Image description

শেখ হাসিনার সরকার মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়কে গত ১৫ বছরে নিজেদের লোকদের জন্য ব্যবসা কেন্দ্রে পরিণত করেছিল। ‘স্বাধীনতার চেতনা’ নিয়ে চলে এই ব্যবসা। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে, মন্ত্রী ও সচিবদের ভুয়া সনদ দিয়ে এ ব্যবসা করেন তৎকালীন মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক।

বিএনপি এই মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করলেও আওয়ামী লীগ ব্যবসা করেছে পুরো সময়। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণার সব নথিপত্রও গায়েব করে দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের বিষয়ে অনুসন্ধানে এসব তথ্য জানা গেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেশে বর্তমানে বীর মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ২ লাখ ৮ হাজার ৫০ জন। এদের মধ্যে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা থাকতে পারেন, এমন আশঙ্কা থেকে যাচাই-বাছাইয়ের কাজ চলছে। ইতোমধ্যেই ছয় হাজারের মতো ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের মন্ত্রী ও ওই আমলের পাঁচ সচিবও রয়েছেন। আর একাত্তরের শিশু রয়েছেন দুই হাজার ১১১ জন।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান আর্মির পরিচালিত গণহত্যায় কতজন শহীদ হয়েছেন এমন কোনো তথ্য নেই মন্ত্রণালয়ে। শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে পাঁচ হাজারের কিছু বেশি শহীদের পরিবার ভাতার আওতায় এলেও প্রকৃতপক্ষে ৯ মাসের যুদ্ধে কতজন শহীদ হয়েছেন, এমন কোনো তথ্য কিংবা সুনির্দিষ্ট সংখ্যাও নেই সরকারের কোনো দপ্তরেই।

ফলে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত শহীদ নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষকরা। তবে হাসিনা সরকারের তৈরি করা রাজাকারের তালিকায় আওয়ামী লীগের নেতাসহ যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপুর নাম উঠে আসায় দেশ-বিদেশে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়।

মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকার ক্ষমতায় এসে ২০০২ সালে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠনের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদা বৃদ্ধি ও ভাতা প্রদানের উদ্যোগ নেয়। জাতীয় বাজেটে এ মন্ত্রণালয়ের জন্য পৃথক বরাদ্দ রেখে মুক্তিযোদ্ধাদের সুযোগ-সুবিধা প্রদানসহ মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণে বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে যায়। পতিত আওয়ামী লীগ সরকার গত সাড়ে ১৫ বছরে মুক্তিযোদ্ধাদের নামে ভুয়া সনদ দিয়ে মূলত ‘স্বাধীনতার চেতনা’ ব্যবসা করেছে বলে উল্লেখ করেন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ও মুক্তিযুদ্ধের গবেষকরা। এ সময়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়সহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তর থেকে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণার যাবতীয় তথ্য মুছে ফেলা হয় বলে জানান মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।

মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় গঠন করে বিএনপি, ব্যবসা করেছে আ.লীগ

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বিএনপি চার দলীয় জোট সরকার ২০০২ মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণ ও সুযোগ-সুবিধাসহ মর্যাদা নিশ্চিত করতে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় নামে একটি পৃথক মন্ত্রণালয় গঠন করে। মন্ত্রণালয়ে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ২ লাখ ৮ হাজার ৫০ জন হলেও মিথ্যা তথ্য দিয়ে ভুয়া সনদ গ্রহণসহ বিভিন্ন অভিযোগে বেশ কয়েকজনের ভাতা আটকে গেছে।

বর্তমানে এ মন্ত্রণালয় থেকে ভাতাপ্রাপ্ত মোট বীর মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ১ লাখ ৯৬ হাজার ৪৫৪ জন। এর মধ্যে বীরাঙ্গনা ৪৬৪ জন আর যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন ৫ হাজার ৮৯৫ জন। শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা ৫ হাজার ৩৩৩ জন ও খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা ৩৬৮ জন। শহীদ বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা ৫৬০ জন। সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা ৮৯ হাজার ২৩৫ জন।

