Image description

‘দুই বছর হয়ে গেল, প্রতি সপ্তাহে তিন দিন এখানে আসি ডায়ালাইসিসের জন্য। প্রতিবার খরচ হয় ২ হাজার ৩০০ টাকা। সপ্তাহ শেষে তা দাঁড়ায় প্রায় ৭ হাজার টাকা। মাসে মোট খরচ হয় ২৮ হাজার টাকা। প্রতি সপ্তাহে নিতে হয় একটি ইনজেকশন, যার খরচ ৪ হাজার টাকা। মাস শেষে খরচ ১৬ হাজার টাকা। প্রতিদিনের নানা ওষুধের জন্য আরও ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা খরচ করতে হয়। ফলে প্রতি মাসে চিকিৎসার জন্য প্রায় অর্ধলাখ খরচ হয়ে যায়।’

রাজধানীর কিডনি ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্স ইনস্টিটিউটের পেশেন্ট কেয়ার বিভাগে প্রবেশ করতেই দেখা মেলে ফাহিমা আলমের (৫০)। সাভার থেকে আসা তার সঙ্গে কেউ ছিলেন না। সেখানেই কথাগুলো বললেন। তিনি যেন শয্যাশায়ী অবস্থায় নিরন্তর সংগ্রামের সাক্ষী হয়ে শুয়ে আছেন। শরীরে ক্লান্তির ছাপ। কিন্তু চোখে-মুখে এক অদ্ভুত দৃঢ়তা—যেন তিনি একে একে পার করে যাচ্ছেন জীবনযুদ্ধের প্রতিটি দিন। 

বুধবার (১৯ মার্চ) কিডনি ফাউন্ডেশনে গিয়ে ফাহিমার মতো অসহায় অনেক রোগীর দেখা মেলে। তিনি বলছিলেন, ‘হাসপাতাল থেকে কোনো ধরনের অর্থনৈতিক সহায়তা দেওয়া হয় না। কিন্তু সেবার মান ভালো। নিয়মিত ওষুধ নিলেই কোনোরকমে চলতে পারি। কিন্তু এই বিশাল খরচ একমাত্র আমাকে, আমার পরিবারকেই বহন করতে হয়।’ তবে তার মুখে নেই কোনো অভিযোগ-অনুযোগ। শুধু এক নীরব আক্ষেপ, এক অসীম যন্ত্রণা। যে যন্ত্রণা তার পরিবারের প্রতিটি সদস্যের শরীরে অনুভূত হয়।

‘আমাদের সেন্টারে ৭০ জন চিকিৎসক এবং ১৫০ জন নার্স রয়েছেন। যারা ২৪ ঘণ্টা রোগীর সেবা নিশ্চিত করতে নিবেদিতভাবে কাজ করেন। আমাদের হাসপাতাল মূলত কিডনি রোগীদের জন্য বিশেষায়িত। তাই এখানে কিডনি রোগীরাই চিকিৎসা নিতে আসেন।’ -মো. পাভেল রহমান, প্রশাসনিক কর্মকর্তা, কিডনি ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্স ইনস্টিটিউট।

কিডনি ফাউন্ডেশনের সেবা নিয়ে প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. পাভেল রহমান বলেন, ‘আমাদের সেন্টারে ৭০ জন চিকিৎসক এবং ১৫০ জন নার্স রয়েছেন। যারা ২৪ ঘণ্টা রোগীর সেবা নিশ্চিত করতে নিবেদিতভাবে কাজ করেন। আমাদের হাসপাতাল মূলত কিডনি রোগীদের জন্য বিশেষায়িত। তাই এখানে কিডনি রোগীরাই চিকিৎসা নিতে আসেন। বিশেষ করে, যেসব রোগী কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করিয়েছেন বা নিয়মিত ডায়ালাইসিস করান, তারা আমাদের হাসপাতালের সেবার ওপর বেশি নির্ভর করেন।’ 

ফাউন্ডেশনে রোগী সেবা
ফাউন্ডেশনের প্রশাসনিক কর্মকর্তার ভাষ্যমতে, এখানে রোগীদের চিকিৎসা তিনটি প্রধান বিভাগের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। প্রতিটি বিভাগে যোগ্য ও অভিজ্ঞ চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে উন্নত চিকিৎসাসেবা প্রদান করা হয়। রোগী যাতে সর্বোচ্চ মানের সেবা পেতে পারেন। ইনডোর বিভাগে ভর্তি থাকা রোগী বিশেষজ্ঞ অধ্যাপকদের অধীনে চিকিৎসা গ্রহণ করেন। অভিজ্ঞ চিকিৎসক সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধানে রাখেন এবং রোগীর অবস্থা অনুযায়ী চিকিৎসা প্রদান করেন। 

আউটডোর বিভাগে প্রতিদিন সাত থেকে আটজন চিকিৎসক উপস্থিত থাকেন। নতুন রোগীর শারীরিক অবস্থা পরীক্ষা করে তারা যথাযথ বিশেষজ্ঞের কাছে পাঠান। রোগী যাতে দ্রুত ও সঠিক চিকিৎসা পেতে পারেন। জরুরি বিভাগে সেবার জন্য দুটি বেড সংরক্ষিত আছে। এখানে রোগীর প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়। যদি বেশি প্রয়োজন হয়, তবে দ্রুত অন্য হাসপাতালে রেফার করা হয়।

তিনি বলেন, আমাদের হাসপাতাল রোগীর সর্বোচ্চ সেবা নিশ্চিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। প্রতিটি বিভাগ সমন্বিতভাবে কাজ করে। রোগী যাতে নিরাপদ, কার্যকর ও উন্নতমানের স্বাস্থ্যসেবা লাভ করতে পারেন।

কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট সেবা
প্রশাসনিক কর্মকর্তা জানান, হাসপাতালে এ পর্যন্ত প্রায় ৭০০ সফল কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট সম্পন্ন হয়েছে। প্রতিটি ট্রান্সপ্লান্ট সাধারণত বুধবারে হয় এবং প্রতি সপ্তাহে একটি করে কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করা হয়।

তিনি বলেন, এ হাসপাতালটি সম্পূর্ণ ব্যক্তি মালিকানাধীন। এখানে কিডনি ট্রান্সপ্লান্টের জন্য ১৪ দিনের প্যাকেজ খরচ নির্ধারিত হয়েছে ২ লাখ ৬০ হাজার টাকা। এ খরচে অপারেশন এবং আইসিইউ ব্যয় অন্তর্ভুক্ত থাকে। তবে টিস্যু টাইপিং এবং টিস্যু ক্রস ম্যাচিংয়ের জন্য আলাদাভাবে ৩৫ হাজার টাকা খরচ হয়।

ডায়ালাইসিস সেন্টারে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ১০২টি যন্ত্র রয়েছে। এখানে প্রতিদিন গড়ে ৩০০ জন রোগী সেবা গ্রহণ করেন। তিনি বলেন, ডায়ালাইসিসের জন্য শিডিউলভুক্ত রোগীর ক্ষেত্রে ১ হাজার ৬০০ এবং নতুন রোগীর জন্য ২ হাজার ৩০০ টাকা নির্ধারিত। এখানে সাপ্তাহিকভাবে ২ হাজার ১০০ জন রোগী ডায়ালাইসিস করিয়ে থাকেন। মাসিক হিসাবে ৯ হাজার জনে পৌঁছে যায় এবং বাৎসরিকভাবে ১ লাখ ৮ হাজার রোগী এ সেবা গ্রহণ করেন।

তিনি উল্লেখ করেন, কিডনি ট্রান্সপ্লান্টের পর, রোগী নিয়মিত প্রতি শনিবার চেকআপের জন্য হাসপাতালে আসেন। এই চেকআপের তদারকি করেন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. হারুনুর রশিদ। হাসপাতালের লক্ষ্য হলো, বিশ্বমানের কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট সেবা প্রদান করে রোগীর একটি সুস্থ, স্বাভাবিক জীবন উপহার দেওয়া।

ডায়ালাইসিস চিকিৎসা
প্রশাসনিক কর্মকর্তার তথ্য অনুযায়ী, ডায়ালাইসিস সেন্টারে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ১০২টি যন্ত্র রয়েছে। এখানে প্রতিদিন গড়ে ৩০০ জন রোগী সেবা গ্রহণ করেন। তিনি বলেন, ডায়ালাইসিসের জন্য শিডিউলভুক্ত রোগীর ক্ষেত্রে ১ হাজার ৬০০ এবং নতুন রোগীর জন্য ২ হাজার ৩০০ টাকা নির্ধারিত। এখানে সাপ্তাহিকভাবে ২ হাজার ১০০ জন রোগী ডায়ালাইসিস করিয়ে থাকেন। মাসিক হিসাবে ৯ হাজার জনে পৌঁছে যায় এবং বাৎসরিকভাবে ১ লাখ ৮ হাজার রোগী এ সেবা গ্রহণ করেন।

সেবার মানবিক দিককে গুরুত্ব দিয়ে প্রতি সপ্তাহে প্রায় ১৪০ জন রোগীকে বিনামূল্যে ডায়ালাইসিস সেবা দেওয়া হয়। মাসে এ সংখ্যা ৫৬০ জন এবং বছরে ৬ হাজার ৭২০ জন রোগী ফ্রি চিকিৎসার সুযোগ পান। এটি অসহায় ও প্রয়োজনীয় রোগীদের জন্য আশার আলো হয়ে দাঁড়িয়েছে, তিনি যোগ করেন। 

লজিস্টিক সাপোর্ট
ফাউন্ডেশনের লজিস্টিক সাপোর্ট বিষয়ে মো. পাভেল রহমান জানান, হাসপাতালে পর্যাপ্ত ও কার্যকরী লজিস্টিক সুবিধা রয়েছে। কিন্তু রোগীর ক্রমবর্ধমান চাহিদার কথা বিবেচনা করে ডায়ালাইসিস মেশিনের সংখ্যা আরও বাড়ানো প্রয়োজন। কারণ রোগীর সংখ্যা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে অতিরিক্ত মেশিনের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হচ্ছে।

তিনি বলেন, ‘বর্তমানে আমাদের সেন্টারে মোট ১৫৬টি শয্যা রয়েছে। এর মধ্যে ১১২টি শয্যা ভর্তি রোগী দিয়ে পূর্ণ। যখন রোগীর সংখ্যা অত্যধিক বেড়ে যায়, তখন কিছুটা সুস্থ রোগী ছেড়ে দিয়ে অপেক্ষমাণ গুরুতর রোগীদের স্থান দেওয়া হয়। তারা যাতে জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসা পেতে পারেন।’

হাসপাতালে ১২টি বিশেষ ফ্রি বেড সংরক্ষিত রয়েছে। এগুলো সম্পূর্ণ বিনামূল্যে অসহায় ও সুবিধাবঞ্চিত রোগীদের চিকিৎসার জন্য বরাদ্দ করা হয়। এ বেডগুলোর মাধ্যমে অনেক দরিদ্র রোগী বিনামূল্যে উন্নত স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের সুযোগ পান। তাদের জন্য এক বড় আশীর্বাদ, তিনি যোগ করেন।

তিনি বলেন, আমাদের লক্ষ্য রোগীদের সর্বোচ্চ মানের চিকিৎসা ও সহায়তা প্রদান করা। প্রতিটি রোগী যাতে প্রয়োজনীয় সেবা পেয়ে দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠতে পারেন। হাসপাতালের লজিস্টিক ব্যবস্থাপনা আরও উন্নত ও সম্প্রসারিত করার জন্য আমরা নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করে যাচ্ছি।