
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুধু একটি জাতির স্বাধীনতা আন্দোলন ছিল না, এটি ছিল দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় এক গভীর পরিবর্তনের সূচনা।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুধু একটি জাতির স্বাধীনতা আন্দোলন ছিল না, এটি ছিল দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় এক গভীর পরিবর্তনের সূচনা। এ যুদ্ধে ভারত গুরুত্বপূর্ণ ও বহুমাত্রিক ভূমিকা পালন করে। যুদ্ধের একেবারে প্রথমদিকে ভারত সরকার তাদের সহায়তাকে নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেনি, এমনকি সেই সময় অধিকাংশ বাঙালি ভারতের সহায়তাকে খুব গুরুত্বপূর্ণ বলেও মনে করেনি। কিন্তু যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হতে থাকলে ভিন্ন বাস্তবতা সামনে আসতে থাকে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভারতের ভূমিকা নিয়ন্ত্রণমূলক হয়ে উঠতে শুরু করে—তা নিয়ে বাঙালি নেতৃত্বের মধ্যে অসন্তোষও জন্ম নেয়। অনেকেই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। আওয়ামী লীগের একাংশ ভারতের অতিমাত্রায় নিয়ন্ত্রণ নিয়ে স্পষ্ট অসন্তোষ প্রকাশ করে। তখনকার বাস্তবতায় তারা তাৎক্ষণিক ভারতীয় দিকনির্দেশনা মেনে নিলেও ভবিষ্যতে স্বাধীন কৌশলের কথা ভাবতে থাকে। অনেক সময় মুক্তিবাহিনী ভারী অস্ত্রের অনুরোধ করলেও ভারতের পক্ষ থেকে তা প্রত্যাখ্যান করা হয়। এতে গেরিলাদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ জন্মে। কিছু ক্ষেত্রে ভারতীয় অনুমোদন ছাড়া কোনো বড় অভিযান চালানো সম্ভব না হওয়ায় সামরিক কমান্ডেও অসন্তোষ বাড়তে থাকে।
১৭ এপ্রিল ভারতে অবস্থিত অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার মেহেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী স্থান বৈদ্যনাথতলায় (পরবর্তী নাম মুজিবনগর) স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র অনুমোদন করে। একই সঙ্গে নতুন মন্ত্রিসভা শপথবাক্য পাঠ করে। ভারতীয় কর্তৃপক্ষের পরোক্ষ সমর্থন এ অনুষ্ঠানে স্পষ্ট ছিল। ভারতীয় সেনাবাহিনী সাংবাদিকদের পরিবহন ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে। এমনকি অনুষ্ঠানটির আগাম প্রচারণা চালান ভারতের জনসংযোগ কর্মকর্তারা। মঞ্চে ব্যবহার করা চেয়ার ও সাউন্ড সিস্টেমে ভারতীয় কোম্পানির লোগো ছিল। মঞ্চটি ঢাকা ছিল ভারতীয় সেনাবাহিনীর ক্যামোফ্লেজ ক্যানভাস দিয়ে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটি ট্রাকে করে আপ্যায়নের পানীয় ও খাবার আনা হয়, যার ডিভিশনাল মার্কিং কাদা দিয়ে ঘষে মিটিয়ে দেয়া হয়েছিল। পুরো অনুষ্ঠানে ভারতীয় সম্পৃক্ততা স্পষ্ট থাকলেও অনুষ্ঠান শেষে তারা প্রকাশ্য সমর্থনের বিষয়টি কিছুটা কমিয়ে আনে।
মার্চের শেষ থেকেই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের যোদ্ধাদের সামরিক সরঞ্জাম, প্রশিক্ষণ, রাজনৈতিক সমর্থন, কৌশলগত পরামর্শ, এমনকি সেনাসদস্য সরবরাহ করতে শুরু করে ভারত সরকার। এ ব্যাপক সহায়তার ফলে বাংলাদেশ আন্দোলনের ওপর ভারতের উল্লেখযোগ্য নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে ওই সময়েও বাংলাদেশের নেতারা ও নয়াদিল্লির মধ্যে উদ্ভূত কিছু মতপার্থক্যের কারণে এ নিয়ন্ত্রণে শিথিলতা আসার আশঙ্কা দেখা দেয়।
