Image description

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে অংশ নিতে গত বছরের ২০ জুলাই রাজধানীর দনিয়ার বাসা থেকে যাত্রাবাড়ীতে গিয়ে যুক্ত হয় নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী ইফাত হাসান খন্দকার। সেদিন পুলিশ-বিজিবি-র‌্যাব ও আওয়ামী সন্ত্রাসীদের হামলায় রণক্ষেত্রে পরিণত হয় যাত্রাবাড়ীর সড়ক-মহাসড়কগুলো। এ সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে থাকা এক আন্দোলনকারীর আর্তনাদে সাড়া দিয়ে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায় ইফাত। ফলে ঘাতক পুলিশের টার্গেটে পরিণত হয় সে। গুলিবিদ্ধকে রেখে হাসপাতাল থেকে বের হওয়ার পরই পুলিশ বুকে গুলি করে ইফাতকে হত্যা করে।

এসব তথ্য জানিয়েছেন শহীদ ইফাত খন্দকারের মা কামরুন নাহার। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে তিনি এখন গভীর শোকে মুহ্যমান। এখন তিনি চান খুনিদের বিচার। সেদিনের কথা স্মরণ করে তিনি আমার দেশকে বলেন, একমাত্র ছেলে ইফাতকে আন্দোলনে যেতে নিষেধ করেছিলাম। তখন ইফাত বলেছিল, ‘ফ্যাসিস্ট সরকারের কবল থেকে দেশকে রক্ষা করতে অনেক বাবা-মায়ের সন্তানই আন্দোলনে অংশ নিচ্ছে। আমাদেরও যেতে হবে, ঘরে বসে থাকলে আন্দোলন সফল হবে না।’

আগের দুই দিন আন্দোলনে যেতে দিলেও ২০ জুলাই ছেলের মুখে এমন কথা শোনার পর কামরুন নাহার ইফাতকে বাসা থেকে বের হতে দিচ্ছিলেন না। ২০২২ সালে ইফাতের বাবা রবিউল আমিন খন্দকার মারা যাওয়ার পর থেকে একমাত্র ছেলেকে ঘিরেই সব স্বপ্ন বুনতেন তিনি। তাই তাকে কোনোভাবেই ঝুঁকিপূর্ণ কোনোকিছুতে জড়াতে দিতেন না।

কিন্তু ইফাত ছিল প্রতিবাদী এক কিশোর। সে বেছে নিয়েছিল লড়াইকে। ২০ জুলাই দুপুর ১২টার দিকে ইফাত পাঞ্জাবি পরে বাসার নিচে গিয়ে আশপাশেই থাকবে বলে মাকে বুঝিয়ে গেট থেকে বের হয়। সেদিনের স্মৃতিচারণ করে কান্নাজড়িত কণ্ঠে কামরুন নাহার বলেন, আমি আমার ছেলের হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া মুহূর্তগুলো অনুভব করতে পারি। শেষ বিদায়ের আগে আমাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়ে বলেছিল, ‘চিন্তা করবা না আম্মু, ফিরে এসে একসঙ্গে দুপুরের খাবার খাব, ইনশাআল্লাহ।’

বাসা থেকে বেরিয়ে যাত্রাবাড়ীতে গিয়ে আন্দোলনে যুক্ত হয় ইফাত। যাত্রাবাড়ীর সড়ক-মহাসড়কগুলো তখন রণক্ষেত্র। সশস্ত্র আওয়ামী সন্ত্রাসী বাহিনী ও পুলিশ-বিজিবি-র‌্যাবের নির্বিচার গুলির মুখেও রাজপথ না ছেড়ে নিরস্ত্র ছাত্র-জনতা একের পর এক শহীদ হচ্ছিলেন। কেউ কেউ গুলিবিদ্ধ হয়ে সড়কেই পড়েছিলেন। এমনি এক আন্দোলনকারী গুলিবিদ্ধ হয়ে কাতরাচ্ছিলেন। তার আর্তনাদ কিশোর ইফাত খন্দকারের কানে যায়। গুলিবিদ্ধকে সহযোগিতা করতে যাওয়ার সময় এক বন্ধু বলে, ‘ইফাত ওখানে যাইস না, গেলে রিস্ক আছে’। তখন ইফাত বলে, ‘লোকটার গুলি লাগছে, ওনারে বাঁচাইতে হইবো’।

গুলিবিদ্ধ সহযোদ্ধাকে সেখান থেকে উদ্ধার করে দক্ষিণ যাত্রাবাড়ীর সালমান হাসপাতালে পৌঁছে দেয় ইফাত। এতেই পুলিশের টার্গেটে পরিণত হয় সে। হাসপাতাল থেকে বের হওয়ার পর খুব কাছ থেকে ইফাতকে গুলি করে পুলিশ। শহীদ ইফাতের সহযোদ্ধাদের কাছ থেকে এসব কথা শুনেছেন বলে আমার দেশকে জানিয়েছেন কামরুন নাহার। তিনি জানান, এরপর ইফাতকে সেখান থেকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করে। এরপর লাশ দনিয়ার বাসায় নিয়ে যান সহযোদ্ধারা। সেখান থেকে গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার মনপুরা গ্রামে নিয়ে যাওয়া হয় ইফাতের লাশ। সেখানে জানাজার পর বাবার কবরের পাশে শহীদ ইফাতকে দাফন করা হয়।

কামরুন নাহার বলেন, ‘আমার ইফাত স্কুলে পড়লেও ইসলামি মনোভাবাপন্ন ছিল। নিয়মিত নামাজ আদায় করত। আন্দোলনে যাওয়ার সময় আমি আয়াতুল কুরসি পড়ে ওকে ফুঁ দিয়ে দিতাম। এরপর জায়নামাজে বসে ওর জন্য দোয়া করতাম। ২০ জুলাই দুপুরের দিকে দুটি গুলির শব্দ শুনেছি। আমার এখনও মনে হয়, ওই দুটা গুলির একটা গুলি আমার ছেলের বুক বিদীর্ণ করেছে।’

একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে গভীর শোকে মুহ্যমান শহীদ ইফাতের মা। ছেলের হত্যার বিচার চেয়ে তিনি বলেন, ‘কোথাও গিয়ে শান্তি নেই আমার। গ্রামে গেলেও ভালো লাগে না, অস্থির লাগে। ছেলের হত্যাকারীদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হলেই হয়তো আমার এই অস্থিরতা কিছুটা কাটবে’।