Image description

রাজধানীর পল্লবী থানার আলোচিত ওসি অপূর্ব হাসান। যদিও নামের সঙ্গে পেশাগত জীবনের কোনো মিল নেই। বরং পদে পদে ক্ষমতা ও অবৈধ আয়ের নজির রেখে গেছেন তিনি। সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছেন জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের সময়। শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলা ‘মাইরা তো আমরা ফেলছি, এখন কী করবা’— এমন মন্তব্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হন তিনি।

ক্ষমতার অপব্যবহার ও অঢেল সম্পদের অভিযোগে ২০২২ সালে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মুখোমুখিও হয়েছিলেন তিনি। সে যাত্রায় দায়মুক্তি মিলেছিল তার। সেই অপূর্ব হাসানের বিরুদ্ধে পুনরায় অনুসন্ধানে নেমেছে প্রতিষ্ঠানটি।

এবারের অভিযোগ ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ, হত্যা, স্বর্ণ চোরাকারবারির সঙ্গে জড়িত এবং ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ অর্জন। সামান্য উপ-পরিদর্শক (এসআই) থেকে ওসি হওয়া এবং রাজধানী পল্লবী থানায় বদলিতে হয়ে যান ব্যাপক ক্ষমতাবান। গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জ হওয়ায় ক্ষমতার প্রধানতম উৎস হিসেবে ধরা হয়। কারণ, গোপালগঞ্জকে সাইনবোর্ড বানিয়ে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ আওয়ামী লীগ সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রীদের ঘনিষ্ঠতায় ‘ক্ষমতাবান পুলিশ’ হয়ে ওঠেন অপূর্ব হাসান।

 

দুদকের গোয়েন্দা অনুসন্ধানে রাজধানীতে ডজন খানেক ফ্ল্যাট, প্রাইভেট গাড়ি ও প্লট, গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলায় আট একর জমি, গরুর খামার ও মাছের ঘেরের তথ্যপ্রমাণ মিলেছে এরই মধ্যে। অঢেল সম্পদের খোঁজে সম্প্রতি তার বিরুদ্ধে পুনরায় অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত হওয়ার পর উপ-সহকারী মো. আবদুল্লাহ আল মামুনকে কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে কমিশন। অনুসন্ধান কর্মকর্তা ইতোমধ্যে তার ব্যক্তিগত নথিপত্রসহ তার বিরুদ্ধে বিস্তারিত তথ্য চেয়ে পুলিশ বিভাগে চিঠিও দিয়েছে।

এ বিষয়ে দুদক মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, অনুসন্ধান যেহেতু শুরু হয়েছে, দুদক আইন ও বিধি অনুসরণ করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অনুসন্ধান কর্মকর্তা কাজ শুরু করছেন। অনুসন্ধান প্রতিবেদনের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে কমিশন সিদ্ধান্ত নিলে আমরা তা গণমাধ্যমকে জানিয়ে দেব।

দুদক ও পুলিশ সদরদপ্তর সূত্রে জানা যায়, অপূর্ব হাসান যশোরের বেনাপোল পোর্ট থানা, যশোরের কোতোয়ালি, রাজধানীর তেজগাঁও এবং সর্বশেষ পল্লবী থানায় ওসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ১২ আগস্ট অপূর্বকে ঠাকুরগাঁও ইন-সার্ভিস ট্রেনিং সেন্টারে বদলি করা হয় বলে জানা গেছে।

গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার রামদিয়ার সাধুহাটি গ্রামে অপূর্বের পৈতৃক বাড়ি। তার বাবা প্রয়াত হাসেম আলী মিয়াও পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) ছিলেন। অপূর্ব ২০০২ সালে এসআই হিসেবে বাংলাদেশ পুলিশে যোগ দেন। ২০১২ সালে পরিদর্শক পদে পদোন্নতি পেয়ে ওসি হিসেবে বদলি হন। ৬০-৬৫ হাজার টাকা বেতনের কর্মচারী ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে গড়ে তোলেন সম্পদের পাহাড়।

অপূর্বের যত সম্পদ

অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, ওসি অপূর্বের রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় প্লট এবং বনশ্রীর ‌‘সি’ ব্লকের আলিশান পুলিশ পার্ক ভবনে রয়েছে চারটি ফ্ল্যাট। যদিও এরই মধ্যে একটি বিক্রি করেছেন বলে জানা গেছে। প্রতিটি ফ্ল্যাটের আয়তন দুই হাজার ৪০০ বর্গফুট। যার প্রতিটির মূল্য কোটি টাকার ওপরে।

অন্যদিকে, ভাটারার নয়ানগরের ২ নম্বর রোডের (মিষ্টি গলি) ভবন-১৭ এর ছয় তলায় রয়েছে আরও একটি ফ্ল্যাট। যেখানে পরিবারসহ বসবাস করেন অপূর্ব। আয়তন দুই হাজার ৮০০ বর্গফুট। আট তলা ভবনে দুই ইউনিটের আরও নয়টি ফ্ল্যাট রয়েছে। যদিও কাগজ-কলমে নিজের নামে রেজিস্ট্রেশন হয়নি বলে জানা গেছে।

এ ছাড়া গোপালগঞ্জের কাশিয়ানীর রাতইল ইউনিয়নে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের পাশে দুই একর জমিতে রয়েছে মাছের ঘের। যার দেখাশুনার দায়িত্বে রয়েছেন তার মামাতো ভাই রুহুল আমিন। সাধুহাটি এলাকায় ফয়সাল অ্যাগ্রো নামে একটি গরুর খামারও রয়েছে তার। যার দেখভাল করেন তার আত্মীয় সাবেক ইউপি সদস্য আরোজ আলী। পটপরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ওই খামারের ৫০টির বেশি গরু বিক্রি করা হয়েছে বলে জানা গেছে।

অপরদিকে, গোপালগঞ্জের কাশিয়ানীর রামদিয়ায় অপূর্ব ও তার পরিবারের নামে আট একর জমির তথ্যপ্রমাণও মিলেছে। এ ছাড়া ওই এলাকার ১২টি স্থানে তার স্ত্রী ফাতিমা রহমানসহ পরিবারের নামে জমির মালিকানা রয়েছে। যার মধ্যে- বহালবাড়িয়া মৌজায় অপূর্ব হাসানের নামে এক একর ৫১ শতক, ৭৮৫ খতিয়ানে ৩০ শতক ৩২ অযুতাংশ, একই মৌজার ৭৮৩ খতিয়ানে ফাতিমা রহমানের নামে ৮০.৪ শতক, ৭৮৭ খতিয়ানে দুই একর ১০ শতক, ৭৮৮ খতিয়ানে ৩৩ শতক, রামদিয়া মৌজায় ৯২০ খতিয়ানে অপূর্ব হাসানের নামে ১৯.২৫ শতক জমি রয়েছে।

অপূর্ব হাসানের দুই ভাই আহসান হাবিব ও খাজা নেওয়াজের নামে  ৯২১ খতিয়ানে ১৫ শতক, ১৪৯ নম্বর বড় নড়াইল মৌজায় স্ত্রী ফাতিমা রহমানের ৯৫ শতক, ৮২৫ খতিয়ানে নিজ নামে ৪১ শতক জমিরও তথ্য রয়েছে দুদকে জমা হওয়া অভিযোগে। এসব জমি ২০২০ ও ২০২১ সালে তাদের নামে নামজারি করা হয়। রামদিয়া বাজারের পাশেও তিন কোটি টাকা মূল্যের আড়াই বিঘা জমিও রয়েছে বলে সূত্র বলছে।

অপূর্ব হাসান ২০১৪ সালের এপ্রিল থেকে ২০১৮ সালের জুলাই পর্যন্ত যশোর বেনাপোল পোর্ট থানার যখন ওসি ছিলেন তখন স্বর্ণ ও গরু চোরাকারবারির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন বলে জানা যায়। ওই সময়ে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান শুরু করেছিল দুদক। কিন্তু ২০২২ সালের ১৩ জুলাই অপূর্ব হাসানের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ নথিভুক্ত (অভিযোগ থেকে অব্যাহতি) করা হয়েছিল।

যে কারণে আলোচিত

২০২৪ সালের ১৭ বা ১৮ জুলাই সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে, যেখানে দেখা যায় মিরপুর ১২ নম্বর সেকশন এলাকায় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলার সময় অন্য শিক্ষার্থীকে হত্যার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘মাইরা তো আমরা ফেলছি, এখন কি করবা?’ এ সময় উপস্থিত পুলিশ সদস্যদের ধমক দিয়ে তিনি বলেন, ‘যে গুলি করবে না তাকে আমি গুলি করব।’ এরপরই শিক্ষার্থীদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালায় পুলিশ। হতাহত হন অনেকে। 

অভিযোগের বিষয়ে জানতে অপূর্ব হাসানের ব্যক্তিগত নম্বরে যোগাযোগ করা হলে ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।একটি সূত্রে জানা যায় তার বিরুদ্ধে একাধিক ফৌজদারি মামলা দায়ের হওয়ার পর থেকে তিনি পলাতক রয়েছেন।