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা ঘটে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ। যখন পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সামরিক অভিযান শুরু করে। যুদ্ধের প্রথম কয়েক সপ্তাহে পশ্চিম পাকিস্তানি সেনারা মূলত ঢাকা ও কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ক্যান্টনমেন্টে সীমাবদ্ধ ছিল। ওই সময় বাঙালিদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ছিল যে খুব দ্রুত স্বাধীনতা অর্জন করা সম্ভব। অনেক ভারতীয় নীতিনির্ধারকেরও সে সময় একই প্রত্যাশা ছিল।
স্বাধীন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সরকার যেন ভারতের সদিচ্ছা নিয়ে কোনো সংশয়ে না পড়ে—এ কৌশলগত লক্ষ্য সামনে রেখে নয়াদিল্লি দ্রুত স্বাধীনতাকামী বাঙালিদের সহায়তায় এগিয়ে আসে। ২৮ মার্চের মধ্যেই ভারতীয় অস্ত্র বাঙালি মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বিতরণ শুরু হয়। তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর অনুমোদনে, এমনকি অনেকের মতে প্রত্যক্ষ নির্দেশেই এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হয়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে অভিযান শুরুর অব্যবহিত পরই মন্ত্রিসভার এক উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ৩০ মার্চ ইন্দিরা গান্ধী সংসদীয় নেতাদের জানান, ভারত বাঙালিদের অস্ত্র সরবরাহ করছে। এরপর ২ এপ্রিল ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে (বিএসএফ) নির্দেশ দেয়া হয়, তারা যেন বিদ্রোহী পূর্ব পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্যদের ‘সম্পূর্ণ সুরক্ষা ও সহায়তার’ আশ্বাস দেয়। পাকিস্তানি যুদ্ধবিমান চট্টগ্রামে রেডিও বাংলাদেশ ধ্বংস করার পর ভারতীয় কর্তৃপক্ষ একটি নতুন ট্রান্সমিটার সরবরাহ করে। মার্চের শেষ ও এপ্রিলের শুরুতে কয়েকজন ভারতীয় কর্মকর্তা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে প্রবেশ করেন। বলা হচ্ছিল তারা পরামর্শ দেয়ার জন্যই প্রবেশ করেছেন। প্রকৃতপক্ষে তারা সেখানকার পরিস্থিতি সম্পর্কে সঠিক ও প্রত্যক্ষ তথ্য সংগ্রহ করতেই প্রবেশ করেছিলেন বলে ধারণা করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে ভারত সরকার তাদের প্রদত্ত সহায়তাকে বাঙালিদের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার কোনো প্রচেষ্টা চালায়নি বলে মনে করা হয়। এক সংবাদকর্মীর ভাষ্যমতে, ‘যেসব বাঙালি সীমান্তে অস্ত্র চাইত, তাদের তা সরাসরি দেয়া হতো কোনো জটিলতা ছাড়াই।’ তবে ওই সময় ভারতীয় সহায়তার পরিমাণ ছিল সীমিত। স্বাধীনতার ব্যাপারে প্রবল আশাবাদী বাঙালিরা সম্ভবত সেই মুহূর্তে ভারতীয় সাহায্যকে অতটা গুরুত্বপূর্ণ বলেও মনে করেনি।
এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহ নাগাদ পরিস্থিতি স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে সুসংগঠিত না হওয়ায় ও সরঞ্জামের অভাবে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মুখোমুখি হতে পারছেন না মুক্তিযোদ্ধারা। পাকিস্তানি সেনাদের অগ্রগতির মুখে তাদের প্রতিরোধ ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ে। এ সময়ে সীমিত সম্পৃক্ততার নীতি বজায় রাখলেও দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতের ফলে মুক্তিযুদ্ধে বামপন্থী ও চরমপন্থীদের প্রভাব বাড়ার আশঙ্কায় ছিল নয়াদিল্লি। এ অবস্থায় ভারতের কৌশলগত সাড়া ছিল বাঙালি রাজনৈতিক মধ্যপন্থীদের লক্ষ্য করে সহায়তা দেয়া। সরাসরি হস্তক্ষেপের বিষয়টি তখন কিছুটা আলোচনায় এলেও শেষ পর্যন্ত ভারতের অবস্থান ছিল ‘সতর্কতা অবলম্বন’ করা।
