্যাযজ্ঞে সহযোগিতা করেছেন। তাদের কেউ কেউ এখন গলা উঁচিয়ে বলার চেষ্টা করছে যে একাত্তরে কিছু হয়নি। কিছু কিছু দল বোঝানোর চেষ্টা করছে, মুক্তিযুদ্ধ কোনও ঘটনাই ছিল না। ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এই দেশের মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। হত্যা করেছে লাখো নিরীহ মানুষ। তারপর দীর্ঘ নয় মাস পাকিস্তান হানাদার বাহিনী বাঙালি গণহত্যায় মেতে উঠেছিল।’
জাতীয় স্মৃতিসৌধে শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর পর বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেছেন, ‘২৪-কে অনেকে দ্বিতীয় স্বাধীনতা বলে। আজকের স্বাধীনতা দিবস প্রমাণ করে, দ্বিতীয় স্বাধীনতা বলে বাংলাদেশে কিছু নেই। যারা বলে তারা আজকের স্বাধীনতা দিবসকে খাটো করতে চায়, ৭১ এর স্বাধীনতায় তাদের কোনো ভূমিকা ছিল না। সুতরাং এই দিনটাকে তারা খাটো করতে চায়।’
এর আগে সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাবে ৭১ ও ২৪ এক কাতারে আনায় আনুষ্ঠানিকভাবে আপত্তি জানিয়েছে বিএনপি। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবে ১৯৭১ ও ২০২৪কে এক কাতারে আনা হয়েছে, যা সমুচিত নয় বলে মনে করে বিএনপি। রাষ্ট্রের সাংবিধানিক নাম পরিবর্তন করার প্রয়োজন আছে বলেও মনে করে না দলটি। সর্বোপরি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ছাড়া সংবিধান সংশোধন কিংবা পরিবর্তন করা যাবে না জানিয়েছে দলটি।
স্বাধীনতা দিবসে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সব মানুষকে শুভেচ্ছা জানিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাসস দিয়েছেন কথাসাহিত্যিক জাকির তালুকদার। সেখানে তিনি লিখেছেন, দ্বিতীয় স্বাধীনতা বয়ানটি প্রতিষ্ঠার অপচেষ্টা চলছিল। জাতি সেটিকে ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছে। ৭১-কে ২৪ দিয়ে প্রতিস্থাপনের ষড়যন্ত্রও মুখ থুবড়ে পড়েছে। স্বাধীনতা দিবসে এটাই প্রাপ্তি।
সাংবাদিক ও অনলােইন অ্যাক্টিভিস্ট রাজীব আহাম্মদ স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ফেসবুকে মাতম চলছে, একাত্তর ও চব্বিশ নাকি সমান হয়ে গেছে। প্রশ্ন হলো, একাত্তর ও চব্বিশকে কী কেউ সমান বলেছেন? একাত্তরের চেয়ে চব্বিশ বড়—এ কথা কী কোনো বড় দল, রাজনীতিক, উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি বলেছেন? কেউ না বললেও মাতমকারীদের দাবি, মুখে না বললেও 'ওরা' মনেমনে একাত্তরের চেয়ে চব্বিশকে মহিমান্বিত ভাবে। মনের কথা জানার উপায় আছে কী না, জানি না। যুক্তির আলাপ হলো, 'ওদের' মনে যদি এ ভাবনা থাকে, তাহলে আপনার মনে আছে চব্বিশের প্রতি ঘৃণা, পরাজিত হওয়ার ক্রোধ। যারা একাত্তরের বিরোধী, তারা চব্বিশকে আঁকড়ে ধরেছেন। যারা চব্বিশের বিরোধী তারা একাত্তরকে আঁকড়ে টেকার চেষ্টা করছেন। দুই বিরোধীর হাতেই রক্ত। চব্বিশ একাত্তরের উত্তারাধিকার, পূর্ণতা। জুলাই গণহত্যকারী এবং এর সমর্থকরা দায়মুক্ত হতে চব্বিশকে একাত্তরের বিরোধী হিসেবে দেখাতে চায়।
সাংবাদিক ও কবি আহমেদ মুনীর স্ট্যাটাসে লিখেছেন, স্বাধীনতা আমাদের সব চেয়ে বড় অর্জন। দ্বিতীয় স্বাধীনতা বলে কিছু নেই।
অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ও প্রবাসী সাংবাদিক ইলিয়াস হোসাইন তার স্ট্যাটাসে লিখেছেন, অনেকেই দেখলাম ২৪ বড় নাকি ৭১ বড় এটা নিয়ে ফাইট শুরু করেছেন। আমি হিসেবটা মিলিয়ে দেখি। ৭১ বড় কারণ ওইটা ছিল বড় যুদ্ধ৷ ভারত-পাকিস্তানের মতো বড় ২ দেশের ৯ মাসব্যাপী যুদ্ধ। আর ২৪ ছিল আমাদের নিজস্ব যুদ্ধ, এটা আমাদের দেশের মানুষ নিজেরা যুদ্ধ করেছেন। ৭১-এ এদেশের মানুষের সর্বজনীন অংশগ্রহণ ছিল না। তবে ২৪-এ আওয়ামী লীগ মুক্ত করতে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। যে কারণে ছোট হলেও এটা আমাদের নিজস্ব প্রোডাক্ট তাই অনেক গর্বের৷
অন্যদিকে অনেকে স্ট্যাটাসে লিখেছেন, একাত্তরের গৌরবগাথার সঙ্গে আর কোনো আন্দোলন-অভ্যুত্থানকে এক কাতারে ফেলা অনুচিত। বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে একইসঙ্গে সবচেয়ে বড় অর্জন ও সবচেয়ে বড় ঘটনা হলো একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। একাত্তরের চেয়ে বড় অর্জন ও বড় ঘটনা এখন পর্যন্ত বাঙালির জীবনে আর ঘটেনি। একাত্তরের চেয়ে বড় তো দূরের কথা, কাছাকাছি গুরুত্বের কিছু ঘটেনি। আগামী হাজার বছরেও একাত্তরের চেয়ে বড় কিছু ঘটবে না।