কর্মকর্তাদের দাবি, ‘স্বাধীনতার ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’র নামে গত ১৫ বছরে এ মন্ত্রণালয়টিকে একটি দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করেছিল শেখ হাসিনার সরকার। এ সময়ে প্রায় ছয় হাজারের বেশি ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ দেওয়া হয় এ মন্ত্রণালয় থেকে। এর মধ্যে মুক্তিযুদ্ধকালে দুই হাজার ১১১ জনের বয়স ছিল তিন বছর থেকে ১২ বছরের মধ্যে। শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের কবর ও তাদের পরিবারকে ঘর নির্মাণ করে দেওয়ার নামে প্রকল্প নিয়েও বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করা হয়।

হাসিনা সরকারের আমলে সবচেয়ে বেশি কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটে বিদেশিদের ক্রেস্ট প্রদানকে কেন্দ্র করে। মুক্তিযুদ্ধে অবদান রেখেছেন এমন বিদেশি বন্ধু ও সংগঠনকে ২০১৪ সালে ক্রেস্ট ও সম্মাননা দেওয়া হয়। এর মধ্যে ছিলেন ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীসহ ৩৪০ জন বিদেশি নাগরিক।

তাদের এক ভরি সোনা ও ৩০ ভরি রুপার সংমিশ্রণে ক্রেস্ট দেওয়ার কথা বলে বিল তুলে নেওয়া হয়। তবে তাদের দেওয়া হয় তিন আনা সোনা ও ৩০ ভরি রুপার বদলে পিতল ও দস্তা দিয়ে তৈরি ক্রেস্ট। পরে বিএসটিআই’র পরীক্ষায় ক্রেস্ট নিয়ে ভয়াবহ জালিয়াতি ধরা পড়লেও এর সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে ক্রেস্ট জালিয়াতির দায়ে সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতা এবি তাজুল ইসলামকে অভিযুক্ত করা হয়।

হাসিনা সরকারকে ম্যানেজ করে মুক্তিযোদ্ধা সেজে সনদ নেন সাবেক স্বাস্থ্য সচিব নিয়াজ উদ্দিন মিয়া, পিএসসির সাবেক সচিব একেএম আমির হোসেন, প্রধানমন্ত্রীর (শেখ হাসিনা) কার্যালয়ের সাবেক সচিব মোল্লা ওয়াহিদুজ্জামানসহ ৪০ সরকারি কর্মকর্তা। মুক্তিযুদ্ধের ভুয়া সনদ নেওয়ায় তাদেরও দায়ী করে সংসদীয় স্থায়ী কমিটি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে। এ ঘটনায় কয়েকজন চাকরি হারান।

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে চেতনা ব্যবসা আর না

স্বাধীনতা আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে মূলত আওয়ামী লীগ সরকার গত সাড়ে ১৫ বছর ব্যবসা করেছে বলে মনে করেন মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। এ বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই আজম জানিয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধ ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে সব ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছি। বীর মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের কৃতী সন্তান। তাদের নিয়ে এমন ব্যবসা কোনোভাবেই কাম্য নয়। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সেজে যারা সনদ নিয়েছেন তাদের চিহ্নিত করা হচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।

ফারুক ই আজম বলেছেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের বয়স মন্ত্রণালয় থেকে ১২ বছর ৬ মাস নির্ধারণ করা আছে। এর চেয়ে কম বয়সি আছেন ২ হাজার ১১১ জন। এরা তালিকা থেকে বাদ যাবেন। এরই মধ্যে মন্ত্রণালয় থেকে অমুক্তিযোদ্ধা শনাক্তকরণে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্যাদি যাচাই-বাছাইয়ের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ ডাটাবেজ তৈরির কাজ এগিয়ে চলছে।’