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী ও ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিপুল ভোটে বিজয়ী আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব এপ্রিলের শুরুতে ছিল চরম বিশৃঙ্খল অবস্থায়। শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে বন্দি। অন্য নেতারা কেউ কেউ তখনো ভারতে প্রবেশের চেষ্টা করছিলেন, কেউবা এরই মধ্যে ভারতে অবস্থান করছিলেন। অনেকে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে জড়িয়ে পড়ছিলেন। তৎকালীন প্রেক্ষাপটে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ মনে করে, আন্দোলনে রাজনৈতিক দিকনির্দেশনা দেয়ার জন্য মধ্যপন্থী শক্তিকে উৎসাহিত করা জরুরি। আওয়ামী লীগ ছিল সে সময়ের সবচেয়ে যৌক্তিক ও গ্রহণযোগ্য বিকল্প। কারণ দলটির বহু নেতা তখন ভারতে অবস্থান করছিলেন। দৈনন্দিন চাহিদা পূরণ থেকে শুরু করে প্রায় সব ক্ষেত্রেই তারা নয়াদিল্লির রাজনৈতিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। এ বাস্তবতায় ভারত সরকারের সক্রিয় ভূমিকা ও নির্দেশনার মধ্য দিয়ে ১২ এপ্রিল আওয়ামী লীগের নেতারা একটি নির্বাসিত সরকার গঠন করেন, যা ১৭ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে মুজিবনগরে প্রকাশ করা হয়। বাংলাদেশ সরকারের প্রতি ভারতের কূটনৈতিক সহায়তা সক্রিয় থাকলেও তা ছিল সীমিত মাত্রায়। জনসম্মুখে ভারত সরকার তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের প্রতি সহানুভূতিশীল অবস্থান গ্রহণ করে। ভারতের অনুমতিতে দিল্লিতে ‘হাইকমিশন’ বা কূটনৈতিক মিশন চালু করা হয়, কিছু বাংলাদেশী কর্মকর্তা ভারতীয় নথিপত্র ব্যবহার করে ভ্রমণও করেন।
বাংলাদেশ ইস্যুতে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের উদ্দেশ্যে নয়াদিল্লি তাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে মস্কো থেকে ওয়াশিংটনসহ বিভিন্ন দেশে পাঠায়। তবে ভারত তখনো বাংলাদেশকে ডি জ্যুরে (আইনি স্বীকৃতি) দেয়নি। ভারত আশঙ্কা করেছিল ডি জ্যুরে দিলে পাকিস্তান সেটিকে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার কারণ (ক্যাসাস বেলি) হিসেবে বিবেচনা করতে পারে।
ভারত সরকার বাংলাদেশ আন্দোলনের রাজনৈতিক দিকনির্দেশনায় মধ্যপন্থী অবস্থান বজায় রাখার জন্য বাঙালি নেতাদের ওপর চাপ প্রয়োগ করে বলেই ধারণা করা হয়। পাশাপাশি বাংলাদেশের পক্ষ থেকে অন্যান্য দেশের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনের উদ্যোগেও ভারত প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিল বলে নানা সূত্রে ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে যখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতা ভাগাভাগিতে অনীহা প্রকাশ করছিল, তখন ভারত মনে করেছিল স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক ভিত্তি গঠন প্রয়োজন। যার ফলে অপেক্ষাকৃত কম চরমপন্থী দলগুলোকে নিয়ে একটি বাহিনী গঠনের সিদ্ধান্ত হয়।
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে জনগণের সঙ্গে নির্বাসিত সরকারের প্রধান যোগাযোগমাধ্যম হিসেবে কাজ করছিল রেডিও বাংলাদেশ। যদিও এটি বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের নামে পরিচালিত হতো, বাস্তবে এটির সম্প্রচার সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল ছিল অল ইন্ডিয়া রেডিওর প্রযুক্তি ও অবকাঠামোর ওপর। ভারতের সহায়তা ছাড়া রেডিও বাংলাদেশ টিকে থাকা প্রায় অসম্ভব ছিল বলেই মনে করা হয়। যদিও এর অনুষ্ঠানসূচিতে নয়াদিল্লির সরাসরি নিয়ন্ত্রণ রয়েছে কিনা তা নিশ্চিত বলা যায় না। তবে অধিকাংশ সময় এর প্রচারের বিষয়বস্তু ভারতীয় নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলেই লক্ষ করা গেছে। রেডিও বাংলাদেশে যুদ্ধকালে বাঙালি জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভারতের অবস্থানও তুলে ধরা হয়েছিল।
যুদ্ধের শুরুর দিকে কোনো দেশ বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়নি। আন্তর্জাতিক পরিসরে গেরিলা যোদ্ধাদের জন্য উল্লেখযোগ্য সমর্থনও আদায় করতে পারেনি অস্থায়ী সরকার। এছাড়া তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ জনগণ ও যারা প্রত্যক্ষ যুদ্ধ করছিলেন তাদের সঙ্গে অস্থায়ী সরকারের দূরত্ব ক্রমেই বাড়তে থাকে। এ বিচ্ছিন্নতা ও ভারতীয় প্রভাবের ফলে রাজনীতিবিদদের ভূমিকা অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়তে শুরু করে।
আওয়ামী লীগের কিছু নেতা যারা আগে শুধু পশ্চিম পাকিস্তানি শাসনের অবসানেই মনোযোগী ছিলেন তারা স্বাধীন বাংলাদেশের ওপর ভারতের অতিমাত্রায় নিয়ন্ত্রণ নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করতে শুরু করেন। রাজনৈতিকভাবে টিকে থাকা ও ভারতের ওপর থেকে কিছুটা হলেও স্বাধীনতা বজায় রাখার জন্য ভবিষ্যতে এ বাঙালি রাজনীতিবিদরা নয়াদিল্লির সহায়তা ও দিকনির্দেশনা থেকে সরে এসে নিজেদের কৌশলে এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন এমন আশঙ্কা দেখা দেয়। তবে বেশির ভাগ নেতা আপৎকালীন ভারতীয় দিকনির্দেশনায় পরিচালিত হতে সরাসরি আপত্তি তোলেননি।
১৯৭১ সালের এপ্রিলের শুরুতে মুক্তিযোদ্ধাদের পশ্চাদপসরণ দেখে নয়াদিল্লি দীর্ঘমেয়াদি গেরিলা যুদ্ধের পরিকল্পনা শুরু করে। ওই মাসের শেষ নাগাদ ভারতে বাঙালি গেরিলাদের প্রশিক্ষণের জন্য কয়েকটি ক্যাম্প চালু করা হয়। বিএসএফ সদস্যরা মুক্তিযোদ্ধাদের পরামর্শ দিতে ও তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে প্রবেশ করে। মুক্তিবাহিনীকে অস্ত্র সরবরাহ আরো সুসংগঠিতভাবে করা হয়।
ভারত ব্যাপক সহায়তা দিলেও গেরিলা যোদ্ধাদের এমন কোনো পদক্ষেপ নিতে অনুমতি দেয়া হয়নি, যা ভারত-পাকিস্তান সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি করতে পারে। মে মাসের শেষদিকে, যখন গেরিলা যুদ্ধ প্রকৃত অর্থেই শুরু হয়, তখন মুক্তি ফৌজের অনেক সদস্য ভারতীয় নিয়ন্ত্রণ নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করতে শুরু করেন। সংঘাত শুরুর পর পূর্ব পাকিস্তান পুলিশ, আধা সামরিক ইপিআর (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস) এবং নিয়মিত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের পালিয়ে আসা সদস্যরা মুক্তিযোদ্ধাদের মূল কাঠামো গড়ে তোলেন। প্রায় ১০ হাজার সশস্ত্র যোদ্ধা তাদের সঙ্গে নিয়ে আসা অস্ত্র ছাড়াও পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কাছ থেকে অস্ত্র দখল করে। এছাড়া তারা বেসামরিক মালিকানাধীন অস্ত্রও সংগ্রহ করে। এপ্রিলে প্রতিরোধ ভেঙে পড়ার সময় এসব অস্ত্রের একটি অংশ সম্ভবত হারিয়ে যায়। তবে মুক্তিযুদ্ধের ওই মূল চালিকাশক্তি তাদের প্রাথমিক অস্ত্রেই সজ্জিত বলে জানা যায়।
সংখ্যা ও সামরিক সক্ষমতা বাড়াতে মুক্তিযোদ্ধাদের তখন সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করতে হচ্ছে নয়াদিল্লি থেকে পাওয়া অস্ত্রের ওপর। পক্ষান্তরে জানা যায়, এরই মধ্যে ১০ হাজার বা তারও বেশি নতুন প্রশিক্ষিত গেরিলা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে প্রবেশ করেছে। এ সংখ্যা এমনকি ৫০ হাজার পর্যন্ত পৌঁছতে পারে। তখন ভারতও কয়েক হাজার রাইফেল সরবরাহ করেছিল। এমনকি আরো অস্ত্র সরবরাহের পরিকল্পনা করছিল। পাশাপাশি মেশিনগান ও হালকা মর্টারের মতো কিছু ভারী অস্ত্র দিচ্ছিল।
তবে কামান, ট্যাংক ও যুদ্ধবিমান সরবরাহের জন্য মুক্তিবাহিনীর পক্ষ থেকে করা অনুরোধ ভারত সরকার প্রত্যাখ্যান করে। মুক্তিযোদ্ধাদের দাবি ছিল, ভারত এ ধরনের ভারী অস্ত্র দিলে তারা পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সহজেই পরাস্ত করতে পারবে। তবে ভারতের যুক্তি, ‘এমন অভিযানের জন্য উপযুক্ত সময় আসেনি।’ নয়াদিল্লির কর্মকর্তারা মনে করেন মুক্তিবাহিনী এখনো এমন একটি পূর্ণাঙ্গ সামরিক অভিযানের জন্য প্রস্তুত নয়। পাশাপাশি ভারত এটিও চায়নি যে তাদের সরবরাহ করা অস্ত্র ও প্রশিক্ষণের ওপর নির্ভরশীল একটি বড় আকারের আক্রমণ একেবারে প্রকাশ্যে শুরু হোক। এটাকে পাকিস্তান সরাসরি ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার কারণ (ক্যাসাস বেলি) হিসেবে বিবেচনা করতে পারে।
অস্ত্র সরবরাহ সীমিত রাখার মাধ্যমে ভারত কৌশলে মুক্তিবাহিনীকে পর্যাপ্ত জনবল দেয়া নিয়ন্ত্রণে রেখেছিল। যাতে তারা বড় আকারে আক্রমণে যেতে না পারে। যদিও প্রশিক্ষণ শিবিরে থাকা যোদ্ধারা মুক্তিবাহিনীর নির্দেশে ভারতের আপত্তি সত্ত্বেও পূর্ব পাকিস্তানে প্রবেশ করতে পারত। কিন্তু অস্ত্র ছাড়া সে সম্ভাবনা ছিল খুবই ক্ষীণ। গোলাবারুদ ও অন্যান্য ভোগ্যসামগ্রীর ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখে ভারত কার্যত মুক্তিবাহিনীর যেকোনো বড় ধরনের আক্রমণ ঠেকাতে সক্ষম হয়েছিল। এ নিয়ন্ত্রণের ফলে সীমান্ত পেরিয়ে পরিচালিত প্রতিদিনের অভিযানের ওপরও ভারতের প্রভাব স্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হয়। নয়াদিল্লি থেকে স্পষ্ট নির্দেশনা ছিল, ‘শুধু অনুমোদিত মিশনের জন্যই গোলাবারুদ সরবরাহ করা হবে।’ সীমান্ত পেরিয়ে পরিচালিত অভিযানে ভারতীয় গোলাবারুদের সহায়তা নয়াদিল্লিকে একটি কার্যকর কৌশলগত নিয়ন্ত্রণের সুযোগ করে দেয়। এসব অভিযানে অংশ নেয়া মুক্তিযোদ্ধাদের অনেক সময় পশ্চিম পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে ভারতীয় কামান থেকে গোলাবর্ষণের মাধ্যমে সুরক্ষা দেয়া হতো। সীমান্ত বরাবর ভারতীয় বাহিনীর অবস্থানও পাকিস্তানি সেনাদের ‘হট পারস্যুট’ অভিযান চালাতে নিরুৎসাহিত করে।
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরে স্থায়ীভাবে কর্মরত ইউনিটগুলোর ওপর ভারতের নিয়ন্ত্রণ ততটা শক্তিশালী ছিল না। কিছু মুক্তিবাহিনী ইউনিটকে ভারতের কাছ থেকে শুধু সাধারণ নির্দেশনা ও ন্যূনতম সরবরাহ দেয়া হতো। তবে এ ইউনিটগুলো ভারতকে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে ফেলার মতো অবস্থানে ছিল না। মুক্তিবাহিনীর ওপর ভারতের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে সহায়তা করেন তাদের নিযুক্ত সামরিক উপদেষ্টারা। একটি নির্দিষ্ট সীমান্ত সেক্টরে মুক্তিবাহিনীর প্রায় অর্ধেক অভিযানে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর বাঙালি, অসমিয়া ও নেপালি সদস্যদের ব্যবহার করা হতো। এমন অভিযানে নেতৃত্ব দিতেন স্থানীয় বিএসএফ ব্যাটালিয়নের কমান্ডিং কর্নেল। পাকিস্তান সরকারও দাবি করে আসছিল যে প্রায় সব সীমান্ত অভিযানে ভারতীয় অনুপ্রবেশকারীরাই অংশ নিচ্ছে। যদিও এসব দাবির অনেকাংশই অতিরঞ্জিত বলে মনে করা হয়। তবুও ইসলামাবাদ কিছু অভিযোগের সপক্ষে প্রমাণ হাজির করতে সক্ষম হয়, যার মধ্যে রয়েছে যুদ্ধবন্দিদের উপস্থাপন করা।
মুক্তিবাহিনী বা বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের কর্তৃত্ব স্বীকার করে না—এমন বেশ কয়েকটি বামপন্থী গেরিলা ইউনিট ভারতের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থেকে মুক্তিযুদ্ধ করেছিল বলেও ধারণা করা হয়। এসব গোষ্ঠীর অধিকাংশই চরমপন্থী বামপন্থী আদর্শে বিশ্বাসী। অস্ত্র ও গোলাবারুদের জন্য তারা নির্ভর করত শত্রুপক্ষের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া অস্ত্রের ওপর। এছাড়া তারা সাধারণ মানুষের সহায়তাও পেত। ভারতীয় কমিউনিস্টদের কাছ থেকেও অস্ত্র সহায়তা পেত তারা, যদিও তা ছিল সীমিত। এ ধরনের সবচেয়ে সফল গোষ্ঠী হচ্ছে নকশালপন্থীরা, যারা মাওবাদী বিপ্লবের পক্ষে। তবে তারা বাইরে থেকে কোনো সহায়তা পায়নি বলেই মনে করা হয়। ভারতীয় কর্মকর্তাদের অনেকের আশঙ্কা ছিল নয়াদিল্লি যদি মুক্তিবাহিনীর কার্যক্রমে সীমাবদ্ধতা আরোপ করে চলতে থাকে, তবে ভবিষ্যতে এ বামপন্থী গোষ্ঠীগুলো স্বাধীনতা যুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ অংশে পরিণত হতে পারে।
মুক্তিযুদ্ধের ওই সময়ে ভারত সবসময় বাঙালিদের প্রত্যাশা পূরণ করতে না পারলেও এবং দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের মধ্যে টানাপড়েন বেড়ে চললেও বাংলাদেশের নেতারা তাৎক্ষণিক নয়াদিল্লির নিয়ন্ত্রণ থেকে স্বাধীনভাবে কোনো বড় উদ্যোগ নেয়ার পথে হাঁটেননি। নির্বাসিত সরকার ও মুক্তিবাহিনী—দুই পক্ষই প্রায় সম্পূর্ণভাবে ভারতের সহায়তার ওপর নির্ভরশীল ছিল। এ অবস্থায় তারা কেউই ভারতের সমর্থন হারানোর ঝুঁকি নিতে চাননি। যদিও ভারতীয় সহায়তা ও নিয়ন্ত্রণ ছাড়া ছোট পরিসরে গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনার সক্ষমতা দেখিয়েছিল বামপন্থী গেরিলা গোষ্ঠীগুলো। একসময় ভারতে অবস্থানরত বাংলাদেশী রাজনীতিবিদদের মধ্যেও ধীরে ধীরে একটি প্রবণতা দেখা যাচ্ছিল—তারা অনেক ক্ষেত্রে ভারতের পূর্বানুমোদন ছাড়াই সিদ্ধান্ত নেয়ার দিকে এগোচ্ছিলেন। ফলে পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছিল—ওই সময়ে এ ধারা অব্যাহত থাকলে দুটি সম্ভাবনা সামনে আসত, হয় তারা ভারতের প্রভাব থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসবেন, না হয় আরো স্বাধীনচেতা—এবং সম্ভবত আরো বামঘেঁষা রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছে প্রভাব হারাবেন।
[মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক নিয়ে ‘ইন্ডিয়াস রিলেশনস উইথ বাংলাদেশ’ শীর্ষক ইন্টেলিজেন্স মেমোরেন্ডামের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি]