Image description

জুলাই অভ্যুত্থানে সক্রিয় মেহেরুন নেছা তানহা পোলাও-মাংস খেতে পছন্দ করতেন। তিনি শহীদ হওয়ার পর বাসায় ওই পদ আর রান্না করেননি তার মা। রমজান মাসের বিকেলে ঘরে ঘরে ইফতারি বানানোর যে তোড়জোড় চলে, সেটাও নেই 'আলোহীন' তানহাদের বাড়িতে।

আজ ২২ রমজানে কাঁদতে কাঁদতে তানহার মা আসমা আক্তার বলছিলেন, 'আমার মেয়ে ছাড়া আমার ঘর অন্ধকার। ঈদে মেয়ে নিজ হাতে সব রান্না করত। আগের রাতেই সেমাই রান্না করে রাখত। কিন্তু এবার তো আমার মেয়েই নাই। আমাদের আর কিসের ঈদ!'

অভ্যুত্থানে আরেক শহীদ দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী ১৬ বছরের নাঈমা সুলতানার মা আইনুন নাহারের কণ্ঠেও ঝরল একই হাহাকার। বললেন, 'প্রতি ঈদের সকালে ঘুম থেকে উঠেই মেয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলত, "মা, তুমি খুব সুন্দর। তোমাকে অনেক ভালোবাসি"। এই ঈদের সকালে এই কথা আমাকে কে বলবে?'

১৮ বছরের মোসাম্মৎ লিজা ঢাকার শান্তিনগরের একটি বাসায় গৃহকর্মীর কাজ করতেন। পাশাপাশি একটি মহিলা মাদ্রাসায় আরবি পড়িয়ে উপার্জন করা অর্থ দিয়ে অসুস্থ বাবা-মায়ের দেখভাল করতেন তিনি। আন্দোলন চলাকালে লিজা যেখানে কাজ করতেন, সেই বাসার বারান্দায় গুলিবিদ্ধ হন। তিন দিনের মাথায় একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

অনুষ্ঠানে উপস্থিত শহীদ পরিবারের সদস্য ও অতিথিরা। ছবি: রাশেদ সুমন/স্টার

মেয়ের কথা বলতে গিয়ে ভাষা হারিয়ে ফেলেন অসুস্থ বাবা মো. জয়নাল। কান্নার দমকে কথা জড়িয়ে আসে তার। সেই কান্না সংক্রমিত হয় উপস্থিত সবার ভেতর।

জুলাই অভ্যুত্থানের নারী শহীদদের পরিবারের সদস্যরা আজ মিলিত হয়েছিলেন দ্য ডেইলি স্টার কার্যালয়ে। আন্তর্জাতিক নারী দিবসকে কেন্দ্র করে আয়োজন করা হয় 'কেমন আছে গণঅভ্যুত্থানে নারী শহীদ পরিবার' শীর্ষক অনুষ্ঠানের। এতে কথা বলেন কোনো শহীদের মা, কারো মেয়ে, কারো ভাই কিংবা বাবা।

অনুষ্ঠানে শহীদদের স্বজনদের আকুতি ছুঁয়ে যায় মিলনায়তনে উপস্থিত দর্শক-শ্রোতা-অতিথিদের। প্রত্যেকেই তারা এই হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি করেন। একইসঙ্গে তারা পতিত স্বৈরশাসকের ফিরে আসা বা নতুন ফ্যাসিস্ট তৈরির পথ রুদ্ধ করার আহ্বান জানান।

অনুষ্ঠানে কথা বলেন শহীদ নাফিসা হোসেন মারওয়ার বাবা আবুল হোসেন। চা-দোকানি আবুল হোসেন মেয়েকে নিয়ে থাকতেন টঙ্গীতে। তিনি বলেন, শুরুর দিকে তার মেয়ে যে মিছিলে যেত তা তিনি জানতেন না। প্রতিবেশীদের কাছ থেকে জানার পর তিনি মেয়েকে তার মামার বাড়ি সাভারে পাঠিয়ে দেন।

'কিন্তু সেখানে গিয়েও সে মিছিলে যেত। আমাকে একবার ছবি তুলে পাঠালো। বকাঝকা করলেও শুনতো না। ৫ আগস্ট দুপুরে আমাকে ফোন দিয়ে বললো যে হাসিনা পালাইছে। খুব খুশি ছিল। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই খবর পাই আমার মেয়ের গুলি লাগছে।'

তিনি বলেন, গুলি লাগার পরও নাফিসার সঙ্গে তার ফোনে কথা হয়। নাফিসা বলেন—'বাবা, আমি মরে যাব। আমার লাশটা নিয়ে যেও।' রাস্তার গাড়িঘোড়া না থাকায় টঙ্গী থেকে পায়ে হেঁটে সাভার যান আবুল হোসেন।

শহীদ পরিবারগুলোর হাতে প্রতিকৃতি তুলে দেওয়া হয়। ছবি: রাশেদ সুমন/স্টার

তিনি অভিযোগ করেন, শুরুতে পুলিশ মামলা নিতে চায়নি। পরে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতার নাম বাদ দেওয়ার পর মামলা নেয়। কিন্তু তিনি টঙ্গীতে থাকেন, আর মামলা সাভারে বলে আর কোনো অগ্রগতি জানেন না।

শহীদ নাসিমা আক্তারের ভাই মো. সোলাইমান বলেন, ধানমন্ডি এলাকায় হেলিকপ্টার থেকে ছোঁড়া গুলিতে তার বোন নাসিমা শহীদ হন। একই বুলেট তার ছেলের বুক ভেদ করে পরে নাসিমার গলায় আঘাত করে।

'আমার বোন তো মারা গেছে। ছেলেটা বেঁচে আছে। ছেলের কী হয়, আমরা সামলাইতে পারব কি না, এসব বিবেচনায় মামলাও করি নাই। কোনো ক্ষতিপূরণও পাইনি। কেউ আমাদের তেমন খোঁজখবরও করেনি।'

শহীদ শাহীনুর বেগম নিজে যাত্রাবাড়িতে মাছের আড়তে কাজ করে ছেলে-মেয়েদের বড় করেছেন, বিয়ে দিয়েছেন। তার মেয়ে মোছাম্মৎ হাফেজা বলেন, 'আমাদের তো মা ছাড়া কেউ নাই। মাছ বিক্রি করে মা আমাদের খাওয়াইতো। গুলিবিদ্ধ হইলে মাকে এক অপরিচিত লোক ভ্যানে করে ঢাকা মেডিকেল নিয়া যায়। মার ফোন থেকে তিনি বিভিন্ন জনকে ফোন দিচ্ছিলেন। আমি তখন দেশগেরামে। খবর পাইয়া রাস্তায় বাইর হইছি। হাতে টেকা নাই। আমাকে কাঁদতে দেখে একজন ৫০০ টাকা দিল। এটা নিয়ে মেডিকেল পৌঁছাই।'

তিনি বলেন, ঢাকা মেডিকেলে আইসিইউ সংকট ছিল। চার দিন পর অনেক কান্নাকাটি, অনেকের হাত-পা ধরে আইসিইউ ব্যবস্থা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মাকে বাঁচানো যায়নি।

প্রতিদিন ইফতারের সময় তার সন্তান তাকে বলে নানির হাতের ইফতার মাখা খাবে, তার হাতেরটা মজা হয় না। তার ভাইয়েরাও এমন করে। ঈদের কাপড়ও তার মা সেলাই করে দিতেন। এবারের ঈদে কেউ কাপড় সেলাই করে দিবে না বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন হাফেজা।

অনুষ্ঠানে শহীদ রিতা আক্তারের মা রেহানা বিবি, মায়া ইসলামের স্বামী মাহবুব ইসলাম ও সুমাইয়া আক্তারের মা আছমা বেগমও বক্তব্য দেন। পরে স্বজনদের হাতে শহীদদের প্রতিকৃতি ও ঈদ উপহার তুলে দেন অন্তর্বর্তী সরকারের মৎস্য ও প্রাণীসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতার ও দ্য ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম।

শহীদদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন। ছবি: রাশেদ সুমন/স্টার

প্রধান অতিথির বক্তব্যে ফরিদা আখতার বলেন, 'জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদদের আমরা সম্পদ মনে করি। তারা ছাড়া আমাদের কোনো মূল্যই নেই। শহীদদের রক্তের সঙ্গে আমরা কখনোই বেঈমানি করতে পারব না।'

তিনি বলেন, বিশ্বের বেশিরভাগ ফ্যাসিস্টের চেহারা পুরুষ হলেও বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য যে এই ফ্যাসিস্ট একজন নারী। এই একজনের ইচ্ছায় ও নির্দেশে কত মানুষ এখানে খুন হয়েছে! শুধুমাত্র ক্ষমতায় থাকার লোভে। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সে চেয়েছিল আরও গুলি করে মানুষ হত্যা করতে। এই খুনীর বিচার হতেই হবে।

বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক সাঈদ ফেরদৌস বলেন, এত কিছুর পরও অনেক শহীদ পরিবার মামলা করতে পারছে না, কেউ প্রাণনাশের হুমকি পাচ্ছে, এটা তো কোনোভাবেই হতে পারে না।

তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কাড়াকাড়ি চলছে কে কার আগে ক্ষমতায় যাবে তা নিয়ে। এর জন্য এত মানুষ জীবন দিয়েছে?

সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল আরিফ খান বলেন, সভ্যতার শিক্ষা এটাই যে খুনের বিচার খুন দিয়ে হয় না। খুনি হয়তো চোখের পলকে একটা প্রাণ নিয়ে নিয়েছে, কিন্তু তার বিচারের জন্য অনেকগুলো ধাপ পার হতে হয়। তিনি বলেন, জুলাই হত্যাকাণ্ডের তথ্য সংগ্রহ ও অনুসন্ধান কার্যক্রম চলছে। এটি শেষ হলেই মূল বিচারকাজ শুরু হবে।

ডেইলি স্টারের সাংবাদিক ইমরান মাহফুজের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন শিক্ষার্থী ফরিদ উদ্দিন রনি, সিরাজুম মুনিরা, শ্যামলী সুলতানা জেদনী ও নাফিসা ইসলাম সাকাফি। অভ্যুত্থান নিয়ে স্ব-রচিত গান পরিবেশন করেন আমিরুল মোমেনিন মানিক।