
জাতীয় পরিচয়পত্রে (এনআইডি) থাকা নাগরিকের তথ্যভান্ডার ব্যবহার করে সাবেক এক সেনা কর্মকর্তা একাই হাতিয়ে নিয়েছেন প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। এই তথ্যভান্ডারের নিয়ন্ত্রক টাইগার আইটি হলেও প্রতিষ্ঠানটির নেপথ্যের নায়ক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও শেখ রেহানার দেবর মেজর জেনারেল (অব.) তারিক সিদ্দিক।
ইসির নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানিয়েছে, গত ১৫ বছর একটি মাফিয়াচক্রের মাধ্যমে অরক্ষিত অবস্থায় পরিচালিত হচ্ছে প্রায় সাড়ে ১২ কোটি নাগরিকের এনআইডি ডাটাবেজ। এই ডাটাবেজ ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-ও ব্যবহার করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। শেখ হাসিনার সম্মতিতে তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ও তারিক সিদ্দিক ডাটাবেজটি ‘র’-এর হাতে তুলে দেন।
নির্ভরযোগ্য সূত্র বলছে, ‘টাইগার আইটি’র কর্ণধার জিয়াউল আহসান। যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত এই জিয়াউলের সঙ্গে তারিক সিদ্দিকের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। তথ্যভান্ডারকে কাজে লাগিয়ে ঘুস হিসাবে তারিক সিদ্দিক কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে বিশ্বব্যাংকের তদন্তে উঠে এসেছে।
স্মার্টকার্ড প্রকল্পে দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে বিশ্বব্যাংক ২০১৯ সালে তারিক সিদ্দিকের নিয়ন্ত্রণাধীন টাইগার আইটিকে কালো তালিকাভুক্ত করে। ব্যাপক অভিযোগের পরও শেখ পরিবারের সঙ্গে সখ্য থাকায় টাইগার আইটি সবসময় ছিল ধরাছোঁয়ার বাইরে। অতীতে কোনো কর্মকর্তা তথ্যভান্ডারকে সুরক্ষিত করতে চাইলে তাকে পদ থেকে ত্বরিত সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা জানান, এনআইডির তথ্য যাচাইকারী সেবা প্রতিষ্ঠান ‘পরিচয় ডটকম’ অ্যাপের সঙ্গে হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের এবং টাইগার আইটির সঙ্গে তারিক সিদ্দিকের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। এ কারণে সফটওয়্যার উন্নয়নে কোনো কাজ করেনি ভেন্ডর প্রতিষ্ঠানটি। ফলে কয়েক কোটি নাগরিকের এনআইডি ডাটাবেজটি সবসময় ঝুঁকিতে আছে। সাবেক আইডিয়া প্রকল্পের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সালিম উদ্দীন খান যোগদান করে প্রথমে তথ্যভান্ডারের বিষয়ে খোঁজখবর নেন।
বিভিন্ন উৎস থেকে তিনি জানতে পারেন, তথ্যভান্ডারটি ঝুঁকিতে রয়েছে। বিষয়টি বুঝতে পেরে তিনি সার্ভারের সোর্স কোডসহ সার্বিক বিষয় ১৫ দিনের মধ্যে তাকে বুঝিয়ে দিতে টাইগার আইটিকে নিদের্শনা দিয়েছিলেন। এটা তারিক সিদ্দিকের ইগোতে লাগায় তাকে এক সপ্তাহের ব্যবধানে পদ থেকে সরিয়ে সেনানিবাসে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। এরপর টাইগার আইটি মহাক্ষমতাধর হয়ে ওঠে।
এ বিষয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এএমএম নাসির উদ্দিন আমার দেশকে বলেন, তথ্যভান্ডারটি ইসির অধীনে থাকা উচিত ছিল। কিন্তু ভাড়া করা প্রতিষ্ঠান এটা রক্ষণাবেক্ষণ করছে, যা আমাদের জন্য উদ্বেগের। এর নেপথ্যে বড় আর্থিক বাণিজ্য রয়েছে এবং কিছু অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে। আমরা সেগুলোও খতিয়ে দেখছি। তাদের কর্মকর্তাদের অদক্ষতার কারণে এই হযবরল অবস্থা বলেও তিনি জানান।
এ প্রসঙ্গে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান আমার দেশকে বলেন, কর্তৃত্ববাদী সরকার ক্ষমতায় থাকায় তাদের ইচ্ছায় সব প্রতিষ্ঠান চলেছে। তথ্যভান্ডার ইসির নিয়ন্ত্রণে না থাকাটাই দুঃখজনক। আর টাইগার আইটি একটি ভেন্ডর প্রতিষ্ঠান। তার সঙ্গে তারিক সিদ্দিকের জড়িত থাকা এবং ঘুস নেওয়ার বিষয়টি আপত্তিকর। ব্যক্তিকে সরাসরি টাকা দেওয়া যায় না। যদি টাইগার আইটির পরিচয়ে শেখ রেহানার আত্মীয়কে ঘুস দেওয়া হয়, তাহলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া যায়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সম্প্রতি ভোটার ডাটাবেজকে টাইগার আইটি থেকে পৃথক ও সুরক্ষিত রাখতে উদ্যোগ নিয়েছে ইসি। এ কাজে পরামর্শক নিয়োগ করা হয়েছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বুয়েট’ কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগকে (সিএসই)। তারা বিদ্যমান তথ্যভান্ডারটির ঝুঁকি নিরূপণ ও পরিচালনার সহজ উপায় বের করে ইসিকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে সুপারিশ করবে।
বুয়েটের সিএসই বিভাগের অধ্যাপক পরামর্শক টিমের প্রধান মনিরুল ইসলাম এ তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, ১২ কোটির বেশি নাগরিকের ভোটার তথ্যভান্ডারটি পৃথকীকরণসহ পাঁচটি ইস্যুতে আমরা কাজ করছি। মাত্র কাজ শুরু করেছি, আরো ১০ মাস সময় রয়েছে। কারিগরিসহ সবকিছুই পর্যালোচনা করছি। মেয়াদের মাঝ বরাবর কংক্রিট কিছু বলা সম্ভব হবে।
এনআইডি উইংয়ের ডিজি ও অতিরিক্ত সচিব এএসএম হুমায়ুন কবির বলেন, এনআইডির সার্ভারের পুরো নিয়ন্ত্রণ ভেন্ডর প্রতিষ্ঠান টাইগার আইটির হাতে। এত বিপুলসংখ্যক নাগরিকের তথ্যসমৃদ্ধ এই ডাটা সার্ভার যদি কলাপস করে, তাহলে আমাদের সর্বনাশ হয়ে যাবে। তাই বুয়েটকে নিয়োগ করা হয়েছে।
ডাটা হস্তান্তর প্রক্রিয়ার বিষয়ে ইসির আরেক কর্মকর্তা বলেন, আমরা টাইগার আইটির কাছ থেকে সবকিছু বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করছি। এজন্য বুয়েটকে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছে। তাদের কাজ হবে টাইগার আইটি কী দিচ্ছে এবং আমরা কী নিচ্ছি, ঠিকভাবে হচ্ছে কি নাÑ এ ব্যাপারে ইসিকে প্রয়োজনীয় টেকনিক্যাল সাপোর্ট দেওয়া।
এই কর্মকর্তা জানান, টাইগার আইটি থেকে তথ্যভান্ডারকে আলাদা করার জন্য ডিআরএস নামে স্বয়ংসম্পূর্ণ সাইট স্থাপন করা হবে। এটি পুরোপুরি চালু হলে টাইগার আইটি সফটওয়্যারের ওপর স্থাপন করা হবে, যাতে আমরা মুক্তি পাই।
এই কর্মকর্তা আক্ষেপ করে বলেন, তথ্যভান্ডারটি যখন টাইগার আইটি থেকে রিকভারির চেষ্টা করছি, ঠিক তখনই তথ্যভান্ডারটি ইসির অধীনে না রেখে অন্যত্র (সেনানিবাস) নেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে একটি পরামর্শক টিম নিয়োগ করে তাদের মাধ্যমে এটি বুঝে নেওয়ার জন্য পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
তথ্যভান্ডারটি পৃথকীকরণ হলে সামরিক বাহিনীর অধীনে স্থানান্তর হতে পারে- এমন তথ্যের বিষয়ে জানতে চাইলে আইডিয়া প্রকল্পের পিডি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ আজিজুর রহমান সিদ্দিক বলেন, বিশেষ একটি ইন্টারেস্ট থেকে এ ধরনের প্রোপাগান্ডা ছড়ানো হচ্ছে। বুয়েটের একটি পরামর্শক টিম কাজ করছে। সেখান থেকে প্রতিবেদন পাওয়ার পর ঠিক হবে টাইগার আইটির পর এটি কাদের হস্তগত হবে।
টাইগার আইটির হেড অব বিজনেজ রাশেদ সরওয়ার আমার দেশকে বলেন, এনআইডির তথ্যভান্ডারের কাজটি আমরা সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে পাই। সেই থেকে দীর্ঘদিন ধরে তাদের সেবা দিয়ে যাচ্ছি। রাষ্ট্রীয় তথ্য এখন তারা নিতে চাইছে, আমরাও দিতে প্রস্তুত। এর জন্য সময় লাগবে। তারিক সিদ্দিকের সঙ্গে টাইগার আইটির সম্পর্কের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটি রাজনৈতিক ইস্যু, তাই মন্তব্য করতে চাই না।’
সাবেক মেজর শেখ আবু মেহেদী হাসিনাচক্রের দুর্নীতির বিভিন্ন ফিরিস্তি ও তার কাজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন। আমার দেশকে তিনি বলেন, ভোটার ডাটাবেজের তথ্যভান্ডারের ভেন্ডর প্রতিষ্ঠান টাইগার আইটি। ভোটার নাগরিকের তথ্য সুরক্ষার জন্য তাদের সফটওয়্যার তৈরিতে বরাদ্দ রাখা হয় ৪৮ কোটি টাকা।
লক্ষ্য ছিল সাড়ে ৯ কোটি ভোটারকে স্মার্টকার্ড দেওয়ায়। কিন্তু সফটওয়্যার দুর্বলতার কারণে পুনরায় টেন্ডার হলে সেখানে বাজেট রাখা হয় ৪৬ কোটি টাকার বেশি। নতুন কেনা সফটওয়্যারটিও আগের মতো। ফলে ভোটার ডাটাবেজের অপব্যবহার বন্ধে পরামর্শক হিসেবে আমি ২০১৩ সালে চ্যালেঞ্জ করি।
সেখানে টেকনিক্যাল এক্সপার্ট হিসেবে ফাইবার নেটওয়ার্কটি কীভাবে কাজ করবে, সারা দেশের সার্ভার নেটওয়ার্কের সঙ্গে ম্যাচ করবে কি না কিংবা আইনের দিকগুলো খতিয়ে দেখি। বিদ্যমান টিজার আইটি প্রদত্ত অ্যাফিস সফটওয়্যারটি দিয়ে মাত্র দেড় কোটি ভোটার নাগরিকের তথ্য যাচাই করতে সক্ষম, যা এখনো বিদ্যমান। এ কারণেই ভোটার নাগরিকের তথ্যভান্ডারটি ঝুঁকিপূর্ণ।
তিনি বলেন, এরই মধ্যে আমার পরামর্শে সাবেক আইডিয়া প্রকল্পের ডিজি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সালিম আহমেদ খান যখন টাইগার আইটিকে তথ্যভান্ডারের কার্যক্রম দ্রুত বুঝিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন, তখন ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাকেসহ সবাইকে অন্যত্র সরিয়ে দেওয়া হয়।
তড়িঘড়ি টেন্ডার আহ্বান করা হয় এবং টাইগার আইটি ছাড়া কাউকে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হয়নি। নেপথ্যে মূল ভূমিকা রাখেন নন-আইটি পরামর্শক আবদুর রহিম খান (বিডিপি)। তিনি সাবেক আইডিয়া প্রকল্পের পিডি ও সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহাদাত হোসেন খানের আত্মীয়। মাস্টার কিং ও পাসওয়ার্ড সংগ্রহ করতেন আবদুর রহিম খান। সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ হতো তারিক সিদ্দিকের মাধ্যমে।
তিনি বলেন, আমার সঙ্গে যারাই আইডিয়া বা এনআইডিতে যান, সবাইকে ব্ল্যাক লিস্টেড করা হয়। একপর্যায়ে নতুন আইডিয়া প্রকল্পের পিডি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সুলতান মো. সালেহউদ্দীনের সঙ্গে সার্বিক বিষয়ে শেয়ার করি। পরবর্তীতে আমাকে সম্পূর্ণ ব্ল্যাক লিস্টেড করা হয়। আমাকে রীতিমতো ফিজিক্যালি থ্রেট করা হয়। একটা সময় পর ২০১৪ সালে অফিস থেকে আমাকে তুলে নেওয়া হয়।
সাবেক এই পরামর্শক আরো বলেন, ভেন্ডর প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম বিশ্বব্যাংকের নজরে এলে দেড় বছর তদন্ত করে সংস্থাটির ২০১৯ সালের রিপোর্টে দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে ১০ বছরের জন্য এটিকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়। এই টাইগার আইটির মূল মালিক ব্রিটিশ এমপি টিউলিপ সিদ্দিকের চাচা শেখ হাসিনার সাবেক সামরিক সচিব মেজর জেনারেল তারিক সিদ্দিক।
স্মার্টকার্ড প্রকল্পের ব্ল্যাককার্ড সরবরাহের জন্য ফ্রান্সের যে ওবারর্থু কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করা হয়, সেটিও ভুয়া। টাইগার আইটি বিভিন্ন সময় ২১ লাখ ৬০ হাজার ইউরো ব্যাংকিং মাধ্যমে লেনদেন করে। বিশ্বব্যাংকের তদন্তে উঠে আসে মোট লেনদেনের মধ্যে সাড়ে সাত লাখ ইউরো পরিশোধ হয় সরাসরি তারিক সিদ্দিকের অ্যাকাউন্টে, যা নথিতেও উল্লেখ আছে। সব মিলিয়ে ৪০০ কোটি টাকার মতো হাতিয়ে নিয়েছেন তারিক সিদ্দিক।
সাবেক মেজর শেখ আবু মেহেদী বলেন, এনআইডির তথ্যভান্ডারের যে মিরর কপি বিসিসিতে স্থানান্তর করা হয়, সেখানে নিয়োগ করা পাঁচ পরামর্শকই টাইগার আইটির। ইসির সঙ্গে ডাটা শেয়ারিংয়ে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি হয়েছে ১৮২টি সংস্থার সঙ্গে, যার মধ্যে বিবিসি একটি।
প্রায় ২০ কোটি টাকার তথ্য বিক্রি করেছে বিসিসি। তার চেয়ে ভয়ংকর খারাপ কাজটি হচ্ছে ভারতের ‘র’ এখনো এই ডাটা ব্যবহার করছে। ‘র’ যে ডাটা ব্যবহার করছে, তার প্রমাণ পেতে চাইলে যাদের এখানে নিয়োগ করা হয়েছে তাদের প্রত্যেকের বায়োডাটা অ্যানালাইসিস করলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে।