
গত ছয় মাসে চট্টগ্রামে বন্ধ হয়েছে ছোট-বড় অন্তত ৫২ পোশাক কারখানা। একই সময়ে কাজের আদেশ কমেছে প্রায় ২৫ শতাংশ। এতে করে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন বেশ কয়েক হাজার শ্রমিক।
এ দিকে, আসন্ন ঈদের আগে শ্রমিকদের বেতনভাতা দেওয়া নিয়ে আশঙ্কায় আছে জেলার অন্তত ৪৪ কারখানা। এগুলোকে 'ঝুঁকিপূর্ণ' প্রতিষ্ঠানের তালিকায় রেখেছে শিল্প পুলিশ।
তবে এসব প্রতিষ্ঠানকে 'ঝুঁকিপূর্ণ' বলতে নারাজ বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ)। সংস্থাটির তথ্য বলছে—চট্টগ্রামে নিবন্ধিত পোশাক কারখানা ৬১১টি। চালু আছে ৩৫০টি। দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ ২৬১ কারখানা। চালু থাকা ৩৫০ কারখানার মধ্যে ১৮০টি বিদেশি ক্রয়াদেশ নিয়ে কাজ করছে। বাকিগুলো সাব-কন্ট্রাক্ট নিয়ে কাজ করছে। এর মধ্যে অনেকগুলো বন্ধ আছে বা কার্যক্রম সীমিত করে ফেলেছে।
চট্টগ্রাম শিল্প পুলিশ-৩ এর পরিসংখ্যান অনুসারে—চট্টগ্রামে বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, বিটিএমইসহ কয়েকটি সংস্থার মোট পোশাক কারখানার সংখ্যা ৫৮০টি। চালু আছে ৫২৮টি। কার্যাদেশ না থাকায় বন্ধ হয়ে গেছে ৫২ কারখানা। গত ছয় মাসে এসব প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএ চট্টগ্রামের সাবেক সহসভাপতি রাকিবুল আলম চৌধুরী দ্য ডেইলি স্টারেক বলেন, 'কার্যাদেশ কমে যাওয়ার পাশাপাশি রাজনৈতিক ও ব্যাংকিং জটিলতার কারণেও কারখানা বন্ধ হয়েছে। এসব কারখানার অধিকাংশ নন-বন্ডেড প্রতিষ্ঠান।'
তিনি আরও বলেন, 'শিল্প পুলিশ কর্তৃপক্ষ চট্টগ্রামের বেশ কয়েকটি পোশাক কারখানাকে ঝুঁকিপূর্ণ বললেও আমরা তা মনে করি না। কোনো কারখানার মালিক ইচ্ছা করে শ্রমিকদের বেতনভাতা বন্ধ রাখেন না। এখনো সময় আছে বেতনভাতা দেওয়ার। মালিকরা ২৫ মার্চের মধ্যে ঈদের বোনাস ও ২৮ মার্চের মধ্যে বেতন দেওয়ার চেষ্টা করছেন। বিজিএমইএ বিষয়টি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।'
ঈদে শ্রমিকদের বেতনভাতা দিতে পারবে কিনা তা নিয়ে ৪৪ কারখানা আশঙ্কা করছে। শিল্প পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, এসব প্রতিষ্ঠানে অতীতেও বেতনভাতা নিয়ে আন্দোলন হয়েছিল।
শিল্প পুলিশের ভাষ্য—কালুরঘাট বিসিক শিল্প এলাকায় আটটি, সিইপিজেডে ছয়টি, ডবলমুরিংয়ে ছয়টি, পাহাড়তলীতে পাঁচটি, কেইপিজেডে তিন, বায়েজিদে তিন, নগরী ও উপজেলাগুলো আরও ১৩টিসহ মোট ৪৪ কারখানার কাজের আদেশ কম থাকায় ঈদের আগে বেতনভাতা নিয়ে শ্রমিক অসন্তোষের আশঙ্কা আছে। এসব কারখানায় শ্রমিক সংখ্যা প্রায় ২১ হাজার।
চট্টগ্রামে ৪৪ পোশাক কারখানার অসন্তোষ প্রসঙ্গে শিল্প পুলিশ বলছে—ক্রেতাদের সময়মতো পণ্য না নেওয়া, আর্থিক সংকট, কাজের আদেশ আশঙ্কাজনক হারে কমে যাওয়া, বেতনভাতা বকেয়া থাকায় শ্রমিকদের কাজে যোগ না দেওয়াসহ অন্যান্য কারণে কারখানাগুলো আর্থিক সংকটে আছে। সে কারণে ঈদের আগে বেতনভাতা নিয়ে অসন্তোষ দেখা দিতে পারে।
ঝুঁকিতে থাকা এসব কারখানার কর্মকর্তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডেইলি স্টারকে জানান, তাদের প্রতিষ্ঠান আগে বিদেশি ক্রেতাদের কাছ থেকে সরাসরি কার্যাদেশ নিয়ে কাজ করতো। পরিস্থিতি ক্রমশ হাতছাড়া হতে শুরু করলে সাব-কন্ট্রাক্টে কাজ করতে হয়েছে। যেসব বড় কারখানা কার্যাদেশ দিত তারাও কাজের আদেশ পাচ্ছে না। এ কারণে শ্রমিকদের বেতনভাতা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
নগরীর পাহাড়তলী এলাকায় বন্ধ হয়ে যাওয়া এক পোশাক কারখানার শ্রমিক সন্তোষ মন্ডল ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পরিবারের সদস্যদের নিয়ে কষ্টে আছি। গত দুই মাস ধরে নতুন চাকরি খুঁজছি।'
বিজিএমইএ সূত্রে জানা গেছে—গত ছয় মাসের মধ্যে বেইজ ট্রেক্সটাইল ও ওয়েল গ্রুপের পাঁচ কারখানার মধ্যে তিনটির কার্যক্রম বন্ধ। ওয়েল গ্রুপের মালিক ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ হওয়ায় বিদ্যমান পরিস্থিতিতে কারখানা বন্ধ আছে।
চট্টগ্রামের মোহরা এলাকায় বন্ধ হয়ে যাওয়া অপর পোশাক কারখানার মালিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডেইলি স্টারকে বলেন, 'গত ৫ আগস্টের পর কয়েক দফায় হামলা চালিয়ে কারখানায় লুট করা হয়েছে। বাধ্য হয়েই কারখানা বন্ধ করে দিয়েছি।'
বিজিএমইএ'র প্রশাসক কমিটির সদস্য ও ক্লিফটন গ্রুপের পরিচালক এমডিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পোশাক কারখানাগুলোয় কাজের আদেশ কমে গেছে। ঠিকমতো পণ্য না পাঠানোর কারণে অনেক কারখানার মালিক আর্থিক সমস্যায় আছেন। এ কারণে শ্রমিকদের বেতনভাতা দিতে সমস্যা হচ্ছে। অনেক কারখানার মালিক সংকটের কারণে প্রতিষ্ঠান চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন।'
তিনি আরও বলেন, 'কোনো মালিকই শ্রমিকদের বেতনভাতা বন্ধ রাখতে চান না। ঈদের যাতে কোনো শ্রমিক অসন্তোষ না হয় সে জন্য কাজ করছি।'
চট্টগ্রাম শিল্প পুলিশের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মো. জসীম উদ্দিন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমাদের তথ্য অনুসারে ৪৪ কারখানা বেতনভাতা দেওয়া নিয়ে আশঙ্কা করছে। বিভিন্ন সময় এসব প্রতিষ্ঠানে সংকট হয়েছিল। কারখানার মালিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। আশা করছি সংকট সমাধান করা সম্ভব হবে।'