তিনি আরো বলেন, অনেকেই মুক্তিযোদ্ধা না হয়েও তালিকাভুক্ত হয়েছেন এবং সব সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন। এটা জাতির সঙ্গে প্রতারণা। সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নিয়োগপ্রাপ্তদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রস্তুত করার জন্য সব মন্ত্রণালয় থেকে তথ্যাদি সংগ্রহ করা হচ্ছে। সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নিয়োগপ্রাপ্তদের সংগৃহীত তথ্যাদি যাচাই-বাছাইপূর্বক একটি পূর্ণাঙ্গ ডাটাবেজ তৈরি করা যাবে। আমাদের চেষ্টা থাকবে সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদা যেন ক্ষুণ্ণ না হয়।’

আ.লীগের করা রাজাকারের তালিকা নিয়ে চাঞ্চল্য

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখার একজন কর্মকর্তা আমার দেশকে জানান, ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় আসার পর রাজাকারের তালিকা প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়। এ নিয়ে জাতীয় সংসদের অধিবেশনেও প্রস্তাব পাস হয়। দীর্ঘ দশ বছর ধরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সারা দেশ থেকে রাজাকারদের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে।

২০১৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে রাজাকারের তালিকা প্রকাশ উপলক্ষে সরকার একটি সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। দেশ-বিদেশের বিপুলসংখ্যক সাংবাদিকের উপস্থিতিতে তৎকালীন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী আ. ক. ম. মোজাম্মেল হক দশ হাজার ৭৮৯ জন রাজাকারের তালিকা প্রকাশ করেন।

প্রকাশিত এ তালিকাটি গণমাধ্যমে দেওয়ার পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটেও প্রকাশ করা হয়। ব্যাপক ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রকাশিত এ তালিকায় বিএনপি কিংবা ইসলামপন্থি কোনো রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীর নাম ছিল না। সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়টি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রীর সামনে তুলে ধরে একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করেন। জবাবে মন্ত্রী বলেন, ‘তালিকাটি প্রকাশের আগে আমরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করেছি।

তাদের প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে রাজাকার হিসেবে যাদের নাম এসেছে এখানে শুধু তাদের নামই অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। রাজাকারের এ তালিকায় রাজাকারদের বিচারের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সরকার পক্ষের প্রধান আইনজীবী অ্যাডভোকেট গোলাম আরিফ টিপু এবং সাবেক সংসদ সদস্য ও নেতাসহ আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত অন্তত এক হাজার ব্যক্তির নাম ছিল। এ তালিকা প্রকাশের পর দেশ-বিদেশে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়।

ওই সময় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত রাজাকারের তালিকায় নিজের নাম অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় বিব্রতবোধ করেন গোলাম আরিফ টিপু। তালিকা থেকে নিজের নাম বাদ দেওয়ার জন্য তিনি আইন মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেন।

তালিকা প্রকাশের তিনদিন পর ১৮ ডিসেম্বর যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে একটি সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে বিব্রতবোধের কথা জানিয়ে অ্যাডভোকেট টিপু বলেন, ‘তালিকায় আমার নাম যুক্ত থাকায় আমি হতবাক, বিস্মিত, মর্মাহত ও অপমানিত। মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় সীমাহীন অযত্ন ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করে অত্যন্ত অবহেলার সঙ্গে এ তালিকা প্রচার-প্রকাশ করেছে। এ কারণে আমি তালিকা থেকে আমার নাম বাদ দেওয়ার জন্য তিনটি মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছি। আশা করছি, সরকার তালিকা থেকে আমার নাম বাদ দিবে।’

জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণার নথি উধাও

‘১৯৭১ সালের মার্চ মাসে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রথম প্রহরেই মেজর জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। ২৫ মার্চ মধ্যরাতে নিরস্ত্র জনগণের ওপর পাকিস্তানি বাহিনীর হামলায় প্রাণ হারায় অসংখ্য মানুষ। এই দুঃসময়ে জীবন বাজি রেখে প্রবল বিক্রমে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন মেজর জিয়াউর রহমান । চট্টগ্রামে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে তিনিই প্রথম ২৬ মার্চ রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ‘উই রিভোল্ট’ বলে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন।

এরপর কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তার স্বাধীনতার ঘোষণায় উদ্বেলিত জনগণ সাহসের সঙ্গে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন । জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা ২৬, ২৭ এবং ২৮ মার্চ কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রসহ দেশ-বিদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচার প্রচারিত হয়।’ এমন তথ্য ছিল মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নথিতে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র, তৃতীয় খণ্ডে জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণাটি বর্ণিত হয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধের ৩ নম্বর সেক্টর কমান্ডার (পরবর্তী সময়ে সেনাপ্রধান) কে এম সফিউল্লাহ (বীর উত্তম) তার [Bangladesh at War, Academic Publishers, Dhaka, 1989] বইয়ের ৪৪-৪৫ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘মেজর জিয়া ২৫ মার্চের রাত্রিতে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে সদলবলে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। তার কমান্ডিং অফিসার জানজুয়া ও অন্যদের প্রথমে গ্রেপ্তার এবং পরে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন।

পরে ২৬ মার্চ তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর মোকাবিলার জন্য সবাইকে আহ্বান জানান । এতে তিনি নিজেকে রাষ্ট্রপ্রধান রূপে ঘোষণা করেন । ২৭ মার্চ মেজর জিয়া স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে আরেকটি ঘোষণায় বলেন, ‘বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর সামরিক সর্বাধিনায়ক রূপে আমি মেজর জিয়া শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি।’

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নথি থেকে জিয়াউর রহমানের নাম মুছে দেওয়ার ঘটনাকে শেখ হাসিনার অতি নিম্নমানের নোংরা রাজনীতি হিসেবে দেখছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদ। আমার দেশকে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ এতদিন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিক্রি করে চলেছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার একমাত্র ‘বেপারি’ ছিল তারা। তারা ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সৃষ্টি করে তাদেরকে দিয়েই রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করেছে। আমাদের দাবি এখন একটি কমিশন গঠন করে এই ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সবকিছু বের করা।

আওয়ামী লীগ তার ফ্যাসিবাদী রাজনীতি প্রতিষ্ঠার জন্য যেখানে যা কিছু করার প্রয়োজন মনে করেছে সেটা করেছে। এর মধ্যে তাদের সব থেকে বড় টার্গেট ছিল মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। তারা শহীদ প্রেসিডেন্টের নাম-নিশানা যেখানে যেখানে আছে তা মুছে ফেলতে চেয়েছিল।

তবে ইতিহাসকে এভাবে মোছা যায় না। হয়তো কিছুদিনের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত করা যায়। এখন ইতিহাসকে সঠিক জায়গায় নিয়ে আসার জন্য আমাদের প্রচেষ্টা থাকতে হবে। নির্মোহ ও নির্দলীয়ভাবে আমাদের সেই চেষ্টা করতে হবে। যখনই যারা ইতিহাসকে নিজেদের মতো করে লেখার চেষ্টা করেছে তারা নিজেরাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, জাতিকেও ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। আমরা এখন এমন একটি পরিবেশ চাই যেখানে নতুন প্রজন্ম বাংলাদেশের প্রকৃত ইতিহাস জানতে পারবে।

মোজাম্মেল হকের ‘মুক্তিযোদ্ধা ব্যবসা’

২০১৪ সালের ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে গাজীপুর-১ আসন থেকে বিজয়ী হয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীর দায়িত্ব পান আ ক ম মোজাম্মেল হক। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতন ও পলায়নের আগ পর্যন্ত তিনি এ মন্ত্রণালয়ের টানা ১০ বছর সাত মাস মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।

পালিয়ে ভারতে গিয়ে শেখ হাসিনার আশ্রয় নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মোজাম্মেল হকও আত্মগোপনে চলে যান। মুক্তিযোদ্ধার ভুয়া সনদ দিয়ে বাণিজ্যের পাশাপাশি অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আবাসন প্রকল্প, মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক স্থানসমূহ সংরক্ষণ ও স্মৃতি জাদুঘর নির্মাণ প্রকল্প, ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতা স্তম্ভ নির্মাণ প্রকল্প, মুক্তিযুদ্ধকালে মিত্রবাহিনীর শহীদ সদস্যদের স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন প্রকল্প, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধার সমাধিস্থল সংরক্ষণ এবং উন্নয়ন প্রকল্প, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক গণহত্যার ব্যবহৃত বধ্যভূমি সংরক্ষণ ও স্মৃতিম্তম্ভ নির্মাণ প্রকল্প, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন প্রকল্প নেওয়া হয় মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় থেকে।

মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সাবেক মন্ত্রী মোজাম্মেল হকের বিশেষ আগ্রহে এসব প্রকল্প নেওয়া হয় এবং অর্থ ছাড় করা হয়। কিন্তু কোনো প্রকল্পই শেষ না করে এসব প্রকল্পের নামে ছাড় করা অর্থ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করেন মোজাম্মেল হক।

হ‍ুমায়ূন আহমেদের বর্ণনায় মোজাম্মেলের ধর্ষণ-হত্যার তথ্য

মোজাম্মেল এক নববধূকে ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় জড়িত ছিলেন বলে উল্লেখ করেছেন নন্দিত কথাসাহিত্যিক হ‍ুমায়ূন আহমেদ। তিনি তার রাজনৈতিক উপন্যাস ‘দেয়াল’র ৮৬ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন, ‘এক নবদম্পতি গাড়িতে করে যাচ্ছিল। দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী মোজাম্মেল দলবলসহ গাড়িটি আটক করে। গাড়ির ড্রাইভার ও নববিবাহিত তরুণীর স্বামীকে হত্যা করে। মেয়েটিকে সবাই মিলে ধর্ষণ করে। মেয়েটির রক্তাক্ত ডেডবডি তিনদিন পর টঙ্গি ব্রিজের নিচে পাওয়া যায়।’

হ‍ুমায়ূন আহমেদ আরো লিখেছেন, ‘মেজর নাসেরের হাতে মোজাম্মেল ধরা পড়ার পর মোজাম্মেল বলল, ঝামেলা না করে আমাকে ছেড়ে দিন। আমি আপনাকে তিন লাখ টাকা দেব। বিষয়টা সরকারি পর্যায়ে নেবেন না। স্বয়ং বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আমি ছাড়া পাব। আপনি পড়বেন বিপদে। আমি তুচ্ছ বিষয়ে বঙ্গবন্ধুকে জড়াতে চাই না। মেজর নাসের বললেন, এটা তুচ্ছ বিষয়? তার উত্তরে মোজাম্মেল জবাব না দিয়ে, উদাস চোখে তাকাল।

মেজর নাসের বললেন, আমি অবশ্যই তোমাকে ফাঁসিতে ঝোলাবার ব্যবস্থা করব। তোমার তিন লাখ টাকা তুমি তোমার গুহ্যদ্বারে ঢুকিয়ে রাখ! মোজাম্মেল বলল, দেখা যাক। এরপর মোজাম্মেল ছাড়া পেয়ে মেজর নাসেরকে তার বাসায় পাকা কাঁঠাল খাওয়ার নিমন্ত্রণ করেছিল।’

অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য নেওয়ার জন্য মোজাম্মেল হকের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে আমার দেশ। তিনি পলাতক থাকায় তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ব্যবসা বন্ধের কথা বলছেন গবেষকরা

মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ব্যবসা এবং বাণিজ্য বন্ধ করার কথা বলেছেন লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমেদ। আমার দেশকে তিনি বলেন, আমরা জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছি দেশকে হানাদারমু্ক্ত করার জন্য এবং দেশের মানুষের সার্বিক মু্ক্তির জন্য। মুক্তিযোদ্ধারা কোনো ভাড়াটে ছিলেন না।

গত ১৫ বছর এটি নিয়ে যেভাবে ব্যবসা হয়েছে, তা ছিল সত্যিকার অর্থে বেদনাদায়ক। এটি কাম্য ছিল না। টাকার বিনিময়ে হাজার হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সনদ দেওয়া হয়েছে। সরকারের সচিবসহ অনেক সরকারি কর্মকর্তাও ভুয়া মু্ক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়েছেন। এগুলো করে মুক্তিযুদ্ধ ও বীর মু্ক্তিযোদ্ধাদের সম্মান ক্ষুন্ন করা হয়েছে।